আর্কাইভ  মঙ্গলবার ● ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ● ৩ বৈশাখ ১৪৩১
আর্কাইভ   মঙ্গলবার ● ১৬ এপ্রিল ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: কুড়িগ্রামে অষ্টমীর স্নান করতে এসে মারা গেলেন পুরোহিত       বাস-পিকআপ সংঘর্ষে ১১ জন নিহত       উপজেলা পরিষদ নির্বাচন: রংপুরে ৩০ প্রার্থীর মনোনয়নপত্র দাখিল        ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ডোমার ও ডিমলায় মনোনয়ন জমা দিলেন ৩৫ জন       নীলফামারীতে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী নারীকে গণধর্ষন -গ্রেপ্তার ৬      

 width=
 

‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ ও পাঠ্যপুস্তকে শিক্ষা

মঙ্গলবার, ১৭ মে ২০১৬, দুপুর ০৪:১৩

মাকসুদ-উন-নবী

দোষ আমাদেরই। বুঝে হোক না বুঝে হোক, শিক্ষাগুরুর প্রতি মর্যাদাটুকুও ছেঁটে ফেলেছি আমরা! পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবই থেকে মুছে ফেলা হয়েছে কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষা গুরুর মর্যাদা’ নামক কবিতাটি। যে কবিতা আমাদের উপলব্ধি করতে শিখিয়েছে শিক্ষকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের আদব কেমন হওয়া উচিত :

শিক্ষাগুরুর মর্যাদা

কাজী কাদের নেওয়াজ

বাদশাহ আলমগীর-

কুমারে তাঁহার পড়াইত এক মৌলভী দিল্লীর।

একদা প্রভাতে গিয়া

দেখেন বাদশাহ- শাহজাদা এক পাত্র হস্তে নিয়া

ঢালিতেছে বারি গুরুর চরণে

পুলকিত হৃদে আনত-নয়নে,

শিক্ষক শুধু নিজ হাত দিয়া নিজেরি পায়ের ধুলি

ধুয়ে মুছে সব করিছেন সাফ্ সঞ্চারি অঙ্গুলি।

শিক্ষক মৌলভী

ভাবিলেন আজি নিস্তার নাহি, যায় বুঝি তার সবি।

দিল্লীপতির পুত্রের করে

লইয়াছে পানি চরণের পরে,

স্পর্ধার কাজ হেন অপরাধ কে করেছে কোন্ কালে!

ভাবিতে ভাবিতে চিন্তার রেখা দেখা দিল তার ভালে।

হঠাৎ কি ভাবি উঠি

কহিলেন, আমি ভয় করি না’ক, যায় যাবে শির টুটি,

শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার

দিল্লীর পতি সে তো কোন্ ছার,

ভয় করি না’ক, ধারি না’ক ধার, মনে আছে মোর বল,

বাদশাহ্ শুধালে শাস্ত্রের কথা শুনাব অনর্গল।

যায় যাবে প্রাণ তাহে,

প্রাণের চেয়েও মান বড়, আমি বোঝাব শাহানশাহে।

তার পরদিন প্রাতে

বাদশাহর দূত শিক্ষকে ডেকে নিয়ে গেল কেল্লাতে।

খাস কামরাতে যবে

শিক্ষকে ডাকি বাদশা কহেন, “শুনুন জনাব তবে,

পুত্র আমার আপনার কাছে সৌজন্য কি কিছু শিখিয়াছে?

বরং শিখেছে বেয়াদবি আর গুরুজনে অবহেলা,

নহিলে সেদিন দেখিলাম যাহা স্বয়ং সকাল বেলা”

শিক্ষক কন-”জাহপানা, আমি বুঝিতে পারিনি হায়,

কি কথা বলিতে আজিকে আমায় ডেকেছেন নিরালায়?”

বাদশাহ্ কহেন, “সেদিন প্রভাতে দেখিলাম আমি দাঁড়ায়ে তফাতে

নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন প্রক্ষালন,

পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে ও চরণ।

নিজ হাতখানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে

ধুয়ে দিল না’ক কেন সে চরণ, স্মরি ব্যথা পাই মনে।”

উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষকে আজি দাঁড়ায়ে সগৌরবে

কুর্ণিশ করি বাদশাহে তবে কহেন উচ্চরবে-

“আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির,

সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ্ আলমগীর।”

এই কবিতা আমাদের শিখিয়েছে, পানি ঢেলে দেওয়াই যথেষ্ট নয়, বরং নিজ হাতে শিক্ষকের পা ধুয়ে দেওয়া উচিত। এমন সুন্দর শিক্ষণীয় একটি কবিতা পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেওয়া হলো কোন বিচারে? এই কবিতায় না আছে কোনো রাজনীতি, না আছে ধর্মীয় উগ্রবাদ। আরে ভাই, গল্প-কবিতার চরিত্রগুলো তো কোনো না কোনো সম্প্রদায়ের মানুষ। বাদশা আলমগীর নামটি যেমন ইসলাম ধর্মের, তেমনি শকুন্তলা নামটিও সনাতন ধর্মের। জানি না কোন ভয়ে ‘শিক্ষা গুরুর মর্যাদা’ কবিতাটি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে এই প্রজন্মকে। যুক্তি যাই থাকুক, শিক্ষক ভক্তির এই গুরুত্বপূর্ণ গল্পটা অজানাই থেকে যাবে নতুন প্রজন্মের কাছে! শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার এই প্রেক্ষাপটে এমন কবিতা বারবার উচ্চারণের প্রয়োজন বোধ করি।

