মুহম্মদ জাফর ইকবাল
শুধু যে ছেলেমেয়েরা ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন নিয়ে মাতামাতি করছে তা নয়, ছেলেমেয়েদের বাবা-মায়েরাও একই আগ্রহ ও উৎসাহ নিয়ে নির্লজ্জের মতো ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন নিয়ে ছোটাছুটি করছেন। রাত জেগে ফেসবুক থেকে ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন নামিয়ে আনছেন, পরিচিত মানুষজন শিক্ষকদের দিয়ে তার সমাধান করিয়ে আনছেন, তারপর ছেলেমেয়েদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। একজন কিশোর কিংবা কিশোরী দেখছে তার বাবা-মায়েরা আসলে দুর্বৃত্ত। আমি জানি না, তারা অবাক হয়েছিল কিনা, অনেকে হয়তো হয়েছে। অনেকে হয়তো বাবা-মায়ের এই অপরাধের সাথী হয়নি, একরোখা তেজস্বী হয়ে সৎ থেকেছে। কিন্তু আমি জানি অনেক শিশু সেটা পারেনি, তারা এই অসততার ভাগী হয়েছে। তারা মেনে নিয়েছে, আজীবন বাবা-মাকে ঘৃণা করে করে একটা অন্যায় জীবন শুরু করেছে। এটা হওয়ার কথা ছিল না, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এই দেশে এই ঘটনাটি ঘটিয়েছে। হাজার হাজার পরিবারের কোমল ভালোবাসার বন্ধনটিকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে।
প্রশ্ন ফাঁসের কারণে যারা সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছে তারা হচ্ছে এ দেশের সোনার টুকরো ছেলেমেয়েরা যারা পণ করেছে তারা অন্যায় করবে না, অপরাধ করবে না। প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার পরও তারা সেই প্রশ্ন দেখেনি, নিজের কাছে সৎ থেকেছে এবং দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। তাদের সেই দীর্ঘশ্বাস আমি মাঝে মাঝে শুনতে পাই, আমি তাদের কী বলে সান্ত্বনা দেব বুঝতে পারি না। তারা গভীর এক ধরনের হতাশা নিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে তাদের চার পাশে অন্যেরা নির্বিকারভাবে ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন নিয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে, যাদের পরীক্ষার ফলাফল হয়তো অনেক ভালো হবে। জোর করে সৎ হয়ে থাকা ছেলেমেয়েরা এক ধরনের বিস্ময় এবং হতাশা নিয়ে আবিষ্কার করছে যে তারা নিজ হাতে নিজেদের ভবিষ্যতের জীবনটিকে অনিশ্চিত করে দিচ্ছে। এই দেশে পরীক্ষার ফলাফল ভালো না হলে ভবিষ্যতের দরজা একটা একটা করে বন্ধ হয়ে যায়। ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন না দেখে তারা হয়তো দুর্বৃত্তদের জন্য দরজা খোলা রেখে একজন একজন নিজেদের ভবিষতের দরজাগুলো বন্ধ করে পেছনে সরে এসেছে। তাদের সেই গভীর হতাশা আর তীব্র ক্ষোভের সামনে এসে দাঁড়ানোর সাহস কার আছে? জীবনের শুরুতে তারা অবাক হয়ে দেখেছে এ দেশটি দুর্বৃত্তদের দখলে, তাদের পাশে কেউ নেই। আমরা কেমন করে তাদের সান্ত্বনা দেব, সাহস দেব, ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাব? পৃথিবীর আর কোনো দেশে কী এরকম উদাহরণ আছে যেখানে একটি রাষ্ট্র এত পূর্ণাঙ্গভাবে একটা শিক্ষা ব্যবস্থার ভিতটা ভেঙে শিক্ষার্থীদের অপরাধী হিসেবে বড় করে তোলে।
২০১৪ সালেও আমি প্রশ্ন ফাঁসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলাম। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেছি, রেডিও-টেলিভিশনে চেঁচামেচি করেছি এমনকি একদিন প্রতিবাদ করে শহীদ মিনারে বসেও থেকেছি। আমার সঙ্গে স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির কিছু ছেলেমেয়ে ছিল, আমার পরিচিত কিছু বন্ধুবান্ধব ছিল এবং টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিকরা ক্যামেরা নিয়ে এসেছিল। তখন আমি প্রথমবার আবিষ্কার করেছিলাম যে আমার এই হাস্যকর ছেলেমানুষী প্রতিবাদে এই দেশের বড় বড় শিক্ষাবিদেরা নেই। সবাই আমার মতো প্রতিবাদ করার জন্য বৃষ্টিতে বসে ভিজবে আমি সেটা মোটেও আশা করি না কিন্তু পত্রপত্রিকায় একটু লিখবেন, রেডিও টেলিভিশনে বক্তব্য দেবেন, আমি অন্তত সেটা তো আশা করতে পারি। সেটা ঘটেনি। আমার মনে আছে, শিক্ষা সংক্রান্ত ব্যাপারে এই দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষকে আমি সিলেট থেকে ফোন করে কিছু একটা করার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন বিষয়টা নিয়ে একটা সেমিনারজাতীয় কিছু করবেন, সমস্যাটা নিয়ে আলোচনা করবেন। আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত কিছু করলেন না।
