আর্কাইভ  শনিবার ● ২০ এপ্রিল ২০২৪ ● ৭ বৈশাখ ১৪৩১
আর্কাইভ   শনিবার ● ২০ এপ্রিল ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: নীলফামারীতে গোপন বৈঠক থেকে জামায়াতের ৩ নেতা গ্রেপ্তার       পলাশবাড়ীতে আসামির ছুরিকাঘাতে বাদীর মৃত্যু, গ্রেফতার ১       মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সন্তান-স্বজনের ভোটে না দাঁড়ানোর নির্দেশ       ভোজ্যতেলের দাম বাড়ল, খোলা তেলে সুখবর       বিএনপি নেতা সোহেলের নিঃশর্ত মুক্তি দাবিতে রংপুরে  মানববন্ধন ও সমাবেশ       

 width=
 

ছাত্রলীগের অস্বীকার প্রবণতা একটি রোগ, সমাধান নয়

বুধবার, ৫ অক্টোবর ২০১৬, রাত ০৮:৪৩

প্রভাষ আমিন

যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে, তাতে আশপাশে অনেক মানুষের উপস্থিতি স্পষ্ট। কয়েকজনকে দেখা যায়, অনেকের চিৎকার শোনা যায়। কেউ কেউ ‘ও মাই গড, ও মাই গড’ চিৎকার করছিলেন। কিন্তু কেউ মেয়েটিকে বাঁচাতে এগিয়ে যায়নি। ঘটনাটি ঘটেছে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে। দর্শকরা সবাই কলেজের শিক্ষার্থী। তারা যদি এগিয়ে না যায়, তবে কারা যাবে?

শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীরাই আক্রমণকারী পশুটিকে ধরে গণধোলাই দিয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। সিলেট মহিলা কলেজের ছাত্রী খাদিজা আক্তিার নার্গিস এখন ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। জটিল অপারেশন শেষে নার্গিস এখন ৭২ ঘণ্টার পর্যবেক্ষণে। ডাক্তাররাই বলে দিয়েছেন, তার বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে অনেকে অনেক বিপ্লবী মন্তব্য করছেন। এই করা উচিত ছিল, সেই করা উচিত ছিল। হয়তো কাল যারা দর্শক ছিল, তারাও অনেক বড় বড় কথা বলছেন। এই ‘হেন করেঙ্গা, তেন করেঙ্গা’য় আমরা অনেক এক্সপার্ট। নিরাপদ দূরত্বে বসে, বাসার আয়েশে বসে ফেসবুকে বিপ্লব করতে অনেক পারি। কিন্তু ঘটনাস্থলে আমরা নিরাপদ দূরে থাকতেই ভালোবাসি।

যারা ফেসবুকে বিপ্লব করছি, ঘটনাস্থলে থাকলে, তারা কী করতাম? আমার অনেক সন্দেহ আছে। কারণ একই রকমের ঘটনা আমরা অনেক দেখেছি। পুরান ঢাকায় ছাত্রলীগের হামলায় দর্জি কর্মী বিশ্বজিতের নির্মমহত্যার ঘটনা নিশ্চয়ই আপনারা কেউ ভুলে যাননি। সবাই দূর থেকে জুম করে ছবি তুলতে পারি।

পত্রিকায় পড়েছি, হামলাকারী বদরুল আলম আক্রান্ত খাদিজা বেগম নার্গিসের বাসায় লজিং থাকতো। তার সাথে নাকি ছয় বছরের প্রেমের সম্পর্কও ছিল। নার্গিস ইদানিং আর বদরুলকে পাত্তা দিচ্ছিল না। তাই ক্ষোভ থেকে বদরুল হামলা চালিয়েছে। আমার ভাবতে অবিশ্বাস্য মনে হয়, যাকে ভালোবাসা যায়, তাকে কিভাবে এমন নৃশংসভাবে হামলা করা যায়, মেরে ফেলার চেষ্টা করা যায়? এ কেমন ভালোবাসা? বদরুলের এত সাহস কোত্থেকে এলো, কোত্থেকে?

