আর্কাইভ  শুক্রবার ● ২৯ মার্চ ২০২৪ ● ১৫ চৈত্র ১৪৩০
আর্কাইভ   শুক্রবার ● ২৯ মার্চ ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: রংপুর বিভাগ থেকে ২০ বছরে ২ লাখ ২৭ হাজার কর্মী বিদেশ গেছেন       দিনাজপুরে ছিনতাইকৃত মালামাল উদ্ধারসহ ছিনতাইকারী চক্রের দুই সদস্য গ্রেপ্তার        জমি রেজিস্ট্রি করে না দেয়ায় বাবাকে কবর দিতে ছেলের বাঁধা ॥ পুলিশের হস্তক্ষেপে দাফন       নীলফামারীতে স্বামীর প্রথম বিয়ের খবরে নববধূ দ্বিতীয় স্ত্রীর আত্মহত্যা ॥ স্বামী গ্রেপ্তার       রংপুরবাসীর জন্য সরকারি চাকরি, পদ ১৫৯      

 width=
 

রাজশাহীর মুসা রাজাকারের অপরাধ তদন্তে ট্রাইব্যুনাল

মঙ্গলবার, ১০ জানুয়ারী ২০১৭, দুপুর ০৪:২৫

এর অংশ হিসেবে সোমবার দিনভর এলাকায় ঘুরে ঘুরে তদন্ত করেন আর্ন্তজাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত দলের সদস্যরা। তদন্ত দলের কর্মকর্তা ও আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের পরিদর্শক ফারুক হোসেন জানান, এর আগে গত ২৭ জুলাই রাজশাহীর সার্কিট হাউসে এ ঘটনার সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। এবার ঘটনাস্থল ঘুরে তদন্ত করা হচ্ছে।

তদন্তের প্রথম দিন বাঁশবাড়িয়া, পশ্চিমভাগ, আটভাগ, ধোকরাকুল ও গোটিয়া গ্রামে পরিদর্শন করে সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। সাক্ষ্য দিয়েছেন মুসার হাতে নিহত বাঙালি ও আদিবাসীদের স্বজনরা। আরও কয়েকদিন ধরে সরেজমিন তদন্ত করা হতে পারে বলেও জানান ট্রাইব্যুনালের পরিদর্শক ফারুক হোসেন।

তিনি জানান, তার দলে সহকারী তদন্ত কর্মকর্তা নাজমুল হোসেনসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা আছেন। স্থানীয় ভুক্তভোগি পরিবারগুলোর কাছে একাত্তরের ঘটনার বিবরণ শোনা হচ্ছে। এতে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে, মুসা একজন যুদ্ধাপরাধী এবং মানুষ হত্যাকারী। তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ গঠন প্রয়োজন।

স্থানীয় প্রবীণ এলাকাবাসীর বর্ণনা ও অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬৪ সালে বাঁশবাড়িয়া গ্রামের আদিবাসীদের সঙ্গে জমি বিনিময় করে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘী থানার ইসলামপুর গ্রামের আব্বাস আলীর ছেলে মুসা ও তার নিকট আত্মীয়দের নিয়ে পুঠিয়ায় এসে বসবাস শুরু করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুসার বয়স ছিল ২০ থেকে ২২ বছর। ওই বয়সেই মুসা পাকিস্তানের পক্ষে এলাকার যুবকদের নিয়ে একটি দল গঠন করেছিলেন। তার নেতৃত্বে এ দল এলাকায় নানা অপরাধমূলক কর্মকা- চালায়।

একাত্তরের ১২ এপ্রিল পাকহানাদার বাহিনী পুঠিয়া আক্রমণ করে মানুষ হত্যা ও অগ্নিসংযোগ শুরু করলে মুসা হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। সে ১৯ এপ্রিল ৩০-৪০ জন হানাদার বাহিনী নিয়ে যায় বাঁশবাড়িয়া গ্রামে। সেখান থেকে তারা ২১ জনকে আটক করে। তাদের নিয়ে রাখা হয় গোটিয়া গ্রামের স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল ইসলামের বাড়িতে। সেখানে দিনভর নির্যাতন করে ১৭ জনকে ছেড়ে দেয়া হয়। আর চারজনকে হত্যা করা হয়। আটককৃতদের মধ্যে একজন ছিলেন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র নূরুল ইসলাম। বর্তমানে তিনি বাঁশবাড়িয়া বাজারে পল্লী চিকিৎসক হিসেবে ওষুধ বিক্রি করেন।

তিনি জানান, তার সঙ্গে বাবা ইসমাইল হোসেন, বড় ভাই আকরাম আলীকেও আটক করা হয়েছিল। সারাদিন নির্যাতন করে রাত ১০টায় তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। সেখানে গুলি করে হত্যা করা হয় চারজনকে।