এখন ২০১৭ সাল। আবার হুবহু একই ব্যাপার ঘটতে শুরু করেছে। এই দেশের কিছু তরুণ ছেলেমেয়ে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে কিনা তার দিকে তীক্ষè দৃষ্টিতে নজর রাখছে। প্রতিবার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিচ্ছে। শুধু তাই নয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদমাধ্যম ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নগুলো পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের পাশাপাশি ছাপিয়ে একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে কিন্তু তারপরও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অবস্থাটা পুরোপুরি বুঝতে পারি। প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে সেটা মেনে নিলে তাদের পরীক্ষাটা বাতিল করে আবার পরীক্ষা নিতে হবে। পরীক্ষা বাতিল করে আবার নতুন করে পরীক্ষা নেয়াটা অনেক বড় একটা ব্যাপার। সবচেয়ে বড় কথা তারা যেহেতু প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ করতে পারছেন না তাই আবার পরীক্ষা নেয়া হলে আবার যে সেই প্রশ্ন ফাঁস হবে না সেই গ্যারান্টিটুকু কে দেবে? কাজেই তাদের জন্য যেটা করা সহজ সেটাই করছেন। কিছু না করে চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে আছেন। তাদের অভিজ্ঞতা থেকে তারা জানেন, কিছু গুরুত্বহীন মানুষ কয়েকদিন চেঁচামেচি করে এক সময় ক্লান্ত হয়ে থেমে যবে। আর এই দেশের যারা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাবিদ তারা কিছু বলবেন না, তারা নির্বোধ নন, পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের
মতো ‘তুচ্ছ’ একটা বিষয় নিয়ে কথা বলে তারা কখনও সরকারকে বেকায়দায় ফেলবেন না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় একেবারে কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকার বিষয়টা আমি বুঝতে পারি, কিন্তু মাঝে মাঝে যখন তারা কোনো একটা বক্তব্য দেন আমি সেটা বুঝতে পারি না। আমি একেবারে হতবাক হয়ে গেছি যখন দেখেছি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো একজন কর্মকর্তা বলেছেন যে আসলে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। কিছু মানুষ গত কয়েক বছরের প্রশ্নপত্র যাচাই-বাছাই করে একটা সাজেশন দিচ্ছে এবং ঘটনাক্রমে সেই সাজেশনের একটা দুটো প্রশ্ন সত্যিকারের প্রশ্নপত্রের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে তার বেশি কিছু নয়। যারাই খবরের কাগজ পড়েন তারা সবাই জানেন, এই কথাটি ভুল কথা নয়, এটি মিথ্যা কথা। শুধু মিথ্যা কথা নয়, এ ধরনের কথাকে নিশ্চয়ই ডাহা মিথ্যা কথা বলে। আমরা সবাই জানি, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র হুবহু ফাঁস হয়েছে (এবং ফাঁস হচ্ছে)। কাজেই এরকম একটা ডাহা মিথ্যা কথা বলে কোনোভাবেই কোনো দায়িত্ব এড়ানো সম্ভব নয়। কিন্তু আমার দুঃখ সম্পূর্ণ অন্য জায়গায়। যখন প্রশ্নপত্র পুরোপুরিভাবে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে তখন যদি মন্ত্রণালয় থেকে ঘোষণা করা হয় যে আসলে এটি একটি সাজেশন মাত্র তখন একটা খুবই ভয়ংকর ঘটনা ঘটে যায়। যারা প্রশ্ন ফাঁস করে যাচ্ছে তাদের একটা ‘ইনডেমনিটি’ দিয়ে দেয়া হয়। এর সঙ্গে যারা জড়িত তারা নিশ্চয়ই আনন্দে অট্টহাসি দিতে থাকেন। প্রশ্নপত্রের সাজেশন দেয়া মোটেও অন্যায় কোনো কাজ নয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিজের মুখে সেই কথাটি বলেছে।
কাজেই আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা শুধু যে প্রশ্ন ফাঁস হতে দিয়ে এই দেশের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাটার সর্বনাশ করে দিচ্ছে তা নয়, যারা এই প্রশ্ন ফাঁস করে যাচ্ছে তাদের অপরাধকেও পুরোপুরি মার্জনা করে দিচ্ছে। এর চেয়ে বড় দুঃখের ব্যাপার আর কী হতে পারে?
