আর্কাইভ  শুক্রবার ● ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ● ৬ বৈশাখ ১৪৩১
আর্কাইভ   শুক্রবার ● ১৯ এপ্রিল ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: পলাশবাড়ীতে আসামির ছুরিকাঘাতে বাদীর মৃত্যু, গ্রেফতার ১       মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সন্তান-স্বজনের ভোটে না দাঁড়ানোর নির্দেশ       ভোজ্যতেলের দাম বাড়ল, খোলা তেলে সুখবর       বিএনপি নেতা সোহেলের নিঃশর্ত মুক্তি দাবিতে রংপুরে  মানববন্ধন ও সমাবেশ        খরার ঝুঁকিতে রংপুর অঞ্চল      

 width=
 

রংপুরে ২০৬ বছর ধরে রাজা রামমোহন চর্চা

শনিবার, ২৩ জুলাই ২০১৬, দুপুর ০৩:২৭

আপেল মাহমুদ

রংপুর জেলা প্রশাসকের দপ্তরে চাকরি করেন এমন একাধিক কর্মচারী-কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা যেখানে কাজ করছি সেখানে একসময় জগদ্বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক, ব্রাহ্মধর্ম প্রবর্তক ও আধুনিক ভারত উপমহাদেশের জনক রাজা রামমোহন রায় চাকরি করতেন। চাকরির সুবাদে রংপুরের প্রাচীন শহর মাহিগঞ্জে তিনি বাস করতেন। তাঁর সমাজ-রাষ্ট্র-শিক্ষা ভাবনায় উদ্ভাসিত হয়েছে বিশ্ব। তাই আমরা প্রতিবছর তাঁর জন্ম ও মৃত্যুদিন আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করি।’

২০১১ সালে রংপুর রাজা রামমোহন ক্লাব প্রকাশিত ‘স্মারকগ্রন্থ’ সূত্রে জানা যায়, ১৮০৯ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত মোট ছয় বছর যুগপ্রবর্তক রাজা রামমোহন রায় রংপুর শহরের মাহিগঞ্জে অবস্থান করেন। তিনি যেখানে বাস করতেন সেটি ছিল ছায়াসুনিবিড়। এলাকাটির নাম ছিল বড় রংপুর। এর অদূরেই রয়েছে ছোট রংপুর নামে একটি গ্রাম। ওই গ্রামের বাড়িতে বসেই তিনি কয়েকটি ঐতিহাসিক ফারসি গ্রন্থ রচনা করেন। বিখ্যাত গ্রন্থ বেদান্তের সূচনা করেন মাহিগঞ্জের বাড়িতে বসেই।

উল্লেখ্য, রংপুরের আগে রামমোহন রায় ১৮০৩ সালে ঢাকার জালালপুর কালেক্টরেটে উডফোর্ডের দেওয়ান হিসেবে নিযুক্ত হলেও মাত্র দুই মাস পর পদত্যাগ করেন। রাজা রামমোহন রায় সমাজ থেকে ধর্মীয় হানাহানি বন্ধে সর্বধর্ম সমন্বয়ের ডাক দিয়েছিলেন। এক ঈশ্বরের পৃথিবীতে এত মত ও পথ থাকবে কেন? তাই সবাইকে একত্র হয়ে সমাজ পাল্টে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। একেশ্বরবাদ প্রচার, সহমরণ রোধ, বিধবা বিবাহ, নারীশিক্ষা প্রচলনসহ আরো অনেক যুগান্তকারী পদক্ষেপের মাধ্যমে তিনি নবজাগরণ সৃষ্টি করেন। সেটা তিনি করেছিলেন বাংলাদেশের রংপুর শহরে বসে। তিনি জেলা কালেক্টরেটে চাকরি করার সময় প্রথম একেশ্বরবাদের সন্ধান পান। এক ব্রহ্ম থেকেই তিনি ১৮২৮ সালে সর্বপ্রথম গড়ে তোলেন ব্রাহ্মসভা, যা পরবর্তী সময়ে সমাজে রূপ নেয়।