একটা বিষয় হয়তো আমরা ভুলে গেছি যে, আজ যারা সমাজে জ্ঞানী-গুণী ও সৎ আদর্শবান মানুষ, তারা অনেকেই এসব কবিতা পড়েই বড় হয়েছেন।

কেবল ‘শিক্ষাগুরুর ভক্তি’ই বাদ যায় নি। পাঠ্যবই থেকে উঠিয়ে দেয়া হয়েছে কবি কালিদাসের ‘মাতৃভক্তি’ কবিতাটিও। যে কবিতায় আমরা শিখেছিলাম- কী করে মায়ের তৃষ্ণা মেটাতে গভীর রাতে বহুদূর থেকে হলেও পানি  আনতে হয় । কী করে ঘুমন্ত মাকে না জাগিয়ে পানির পেয়ালা হাতে নিয়ে তাঁর শিয়রে সকাল অবধি দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।

মাতৃভক্তি

কবি কালিদাস

বায়েজিদ বোস্তামী

শৈশব হতে জননীর সেবা করিতেন দিবাযামী।

দুপুর রাত্রে জননী জাগিয়া ডাকিলেন,'বাছাধন,

বড়ই পিয়াস পানি দাও' বলি মুদিলেন দু'নয়ন।

দেখিল বালক ঘরের কোণের কলসিতে নেই পানি,

বহুদূর পথ ঝরনা হইতে কলসি ভরিয়া আনি।

মায়ের তৃষ্ণা মিটাইবে বলি গভীর অন্ধকারে

ছুটিয়া বাহির হইল একাকী কলসি লইয়া ঘাড়ে।

জল ঢালি পিয়ালায়

সুপ্তা মাতার নয়ন শিয়রে দাঁড়ায়ে রহিল ঠায়।

ভাঙালে নিদ্রা হবে অপরাধ, কখন ভাঙিবে নিঁদ,

সেই ভরসায় পানি হাতে খাঁড়া রহিল যে বায়েজিদ।

পূর্ব গগন ফর্সা হইল, ডাকিয়া উঠিল পাখি,

জননী মেলিল আঁখি।

দেখিল শিয়রে দাঁড়ায়ে রয়েছে দশ বছরের ছেলে

পানি হাতে কেন, বুঝিল না মাতা প্রথম নয়ন মেলে।

সহসা পড়িল মনে,

গভীর রাতে পিপাসায় পানি চেয়েছিল বাছাধনে।

কহিল মা, মরি মরি!

বাছারে আমার, পানি হাতে করে সারা রাত্রটি ধরি

দাঁড়াইয়া আছ? ঘুমাওনি আজ?' চোখে এল জল ভরি।

পুত্রেরে কোলে নিয়ে মা চুমিল বার বার মুখখানি।

কহিল জননী,'নয়নের মণি, সাধারণ শিশু নও,

খোদার দোয়ার বরকতে তুমি জগতপূজ্য হও...

বায়েজিদ বোস্তামী ছিলেন একজন সুফি সাধক। শৈশবে মায়ের প্রতি তাঁর ভক্তি আদর্শ নিয়ে লেখা এই কবিতা কেন বাদ দেয়া হলো তা বোধগম্য নয়। এই কবিতায় রাজনীতি নেই, কোনো ধর্মীয় চেতনার পক্ষপাতিত্বও নেই। বাদ দেয়ার কারণ যাই হোক, এমন অনন্য একটি কবিতার মধ্য দিয়ে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও কর্তব্য শিক্ষা নেয়ার সুযোগ থেকে কয়েকটি প্রজন্ম বঞ্চিত হয়েছে, হতে থাকবে।

মানুষের মধ্যে সততার বিস্তার ঘটাতে চাইলে ছেলেবেলা থেকেই সেই শিক্ষা দিতে হয়। তাই তো ষষ্ঠ শ্রেণির বইতে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ রচিত ‘সততার পুরস্কার’ নামে একটি গল্প ছিল। যেখানে আমরা শিক্ষা পেয়েছি সততা রক্ষা করে চললে তার পুরস্কার অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু দুঃখজনক হলো, এই গল্পটিও বাদ দেওয়া হয়েছে। স্থান, কাল, পাত্র যাই হোক; সততার গল্পগুলো যদি শৈশব থেকেই শোনানো না হয়, তাহলে সমাজে ভালো মানুষ গড়ে উঠবে কীভাবে? সততার গল্প কোনো হিন্দু ব্যক্তিরই হোক আর মুসলিমই হোক; কিংবা বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের। শিক্ষণীয় যেকোনো কিছুই মানুষের মধ্যে মানবতাবোধ তৈরি করে। সাম্প্রতিককালে পাঠ্যবই থেকে বিভিন্ন গল্প-কবিতা তুলে দেওয়ার ধরন দেখে লালনের বাণীই মনে পড়ে, ‘জাত গেল জাত গেল বলে, একি আজব কারখানা...’।

