আর্কাইভ  শনিবার ● ২০ এপ্রিল ২০২৪ ● ৭ বৈশাখ ১৪৩১
আর্কাইভ   শনিবার ● ২০ এপ্রিল ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: নীলফামারীতে গোপন বৈঠক থেকে জামায়াতের ৩ নেতা গ্রেপ্তার       পলাশবাড়ীতে আসামির ছুরিকাঘাতে বাদীর মৃত্যু, গ্রেফতার ১       মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সন্তান-স্বজনের ভোটে না দাঁড়ানোর নির্দেশ       ভোজ্যতেলের দাম বাড়ল, খোলা তেলে সুখবর       বিএনপি নেতা সোহেলের নিঃশর্ত মুক্তি দাবিতে রংপুরে  মানববন্ধন ও সমাবেশ       

 width=
 

পিতা

সোমবার, ১৫ আগস্ট ২০১৬, সকাল ০৯:৩৭

নাদীম কাদির

সেটা ১৯৭৪ সালের কথা… বাংলাদেশের স্বাধীনতার আড়াই বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। সকাল তখন ৯টা হবে, তারিখটা আমার মনে নেই। ভাই-বোনদের নিয়ে মা বত্রিশ নম্বর সড়কে পৌঁছতেই নিরাপত্তারক্ষী আমাদের পথ আটকালো।

মা প্রবেশের অনুমতিপত্র দেখালে ভেতরে যেতে দেয় তারা। যদিও সেই অনুমতিপত্রটি ছিল ঢাকা সেনানিবাসে প্রবেশের। আমার মা… হাসনা হেনা কাদিরের কাছে তখন ঐ একটি প্রবেশাধিকার পত্রই ছিল। যখনই কোনো নিরাপত্তারক্ষী মার কাছে প্রবেশের অনুমতিপত্র দেখতে চাইতো, মা সেটিই বের করে দেখাতেন। এই বিষয়টি নিয়ে আমরা পরে খুব হাসাহাসি করতাম।

পথে সাদা পোষাকের এক নিরাপত্তারক্ষী আবারও আমাদের আটকায়। আমার মা তাকে বললেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধু’র সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। আমি মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল কাদিরের স্ত্রী।’ একথা জানার পর আমাদের ভবনের নীচতলায় গেস্ট রুমে বসতে দেয়া হলো।

একটা বিষয় আগে জানানো দরকার। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর আমরা উপলব্ধি করেছিলাম, তার নিরাপত্তার পরিমাণ কত কম ছিল। কেননা, তিনি তো শুধু রাষ্ট্রপ্রধানই নন, তিনি ছিলেন জাতির পিতাও। অবশ্য অনেক নিরাপত্তা কর্মকর্তাই বলেছেন, বঙ্গবন্ধু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, কোনো বাংলাদেশি তার ক্ষতি করতে চাইবে না। আর তাই তিনি খুব বেশি নিরাপত্তা পছন্দও করতেন না।

আগস্টের সেই কালরাতে হত্যাকারী যখন বঙ্গবন্ধুকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়, জাতির পিতা তখনও জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘তুমি কি চাও?’ এমনকি সশস্ত্র লোকজন যখন চারিদিকে ছুটোছুটি করছিল তখনও তিনি বিশ্বাস করেননি যে তাকে হত্যা করাই এদের উদ্দেশ্য। বাংলার মানুষের প্রতি তার ছিল এতটাই বিশ্বাস… এতটাই ভালোবাসা।

বঙ্গবন্ধু’র প্রতি আমার বাবারও ছিল শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। মুক্তিযুদ্ধের আগে তিনি গোপনে জাতির পিতার সঙ্গে সাক্ষাতের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এবং বঙ্গবন্ধু’র ডাকেই তিনি যুদ্ধে যোগ দেন। বঙ্গবন্ধু’র প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার এই আবেগটি মার দেয়া শিক্ষার মাধ্যমেও আমাদের উপর প্রতিফলিত হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের ভোরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার খবর যখন বেতারে প্রচারিত হচ্ছিল, সেদিন মা কেঁদে ফেলে বলেছিলেন, ‘এখন কি হবে বাংলাদেশের?’