প্রথমত সে একজন পুরুষ। সব পুরুষই নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। কোনো নারী তাকে উপেক্ষা করবে, এটা কোনো পুরুষই মানতে পারে না। তবে বদরুলের সাহসের মূল উৎস ছাত্রলীগ। বদরুল সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক। আমার ধারণা এই দাপটই তাকে প্রকাশ্য দিবালোকে এমন নির্মমতায় উদ্বুদ্ধ করেছে।

নার্গিসকে দেখতে স্কয়ার হাসপাতালে ছুটে গেছেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসাইন। দেখে আমরা আশান্বিত হয়েছিলাম। যাক ছাত্রলীগ নেতারা আহত এক ছাত্রীর পাশে দাঁড়াতে ছুটে গেছে। কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে তিনি সাংবাদিকদের কাছে যে দাবি করেন, তা আমাদের সকল আশায় জল ঢেলে দেয়। না, ছাত্রলীগ বদলায়নি।

জাকির হোসাইন জানিয়ে দেন, বদরুল ছাত্রলীগের কেউ নয়। তার যুক্তি হলো, বদরুল সুনামগঞ্জের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করে। আর ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নিয়মিত ছাত্ররাই কেবল ছাত্রলীগ করতে পারে। কেউ কোনো পেশায় জড়ালে তাৎক্ষণিকভাবে তার পদ চলে যায়। কিন্তু ছাত্রলীগ সাধারন সম্পাদকের এই দাবি ধোপে টেকে না।

কারণ বদরুল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের নিয়মিত ছাত্র এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক। এই পশুটি যেই কমিটির সহ-সম্পাদক, সেই কমিটি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অনুমোদন করেছে গত ৮ মে। মাত্র পাঁচ মাস আগে করা কমিটির একজন সহ-সম্পাদক এরই মধ্যে শিক্ষকতা করে সংগঠনের পদ হারালেন! এই দাবি বিশ্বাসযোগ্য নয়।

বদরুলের গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পাশাপাশি বদরুল তার এলাকার একটি স্কুলে পার্টটাইম শিক্ষকতা করতো এবং সেটা ২০১৪ সাল থেকেই। তার মানে শিক্ষকতা শুরুর দুই বছর পর তাকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক করা হয়েছে। তাহলে এতদিন সেটা নেতাদের নজরে পড়েনি কেন? নার্গিসের ওপর হামলার আগে তো তাকে বহিস্কারও করা হয়নি। তাই ঘটনা ঘটার পর এখন বদরুলকে অস্বীকার করলেও সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না।

আর এই বদরুল গত ঈদুল আযহায়ও নিজেকে ছাত্রলীগ নেতা পরিচয় দিয়ে সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছে। তার ঈদ শুভেচ্ছায় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারন সম্পাকের ছবিও আছে। সেই কার্ডে সে নিজেকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ‘সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি’ বলে দাবি করেছে। এই দাবিকে ভিত্তিহীন দাবি করে ছাত্রলীগ নেতা কর্মীরা বলছেন, এই নামে ছাত্রলীগে কোনো পদ নেই। তাই সে ছাত্রলীগের কেউ নয়।

কমিটিতে মুহাম্মদ বদরুল আলমের পদের নাম ‘সহ-সম্পাদক’। আর সহ-সম্পাদকদের তালিকায় তার নাম এক নম্বরে। তাই সে নিজের পদকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছে ‘সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি’। এটা তার অজ্ঞতা হতে পারে। কিন্তু এই অজুহাতে, সে ছাত্রলীগ নয়, এই দাবি করে পার পাওয়া যাবে না। তারপরও আমি যদি ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদকের দাবি মেনে নেই, তাহলেও সে সদ্য সাবেক ছাত্রলীগ নেতা। তার মানে এখনও সে ছাত্রলীগের আদর্শ ধারণ করে। তাই তার অপরাধের দায় অস্বীকার করার সুযোগ ছাত্রলীগের নেই।