২.
সবাই জানে পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস অনেক বড় একটা সমস্যা। একটা সমস্যা নিয়ে আহাজারি না করে সমস্যাটার সমাধান করে ফেলা নিশ্চয়ই অনেক বুদ্ধিমানের কাজ। তাহলে আমরা কেন সেই কাজটি করছি না?
এই প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয়ই একেকজনের কাছে একেক রকম, কিন্তু আমার কাছে উত্তরটি খুবই সহজ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় যখন সিদ্ধান্ত নেবে তারা প্রশ্ন ফাঁস হতে দেবে না ঠিক সেই মুহূর্তে প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ হয়ে যাবে। ঠিক কী কারণ জানা নেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখনও সেই সিদ্ধান্তটি নেয়নি। কেন নেয়নি আমি জানি না। আমি শিক্ষামন্ত্রী কিংবা অন্য কাউকে কখনও উচ্চকণ্ঠে বলতে শুনিনি, ‘আমি এই দেশের ছেলেমেয়েদের কথা দিচ্ছি ভবিষ্যতে আর কখনও প্রশ্ন ফাঁস হবে না।’ তারা সব সময় চুপচাপ থেকেছেন, প্রশ্ন ফাঁসের জন্য দায়িত্ব অবহেলার কারণ দেখিয়ে কখনও কারও চাকরি যায়নি। প্রশ্ন ফাঁসের এত বড় একটা ব্যাপারের কারণে কখনও কেউ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেননি। আমরা বরং দেখে আসছি এখন পর্যন্ত পুরো ব্যাপারটিকে অস্বীকার করা হচ্ছে।
আমি খুব জোর গলায় বলে আসছি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় চাইলেই প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ হয়ে যাবে। কেন বলছি তার কারণটি খুব সহজ। বাংলাদেশ এখন মোটেও হেলাফেলার দেশ নয়। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বাংলাদেশের সঙ্গে অসম্মানজনক ব্যবহার করার পর তাদের পুরোপুরি উপেক্ষা করে বাংলাদেশ নিজের অর্থায়নে পদ্মা ব্রিজ তৈরি করার সাহস এবং ক্ষমতা দেখিয়েছে। আজ থেকে এক যুগ আগে আমরা কেউ ভাবিনি এই সরকার যুদ্ধাপরাধীর বিচার করতে পারবে, এই সরকার শুধু বিচার করেনি, বিচার কার্যকর করেছে। এই দেশে যখন ব্লগারদের হত্যা করা হচ্ছিল তখন কোনো একটা কারণে সরকার জঙ্গিদের ধরার ব্যাপারে তৎপরতা দেখায়নি কিন্তু হলি আর্টিজানের ঘটনার পর যখন সরকার জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়েছে তখন তাদের দমন করে এনেছে। এরকম আরও উদাহরণ দেয়া যায়, সব উদাহরণের পেছনে ঘটনাটি খুবই সহজ, যখনই সরকার কিছু একটা করতে চেয়েছে সেটা করতে পেরেছে। এ দেশে সরকার এত বড় বড় কাজ করে ফেলতে পারে আর পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করে তারা একটা পরীক্ষা নিতে পারবে না, আমি সেটা বিশ্বাস করি না। সরকারকে শুধু সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা এ কাজটি করবে।
এর আগেরবার মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে বড় ধরনের সমস্যা হয়েছিল, তখন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিলেন এবারে তারা কিছুতেই আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেবেন না। তারা সঠিক মানুষকে দায়িত্ব দিলেন, তিনিও সঠিক মানুষদের নিয়ে টিম তৈরি করলেন, তারা মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষাটি একেবারে নিখুঁতভাবে নিয়ে নিলেন। এই পুরো প্রক্রিয়াটি একেবারে কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। কীভাবে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস না করে পরীক্ষা নেয়া যায় এখন আমি সেটা জানি। তাই আমি এত জোর গলায় বলতে পারি, কর্তৃপক্ষকে শুধু একবার সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা প্রশ্ন ফাঁস হতে দেবেন না, তাহলেই এই দেশে প্রশ্ন ফাঁস হবে না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে শুধু চাইতে হবে যে তারা প্রশ্ন ফাঁস হতে দেবে না, কিন্তু তারা এখনও সেটা চাইছে না, তাহলে কেমন করে প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ হবে?
শুধু একটিবার তাদের মুখ ফুটে বলতে হবে, ‘এই দেশের মাটিতে আর কখনও প্রশ্ন ফাঁস হবে না।’
এই কথাটি উচ্চারণ করতে তাদের এত দ্বিধা কেন?
লেখক: অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।