মুক্তিযুদ্ধে বাবা শহীদ হওয়ায় আমাদের কষ্ট করতে হয়েছে। প্রতিটি মুহুর্তে বাবার শুন্যতা আমরা বোধ করেছি।

সেদিনে আবারও ফিরে যাই, আমরা বঙ্গবন্ধুর দেখা পাই। চিরচেনা পাইপটি তখনও তার হাতে। উপর থেকে তিনি নিচে নেমে আসলেন, আজ যা বঙ্গভবন ভবন হিসেবে পরিচিত। আমার মাকে তিনি গণভবনে অনুসরণ করতে বললেন।

পুরনো গণভবনটি ছিল রমনা পার্কের উল্টোদিকে। সেখানে পৌঁছলে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা মাকে অপেক্ষা করতে নিষেধ করে বললেন, বঙ্গবন্ধু এতোটাই ব্যস্ত থাকেন যে তার সঙ্গে দেখা করা সম্ভব নয়। আমার মা বললেন, যেহেতু বঙ্গবন্ধু এখানে তাকে আসতে বলেছেন, তিনি অবশ্যই দেখা দেবেন।

মার কথাই সত্যি হয়েছিল। আধাঘণ্টার অপেক্ষার পর একজন ভদ্রলোক এসে জানতে চাইলেন, মিসেস কাদির কে! তিনি একটি কক্ষে নিয়ে গেলেন, যেখানে বঙ্গবন্ধু আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। মাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে তিনি বললেন, এসো মা, এসো।

মা তাকে জানালেন, স্বামীকে হারানোর কষ্টের কথা। আরও জানালেন, স্বামীকে হারিয়ে আমাদের নিয়ে কতটা নিরাপত্তাহীনতায় তিনি রয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে এসব কথা বলতে গিয়ে মা সেদিন কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু বাবার ছবি দেখতে চাইলেন। মা তাকে দেখালেন।

তখন আমার কিশোর বয়স। আমার কল্পনাতেও ছিল না, দীর্ঘদেহী এই মানুষটি বাবার ছবি দেখে এভাবে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়বেন। তিনি আমাদের বললেন, প্রয়াত জেনারেল এম এ জি ওসমানী’র সহায়তায় ১৯৬৯ সালে কিভাবে আমার বাবা গোপনে তার সঙ্গে দেখা করেন। জানালেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ে বঙ্গবন্ধুকে সমর্থনের বিষয়টিও।

মার হাত ধরে বঙ্গবন্ধু সেদিন সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, ‘কেঁদো না মা। তিনি সাহসী মানুষ ছিলেন। তার জন্যে তোমার গর্ব হওয়া উচিৎ।’

মা’র অনুরোধে বঙ্গবন্ধু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তার চাকরীর জন্য ড. কামাল হোসেন এবং খন্দকার মুশতাক হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করলেন। এরপর তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকেও মা’র বিষয়টি দেখতে বলেন।

তবে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ায় তা আর হয়ে ওঠেনি। তবে তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতার ইচ্ছে ঠিকই পূরণ করেছেন। তিন দশকেরও বেশি সময়ের পর কাকতালীয়ভাবে তিনি আমাকে লন্ডনে দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু সেদিন আমাকে কাছে টেনেছিলেন। আমার ৩ বছরের শিশু ভাই নওয়িদকে কোলে নিয়ে অনেক আদর করেন। চকলেট খাওয়ার জন্য আমাদের প্রত্যেককে ৫শ’ টাকা করে দেন। বিদায়ের সময় আমরা তার পা ছুঁয়ে সালাম করি। বঙ্গবন্ধু মাকে তখন বলেছিলেন, ‘যে কোনো প্রয়োজনে চলে আসবে। তুমি একা নও।’

দুনিয়ার নির্দয় রূপ দেখে আস্থা, সুখ কিংবা সাহস… সবই হারিয়েছিলেন মা। তবে তার জানা ছিল না, বঙ্গবন্ধুর মতো মহান পিতাকেও আমাদের হারাতে হবে। তিনি হয়তো শারীরিকভাবে আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু এই দেশকে ‘সোনার বাংলা’য় পরিণত করতে আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে তিনি সবসময়ই পাশে রয়েছেন।

তুমি আমাদের মাঝে চিরকাল বেঁচে থাকবে হে পিতা!

নাদীম কাদির : সাংবাদিকতায় জাতিসংঘের ড্যাগ হ্যামারসোল্ড স্কলার এবং লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস মিনিস্টার। nadeemqaadir1960@gmail.com

মন্তব্য করুন


 

Link copied