অস্বীকার প্রবণতা অবশ্য ছাত্রলীগের অনেক পুরোনো রোগ। যখনই কোনো কিছু ঘটে, প্রথম কাজ হলো অস্বীকার করা। তাও না পারলে নামকাওয়াস্তে বহিস্কার করা। কিন্তু অতীতে দেখা গেছে, কাগজে-কলমে বহিস্কার করা হলেও অপরাধীরা ছাত্রলীগের ছায়াতলেই থাকে। এটা ঠিক, বদরুল যা করেছে, তার সাথে সাংগঠনিকভাবে ছাত্রলীগের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা একান্তই তার ব্যক্তিগত সমস্যা।

সারাদেশে বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিতে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর নাম আছে। তাদের সবাইকে মনিটর করা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পক্ষে সম্ভব নয়, সেটা আশা করাটাও ভুল। তাই সারা দেশের সব নেতা-কর্মীর অপকর্মের দায় ছাত্রলীগকেই নিতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। তবে অস্বীকার করে পার পাওয়া যাবে না। সাহসের সাথে দায় স্বীকার করে ব্যবস্থা নিতে হবে।

তবে ছাত্রলীগের নেতৃত্বকে আরেকটা বিষয় গভীরভাবে ভাবতে হবে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নিজেদের এমন সর্ব ক্ষমতাময় মনে করে কেন? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে সেটা সমাধান করলেই, সমস্যা মিটবে। নইলে কদিন পরপরই ছাত্রলীগ নেতৃত্বকে এমন অস্বীকার করতে হবে। কিন্তু ছাত্রলীগ নেতাদের এই অস্বীকার রোগ মানুষের মধ্যে কোনো সহানুভূতি জাগায় না, বরং তাদের হাস্যকর করে তোলে।

ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা যেন নিজেদের দেশের মালিক মনে না করে, সেটা আগে নিশ্চিত করতে হবে। তাদের মনোজগতে পরিবর্তন আনতে হবে। অনেকে বলছেন, বদরুলকে আটক করে যারা গণধোলাই দিয়েছে, তারাও এমসি কলেজের ছাত্রলীগের কর্মী। বিলম্বে হলেও যারা বদরুলকে আটক করেছে সেই ছাত্রলীগ কর্মীদের জন্য অভিনন্দন। আর ছাত্রলীগ নেতা বদরুলের জন্য ঘৃণা। তার কঠিন ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এখন গণদাবি।

কয়েকদিন আগে খোদ রাজধানীতে এক বখাটের হামলায় প্রাণ গেছে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ছাত্রী রাইসার। রাইসা বা নার্গিসের মত অমন নির্মমতার শিকার হয়তো সবাই হন না, তবে বাংলাদেশে নারীরা মোটেই নিরাপদ নয়। পদে পদে, পথে পথে প্রতিদিন তাদের নানা নির্মমতার শিকার হতে হয়, হেনস্থার শিকার হতে হয়। কাউকে হয়তো শিষ শুনতে হয়, কাউকে অশ্লীল বাক্য শুনতে হয়, কারো ওড়না ধরে টান দেয় কোনো বখাটে, বাসে ফিরতে নারীরা প্রতিদিন কত অশ্লীলতার শিকার হয়, তার খবর আমরা ক’জন রাখি। কখনো দৃষ্টিতে অশ্লীলতা, কখনো শারীরিক আক্রমন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীরা নিরবে সয়ে যান। বাসায় ফিরে মুখ লুকিয়ে কাঁদেন। দিন এসেছে প্রতিবাদ জানানোর, রুখে দাড়ানোর।

নার্গিসের মাথার একটি ছবি আমি দেখেছি। সেই ছবিটি কোনোদিন কাউকে দেখাতে পারবো না। দেখেই বোঝা যায়, মেয়েটির বাঁচার সম্ভাবনা সত্যি ক্ষীণ। তবুও তো বিশ্বে অনেক মিরাকল ঘটে। গোটা Provash ameenজাতির প্রার্থনায় আবার ফুটুক আমাদের প্রিয় বোন নার্গিস।

০৫ অক্টোর, ২০১৬

লেখক : সাংবাদিক, কলাম লেখক। probhash2000@gmail.com

মন্তব্য করুন


 

Link copied