রাজা রামমোহন রায়ের পথ ধরে পরবর্তী সময়ে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন, দীননাথ সেন, ভাই গিরিশচন্দ্র সেন, কালী নারায়ণ গুপ্ত, ভগবান চন্দ্র বসু, বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, জীবনানন্দ দাশ, বিপিন চন্দ্র পাল প্রমুখ ব্রাহ্মধর্মকে এগিয়ে নিয়ে যান। তাঁরা পালন করেন যুগস্রষ্টার ভূমিকা। সামাজিক কুসংস্কার রোধ করে সর্বধর্ম সমন্বয় করে তাঁরা একটি সুন্দর সুখী সমাজ গড়ে তোলার জন্য আমৃত্যু চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।

প্রবীণ লেখক মোতাহার হোসেন সুফীর লেখা নিবন্ধ সূত্রে জানা যায়, একেশ্বরবাদের এই চিন্তাধারা রাজা রামমোহন রায় রংপুরে থাকাকালীনই অর্জন করেছিলেন। ব্রাহ্মধর্ম প্রবর্তনের আগে তিনি এখানে হিন্দু শাস্ত্রবিদ ও মুসলমান মৌলভিদের সঙ্গে ধর্মীয় আলোচনা ও তর্কের সূত্রপাত করেছিলেন। অনেক সময় তাঁর সঙ্গে স্থানীয় হিন্দু শাস্ত্রবিদদের আলাপ-আলোচনার পর তুমুল বাদানুবাদ ও বাগিবতণ্ডার সৃষ্টি হতো। সন্ধ্যার পর তিনি তাঁর মাহিগঞ্জের বাড়িতে বসে পৌত্তলিকবিরোধী বক্তব্যের পাশাপাশি ব্রহ্মজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তার কথা বলতেন। রংপুরে অবস্থানকালে ১৮১০ সালের ৮ এপ্রিল রামমোহনের বড় ভাই জগমোহন রায় মারা গেলে তাঁর স্ত্রী অলনমনি দেবী সহমরণে যান। লাশের সঙ্গে একটি জীবিত মানুষের করুণ মৃত্যুর বিবরণ শুনে রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা রদ করার দৃঢ় সংকল্প করেন, যা ছিল ব্রাহ্মধর্মের অন্যতম পদক্ষেপ।

১৮১৪ সালে কালেক্টরেট ডিগবি রংপুর থেকে চলে গেলে রাজা রামমোহন রায়ও সেখান থেকে কলকাতা চলে যান। দিল্লির বাদশাহ আকবর তাঁকে রাজা উপাধি দিয়েছিলেন। মূলত তাঁর নির্দেশেই রামমোহন ১৮৩১ সালের ৮ এপ্রিল বিলাতে যান। সেখানে তিনি বাদশাহ আকবরের পক্ষে রাজা চতুর্থ উইলিয়ামের সঙ্গে বৈঠক করেন। বিলাতে থাকাকালে অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি ১৮৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সেখানে মারা যান। ব্রিস্টল শহরের সেলটিন গ্রেভে এই মহান যুগস্রষ্টাকে সমাহিত করা হয়। দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলেও এই মহান সমাজ সংস্কারককে রংপুরের মানুষ ভুলে যায়নি, বিশেষ করে কালেক্টরেটের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এঁদের মধ্যে কালেক্টরেটের সেরেস্তাদার যতীন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে রংপুর শহরের স্টেশন রোডে গড়ে তোলা হয় রাজা রামমোহন রায় ক্লাব ও লাইব্রেরি। তাঁকে সহযোগিতা করেন কালেক্টরেটের কর্মচারী নৃসিংহ নারায়ণ চৌধুরীসহ অনেকে। স্থাপনা নির্মাণের জন্য রাধাবল্লভ মৌজায় ৪০ শতাংশ জমি কেনা হয় এক হাজার ৫০০ টাকায়। ক্লাব-লাইব্রেরিতে ছিল অনেক দুষ্প্রাপ্য ও মূল্যবান বইপুস্তক, জার্নাল ও ম্যাগাজিন। একই সঙ্গে ক্লাব থেকে ‘মিলন’ নামে একটি পত্রিকা বের করা হয় ১৯২৭ সালে। তাতে অবিভক্ত বাংলার অনেক খ্যাতনামা কবি-সাহিত্যিকের লেখা স্থান পেত।

