ফারদিন ফেরদৌস
আমার মানবজন্ম, পুরুষজন্ম সর্বাংশে বৃথা। বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই আমার। বিচারহীনতার যে সংস্কৃতিকে বাড়তে বাড়তে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন করে তুলছি আমরা, সেই দানব আমাদের মায়েদের-মেয়েদের ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছে। রাষ্ট্র নির্বিকার বলে, নির্বোধ বলে, অসার অনুভূতিপ্রবণ বলেই এমনটা হচ্ছে!
পার্বতীপুরের পূজা, আমাদের কখনো ক্ষমা করবি না তুই; আর মাতৃরূপে এই ভূমিতে জন্মানোর কথা কল্পনাতেও আনবি না কোনোদিন! এই গ্রাম, শহর, নগর, অলিগলি আর এখানকার শাসন, কানুন আর অধিকার কেবল শ্বাপদ পুরুষের। নিষ্পেষণ, নিপীড়ন, শোষণ, অপমান আর বঞ্চনা মায়েদের দুর্ভাগ্যলিপি। এখানে কাপুরুষরা মায়ের জঠর থেকে জন্মায়নি, ওদের বেজন্ম এক পাপগ্রস্ত অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে। তাই ওরাই থাক এই রাষ্ট্র আর রাজনীতি নিয়ে। মানবিক বোধসম্পন্ন আর বিবেকবান মানুষদের ভবলীলা সাঙ্গ হোক।
মহান ঈশ্বরের অশেষ কৃপায় আমি এক লক্ষ্মীছানা কন্যাসন্তানের জনক। কেবল কৈশোরে পা দেবে ও। এই মাকে আমার চৌদ্দপুরুষের হাজার পুণ্যের ফল হিসেবে ঈশ্বরের অফুরান আশীর্বাদ বলেই মানি ও জানি। কিন্তু কোনো রাতেই ঠিকঠাক ঘুমাতে পারি না, মায়ের নিরাপত্তা চিন্তায়। এই বুঝি অন্ধকারের বাসিন্দা অপুরুষ হায়েনারা ঘরের শিকল ভেঙে ঢুকে পড়ল! এই বুঝি মৃত্যুবৎ ভয়ংকর বীভৎস সর্বনাশ হানা দিলে আমার দ্বারে! দিনে কাজে থাকলেও মন বসাতে পারি না; মেয়েটি আমার কাপুরুষের নখর থাবার ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে সুস্থ-স্বাভাবিক আছে তো? বিদ্যালয়ের পাঠ শেষে ঘরে ফিরতে পারছে তো!
মনে পড়ে যায়, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার পূর্ণিমা রানী শীলের কথা। রাজনীতির উল্লম্ফনের কালে একদা ওর ওপর নেমে এসেছিল নরক-যন্ত্রণা। ১০/১১ জনের সারমেয় দলটাকে ওর মায়ের অনুরোধ করতে হয়েছিল—বাবারা, আমার মেয়েটা খুব ছোট, তোমরা একজন একজন করে এসো, ও মরে যাবে! এ কথা যতবার ভাবি, নিমেষে পূর্ণিমার বেদনাতুর মা হয়ে উঠি আমি।
বিশ্বাস করি, রোজকার খবর দেশের পরিচালকদের দৃষ্টি এড়ায় না। জানি, নানা কিসিমের অনুভূতির পসরা নিয়ে রাজনীতির সওদা করতে হয় তাঁদের। যে কারণে তনু যায়, খাদিজা আসে, রিশা আসে, তারপর যাকে পুষ্পাঞ্জলিতে পূজা করার কথা, সেই শিশু পূজা আসে। এই যে আসা-যাওয়ার দোলদোলানো খেলা চলছে। একটি ক্ষত না শুকোতেই আরেকটি ক্ষতের জন্ম। সব আক্রোশ জমা করা হয় নারীর জন্য। তবে যে শোনানো হয়, নারীর অধিকার সমুন্নত করার হাজারো গল্পের বলিহারি! সেসব তবে মিথ্যা গপ্প? সেসব তবে অলীক কথন? হবে হয়তো।
যেখানে বিচারের মানদণ্ড নির্ণায়ক হিসেবে অনুভূতিকে বাটখারা নির্ধারণ করা হয়, সেখানে এমন করেই ঘটনারা ঘটে যাবে। পার্টি অনুভূতি, বাহিনী অনুভূতি বা ক্ষমতাবান অনুভূতিরা যত দিন সজীব আছে, তত দিন নারীকে অপমানের পাপ থেকে কারো মুক্তি নেই। আমরা দুদিন চিৎকার করব, কদিনের জন্য রাস্তায় নেমে নেমে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরব, অবশেষে ঘরে বসে ব্যর্থ মনোরথে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদব। তারপর কান্নার জল শুকোতে না শুকোতেই আরেকটি পূজার ট্র্যাজেডি পত্রিকা বা টেলিভিশন সংবাদের টপলাইন হবে, এই তো। রাজনীতি আর ভাষণ কিন্তু চলবে। যেমনটা এতকাল চলে এসেছে।
এই সময়টা তো একাত্তর সাল না, এখানে স্বাধীনতা যুদ্ধও হচ্ছে না। এখানে হায়েনারূপী পাকিস্তানি মিলিটারিদেরও তাণ্ডব চলছে না। তবে যে এই সময় ধর্ষণের ক্রমবর্ধমান আস্ফালনের মধ্য দিয়ে মায়েদের সম্ভ্রম বিনষ্টির মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটে চলেছে; তার বিচার করবে কারা?