রাফিয়া বেগমের অভিযোগের প্রেক্ষিতে ও নূরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুর্গাপুরের নমিক ফকিরের ছেলে মফিজ উদ্দিন, পুঠিয়ার গোটিয়া গ্রামের মানিক সরদারের দুই ছেলে জাফর আলী ও আদম আলী এবং শুকদেবপুরের মেরা হাজীর ছেলে সিরাজ উদ্দিনকে মুসা চোখ বেঁধে লাইনে দাঁড় করিয়ে দেয়।

পরে সে হানাদার বাহিনীকে জানায়, এরা পাকিস্তানের শত্রু মুক্তিযোদ্ধা। তখন তার নির্দেশে তাদের গুলি করা হয়। এরপর তারা মাটিতে পড়ে ছটফট করতে থাকলে মুসা তাদের হাত পায়ের রগ কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করে। এরপর মুসার নির্দেশে পশ্চিমভাগ মাদ্রাসার সামনে গুলি করে হত্যা করা হয় আক্কেল আলীর ছেলে আবদুস সাত্তারকে। পরে মুসা পশ্চিমভাগ সাঁওতালপাড়ার গিয়ে ধর্ন্যাঢ্য আদিবাসী লাডে হেমব্রমের বাড়িতে গিয়ে অগ্নিসংযোগ করে লুটপাট করে। মুসা নিজেই তরবারি দিয়ে হেমব্রমকে হত্যা করে। এরপর হানাদার বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে মুসা হত্যা করে মংলা সরেনের ছেলে জটু সরেন ও মুন্সি মার্ড্ডির ছেলে টুনু মার্ডিকে। এরপর পুঠিয়া-তাহেরপুর সড়কে এসে মুক্তিযোদ্ধা বহনের অভিযোগ এনে হত্যা করা হয় ধোকড়াকুল গ্রামের নেসু শাহ’র ছেলে টমটম চালক রহমত শাহকে। এরপর হানাদার বাহিনী তাহেরপুরে চলে গেলে মুসা বাঁশবাড়িয়া এলাকায় অবস্থান নেয়।

নিহত বাঙালি ও আদিবাসীদের দেখতে এলে মুসা নিজের তরবারি দিয়ে বাঁঁশবাড়ি পশ্চিমভাগ গ্রামের ইব্রাহিম সরকারের ছেলে ইসমাইল সরকার, গফুরের ছেলে বদিউজ্জামান, বছিরের ছেলে ঝড়– ওরফে কালাকে হত্যা করে। মুসার হাতে নিহত ইসমাইল সরকারের ছেলে আনেস সরকার বাবার জন্য কাফনের কাপড় আনতে গেলে মুসা তাকেও রাস্তার ওপর তরবারি দিয়ে হত্যা করে। এসব ঘটনার পর দেশ স্বাধীন হলে মুসা রাজাকার পরিবার ও সহযোগীদের নিয়ে ভারতে চলে যায়। তার এই বাঙালি ও আদিবাসী নিধনে পাক আর্মির সঙ্গে সহযোগি ছিল বর্তমানে ভারতের মুর্শিদাবাদ প্রবাসী আবদুল খালেক, আবদুল হামেদ, সাদ আক্কাস, দেল মোহাম্মদ, সলেমান খলিফা ও দেদার আলী।

মঙ্গলবার সকালে সরেজমিনে গেলে বাঁশবাড়িয়া আদিবাসী পল্লীর বধুরাই সাধু মার্ডি বলেন, ‘একাত্তর সালে আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তাম। মুসার নেতৃত্বে আমার চোখের সামনে আমার দাদা টুনু মার্ডি, নানা জটু সরেন, মামা কানু হাজদা ও প্রতিবেশী দাদা লাডে হাজদাকে হত্যা করা হয়। মুসা তলোয়ার দিয়ে তাদের হত্যা করে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।’

পুঠিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য জিল্লুর রহমান বলেন, ‘একাত্তর সালে আমার বয়স ছিলো ১১ বছর। আদিবাসী পল্লীর পাশেই আমাদের জমিতে শ্রমিকের জন্য খাবার নিয়ে আসি। তখন দেখতে পাই মুসা রাজাকার তলোয়ার নিয়ে দৌড়ে এসে চান্দু সরেন নামের একজনকে জবাই করে হত্যা করছে। তারপরে শুনতে পেয়েছি, সে অনেক গ্রামে আগুন দিয়েছে। অনেককে হত্যা করেছে।’

উল্লেখ্য, একাত্তর সালে বাঙালি ও আদিবাসী হত্যা ও লুটপাটের পর দেশ স্বাধীন হলে মুসা রাজাকার ভারতে পালিয়ে যায়। এরপর ৭৫ সালে গোপনে দেশে ফিরে আদিবাসী পল্লীর ১৫২ বিঘা জমি দখলের চেষ্টায় অপতৎপরতা শুরু করে। মুসা এখন এলাকার প্রভাবশালীদের একজন। ভুক্তভোগি পরিবারের সদস্যরা বলছেন, মুসার বিচার দেখতে পেলে তারা মরেও শান্তি পাবেন।

মন্তব্য করুন


 

Link copied