ক্লাব সভাপতি মনোয়ার হোসেনের বিবরণ থেকে জানা যায়, অতীত থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত রংপুর কালেক্টরেটের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রাজা রামমোহনের আদর্শিত পথে চলার চেষ্টা করেন। ক্লাবের পক্ষ থেকে খেলাধুলা, সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা, বিতর্ক প্রতিযোগিতার পাশাপাশি দুস্থ মানুষের সেবা, কন্যাদায়গ্রস্ত বাবাকে সাহায্য-সহযোগিতা, মুমূর্ষু রোগী ও অভাবগ্রস্তদের আর্থিক অনুদান দেওয়া হচ্ছে। ক্লাবের কর্মকাণ্ড শুধু রংপুরবাসীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তির পদচারণে ক্লাবটি ধন্য হয়েছিল। বিভিন্ন সময় ক্লাবে এসেছেন বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, মন্ত্রী স্যার বিজয়প্রসাদ সিংহরায়, কুণ্ডির জমিদার সুরেন্দ্রচন্দ্র রায় চৌধুরী, কারমাইকেল কলেজের অধ্যক্ষ ড. ডি এন মল্লিক, স্যার দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারীসহ অনেকে। ১৩৩৬ বঙ্গাব্দে রামমোহন ক্লাবের আমন্ত্রণে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ রংপুরে আসেন।

তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘রাজা রামমোহন রায়ের বিচিত্র কর্মময় জীবন বিকাশে রামমোহন ক্লাব যে কাজ করছে তা রংপুরবাসীকে উন্নত ও সমৃদ্ধ করবে।’

রংপুরের প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব ও রাজনীতিবিদ সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর অনেক হিন্দু সংগঠক রংপুর ছেড়ে ভারতে চলে গেলে রামমোহন ক্লাবে সাময়িক স্থবিরতা দেখা দেয়। সেই স্থবিরতা কাটাতে রংপুরের বিশিষ্ট নাট্যকার ও নাট্য প্রযোজক মীর আলতাফ আলীর নেতৃত্বে একদল উদারমনা মানুষ এগিয়ে আসেন। তাঁদের কেউ নাটক করেন, কেউ সংগীতশিল্লী, কেউ চলচ্চিত্র-টিভি-বেতার অভিনেতা, কেউবা ক্রীড়াবিদ, সংগঠক। মূলত তাঁদের নেতৃত্বেই রামমোহন ক্লাবটি শহরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আজও।’

একসময় জরাজীর্ণ ও স্যাঁতসেঁতে ঘরে ক্লাবটি চললেও বর্তমানে সেখানে একটি ক্লাব কমপ্লেক্স গড়ে উঠেছে। সেই কমপ্লেক্সে ক্লাব অফিস ছাড়াও রয়েছে লাইব্রেরি, বিনোদন কক্ষ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মিলনায়তন, আধুনিক রেস্টুরেন্ট, বিশ্রাম কক্ষসহ একটি অত্যাধুনিক বিপণিকেন্দ্র। কমপ্লেক্স ভবনে রাজা রামমোহন রায়ের একটি ম্যুরাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কমপ্লেক্স ভবনটির নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ও তাঁর সহধর্মিণী আইভি রহমান। ক্লাবের সদস্যসংখ্যা ২২৯। জেলা প্রশাসক পদাধিকারবলে ক্লাবের উপদেষ্টা। ২৯ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাহী কমিটি ক্লাবটির মুখ উজ্জ্বল রাখতে কাজ করে যাচ্ছে।

মন্তব্য করুন


 

Link copied