কে ধর্ষণ করছে না? মসজিদের ইমাম, শিক্ষক বা অন্য পেশাজীবী কিংবা সাধারণ মানুষ। দেশের সোশ্যাল মিডিয়াগুলো ঘাঁটলেই দেখা যায়, অনেকেই খুব গলা চড়িয়ে ওয়াজ ফরমান করছেন, নারীরা বেপর্দা হয়ে ঘুরে বেড়ায় তাই এত ধর্ষণ। কিন্তু মুসলিম রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে ভ্রমণপিয়াসীদের জন্য নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পোশাকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা আছে। কখনো শুনেছেন, সেখানে কোনো কাপুরুষ স্বল্পবসনা নারীর ওপর হামলে পড়ে?
পুরুষের চোখ আর লালসায় যে আসল গণ্ডগোল, তা ‘তেঁতুল হুজুর’দের মতো ধর্মান্ধদের কথায় আসে উঠে না। এমনকি বাংলাদেশের ৯০ ভাগ ধার্মিক পুরুষের ধারণাও ওই ধর্মান্ধদের মতোই। যাঁরা বক্তৃতা করেন, হে যুবক স্বর্গে তোমার জন্য শরাব আর সুন্দরী নারী উপহার রয়েছে, তাঁদের লকলকে জিভ সবার আগে সামলানোর সময় এটাই। নারীবাদ বিধ্বংসে, নারীকে ভোগের সামগ্রী মনে করে বদ্ধ ঘরের পুতুল বানাতে ধর্মকে যাঁরা পরমাণু বোমা বানাচ্ছেন, আপনাদের ঈশ্বরের দোহাই লাগে, এবার অন্তত বলুন ধর্ষণের জন্য পুরুষের কুপ্রবৃত্তি দায়ী। নারীর দায় এখানে স্রেফ গৌণ। সৌন্দর্য বা আকৃষ্ট হওয়ার মতো উপাদান পুরুষেরও নারীর সমান। কোথায়, নারী তো ধর্ষিণী না, সে কেবলই ধর্ষিতা।
ধর্ষণকে এক ধরনের রোগই বলব। এই রোগের উৎপত্তি পিতৃতান্ত্রিকতা বা পুরুষতান্ত্রিকতার অহংকার থেকে উদ্ভূত। সবার আগে পুরুষবাদিতার ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ হয়ে ওঠার সাধনা করুন। ধর্মচর্চার পাশাপাশি সংস্কৃতিবান হোন, শিল্পকলার জ্ঞান নিন, সাহিত্যপাঠে মন দিন; বিশ্বমানুষ হয়ে ওঠার মন্ত্রে দীক্ষা নিন। হীনমন্যতা, কপটতা বা কূপমণ্ডূকতা দূরে ঠেলে উদারতাকে আহ্বান জানান। সুন্দরকে করুন আপনার সখা।
একবার ভাবুন, ধর্ষিত হওয়া নারীর জন্য মৃত্যুর থেকেও মারাত্মক। নারীর পেটে জন্মগ্রহণ করে আপনার লালসার আগুনে সেই নারীর জীবনের ভিত্তিকে ধসিয়ে দেবেন না; গভীরতম অন্ধকারে নিপতিত করবেন না তাকে।
পৌরাণিককালে দেবতারা ধর্ষণকে তাদের রুটিনওয়ার্কে পরিণত করেছিল। এখন তো সেই যুগ না। আমরা তো নিজেদের মানুষরূপেই পরিচয় দিই। তারপরও ধর্ষণ কেন মড়করূপে দেখা দিল এই দেশে? আমরা আর কতকাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ধর্ষণপ্রবণ সমাজরূপে নিজেদের পরিচয় দেব? লজ্জার মাথা আর কতকাল ভক্ষণ করতে থাকব? নারীর সম্ভ্রমে আর কত অসম্মানের জল গড়ালে তাকে আমরা রক্তগঙ্গা বলব?
রাষ্ট্র ঘুমিয়ে থাকুক, জীবনদেবতার শাস্তিকে যদি এড়াতে চাই, তবে নীরবতা নয়, দ্রোহ আর প্রতিবাদী মিছিলে মুক্তি পাক আত্মোপলব্ধির সত্য ও ন্যায়ের পথ। আর নোবেলজয়ী জার্মান সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাসের আত্মোপলব্ধিটা রাষ্ট্রযন্ত্রের, আমার, আপনার আর বিশ্বপুরুষের হোক :
This General silence on the facts
Before which my own silence has bowed
Seems to me a troubling lie
And compels me towards a likely punishment
অর্থাৎ
এই যে গণ নীরবতা—তার কাছে মস্তক লুটিয়েছি আমিও
একটা অনিষ্টকর মিথ্যার কাছে সেজদা করেছি যেন
আর সেই মিথ্যা আমাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে চলেছে অনিবার্য এক শাস্তির দিকে!
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।