ভালো মানুষ গড়ে তুলতে চাইলে ব্যক্তির মাঝে দেশপ্রেম জাগ্রত করা খুবই জরুরি। সে কারণে নবম শ্রেণির বইয়ে আমাদের পড়ানো হয়েছে আবদুল হাকিমের ‘বঙ্গবাণী’ :

বঙ্গবাণী

আব্দুল হাকিম

কিতাব পড়িতে যার নাহিক অভ্যাস।

সে সবে কহিল মোতে মনে হাবিলাষ।।

তে কাজে নিবেদি বাংলা করিয়া রচন।

নিজ পরিশ্রম তোষি আমি সর্বজন।।

আরবি ফারসি শাস্ত্রে নাই কোন রাগ।

দেশী ভাষে বুঝিতে ললাটে পুরে ভাগ।।

আরবি ফারসি হিন্দে নাই দুই মত।

যদি বা লিখয়ে আল্লা নবীর ছিফত।।

যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ।

সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন।।

সর্ববাক্য বুঝে প্রভু কিবা হিন্দুয়ানী।

বঙ্গদেশী বাক্য কিবা যত ইতি বাণী।।

মারফত ভেদে যার নাহিক গমন।

হিন্দুর অক্ষর হিংসে সে সবের গণ।।

যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।

সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।

দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে না জুয়ায়।

নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়।।

মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি।

দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।।

এ ছাড়া কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর দেশাত্মবোধক কবিতা ‘মাগো ওরা বলে’ আজও আমাদের মনে গেঁথে আছে :

মাগো, ওরা বলে

আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ

‘কুমড়ো ফুলে ফুলে

নুয়ে পড়েছে লতাটা,

সজনে ডাঁটায়

ভরে গেছে গাছটা,

আর, আমি ডালের বড়ি

শুকিয়ে রেখেছি—

খোকা তুই কবে আসবি!

কবে ছুটি?’

চিঠিটা তার পকেটে ছিল,

ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা।

‘মাগো, ওরা বলে,

সবার কথা কেড়ে নেবে

তোমার কোলে শুয়ে

গল্প শুনতে দেবে না।

বলো, মা, তাই কি হয়?

তাইতো আমার দেরী হচ্ছে।

তোমার জন্য কথার ঝুড়ি নিয়ে

তবেই না বাড়ী ফিরবো।

লক্ষ্মী মা রাগ ক’রো না,

মাত্রতো আর কটা দিন।’

কিন্তু প্রত্যেক বাঙালির মনে গেঁথে যাওয়া দেশপ্রেমের এই অনন্য কবিতা দুটিও পাঠ্যপুস্তক থেকে বিদায় করা হয়েছে। এর জায়গায় ২০১৩ সালে ঢোকানো হয়েছে তৎকালীন শিক্ষা সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর ‘সাহসী জননী বাংলা’ নামে একটি কবিতা। যদিও ওই বছরই বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সংসদীয় কমিটির সভায় শিক্ষা সচিবের কবিতাটি পাঠ্যবই বাদ দিয়ে ‘মাগো ওরা বলে’ ও ‘বঙ্গবাণী’ কবিতা দুটি প্রতিস্থাপিত করার সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু পরে তা বাস্তবায়ন করা হয়নি।

আমার এ লেখাটি পাঠ্যপুস্তকের সিলেবাস নিয়ে নয়। কিন্তু শিক্ষক লাঞ্ছনা যেহেতু ভীষণভাবে নৈতিক মূল্যবোধের প্রশ্নের জন্ম দেয়, তাই তার দায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর বর্তাবেই।

আমি খুবই নগণ্য একজন। তবে স্বল্প জ্ঞানে যতটুকু বুঝি তাতে বলা যায় যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্কুলের পাঠ্যবইয়ে নতুন করে যেসব গল্প-কবিতা আনা হয়েছে, তার বেশির ভাগেরই বার্তা ভাবমূলক কিংবা বিমূর্ত। বর্তমানে পাঠ্যপুস্তকে শুধু একটি দিকেই ফোকাস করতে দেখো গেছে। তা হলো, শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদারতান্ত্রিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা। সুনাগরিক গড়ে তুলতে এটি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত জরুরি, তবে যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন সততা, দায়িত্বশীলতা ও নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষাও। আর সে জন্যই, স্কুলের পাঠ্যবইয়ে বিমূর্ত ধারণার চেয়ে বেশি দরকার সুস্পষ্ট বার্তা ও দিকনির্দেশনা। না হলে, নিজের ভুল কিংবা ঔদাসীন্যের সামনে হয়তো একদিন নিজেরই কান ধরতে হতে পারে ক্ষয়ে যাওয়া সমাজকে।

লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।

মন্তব্য করুন


 

Link copied