আর্কাইভ  শনিবার ● ২০ এপ্রিল ২০২৪ ● ৭ বৈশাখ ১৪৩১
আর্কাইভ   শনিবার ● ২০ এপ্রিল ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: নীলফামারীতে গোপন বৈঠক থেকে জামায়াতের ৩ নেতা গ্রেপ্তার       পলাশবাড়ীতে আসামির ছুরিকাঘাতে বাদীর মৃত্যু, গ্রেফতার ১       মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সন্তান-স্বজনের ভোটে না দাঁড়ানোর নির্দেশ       ভোজ্যতেলের দাম বাড়ল, খোলা তেলে সুখবর       বিএনপি নেতা সোহেলের নিঃশর্ত মুক্তি দাবিতে রংপুরে  মানববন্ধন ও সমাবেশ       

 width=
 

লালমনিরহাটে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীকে গাঁজা ব্যবসায়ী সাজিয়ে জেলে পাঠানোর অভিযোগ

শনিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, রাত ০৯:১৪

ঘটনাটি প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইনেরও পরিপন্থী বলে জানা গেছে। এদিকে অভাবের কারণে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মঞ্জুর পরিবার জামিনের জন্য আদালতে আবেদনও করতে পারেনি। তবে তাঁর মা গত বুধবার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য লালমনিরহাট পুলিশ সুপারের (এসপি) কাছে একটি লিখিত আবেদন জানিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মঞ্জু কালীগঞ্জ উপজেলার দলগ্রাম ইউনিয়নের শ্রীখাতা গ্রামের প্রয়াত আইয়ুব আলীর ছেলে। সে তার মা মাহিলা বেগম মিলির সাথে থাকতো। মাথায় একটি আঘাতজনিত কারণে প্রায় ১২ বছর বয়স থেকে সে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। গ্রেপ্তারের পর দেওয়া সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্যের প্রত্যায়নপত্রে তাকে ‘মানসিক প্রতিবন্ধী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সমাজকল্যান মন্ত্রনালয় কর্তৃক প্রদানকৃত প্রতিবন্ধীর পরিচয়পত্র অনুযায়ী তিনি একজন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী(দীর্ঘস্থায়ী মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধীতা)। তাঁর আইডি নম্বর ১৯৮৪৫২১৩৯৩৫৬২৮৫৪৪-০৩।

পুলিশ জানায়, কালীগঞ্জ থানায় দায়ের করা মামলার বাদি এএসআই বসন্ত রায় এজাহারে দাবি করেন গত ১৮ ফেব্রুয়ারি(শনিবার) বেলা প্রায় সাড়ে ১১টার দিকে মাদক কেনাবেচার গোপন সংবাদের ভিত্তিতে উপজেলার দলগ্রাম ইউনিয়নের কামারপাড়া বাজারের শুভজিৎ এন্টারপ্রাইজের উত্তর গলিতে উপস্থিত হলে একটি ব্যাগসহ মঞ্জু আলী পালানোর চেষ্টা করলে ওই এএসআইয়ের সাথে থাকা আরো কয়েকজন পুলিশ সদস্যসহ তাঁকে আটক করা হয়। এসময় সেখান থেকে এক কেজি ‘কথিত গাঁজা’ উদ্ধার করা হয়। পরে ওই দিনই ‘১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৯(১) টেবিল এর ৭(ক)’ ধারায় মঞ্জুর বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পর তাকে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়।

বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মঞ্জুর মা মাহিলা বেগম মিলি ও তার ভাই মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তা লালমনিরহাট পুলিশ সুপার বরাবর প্রতিকার চেয়ে লিখিত আবেদন করেছেন জানিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, শনিবার সকাল প্রায় নয়টার দিকে তাদের বাড়িতে এসে মাটিকাটার কাজ করার জন্য মঞ্জুকে ডাকাডাকি করে নিয়েযায় প্রয়াত স্কুল শিক্ষক ওহিদুল ইসলাম ডালুর ছেলে রাখি। এর ঘন্টাখানেক পর আমরা শুনতে পাই মঞ্জুকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে ‘ডিবি’ নিয়ে গেছে রাখির বাড়ি থেকে। এরপর ঘটনা জানতে কালীগঞ্জ থানায় ছেলের পরিচয়পত্রসহ গেলে তার সাথে দেখা করতে না দিয়ে পুলিশ দাবি করে আমার ছেলে গাঁজার ব্যবসা করে তাই তাকে কোর্টে পাঠানো হবে’।

মঞ্জুর মা মাহিলা বেগম আরো বলেন, ‘১২ বছর বয়সে মাথায় একটি আঘাতজনিত কারণেই সে মূলত মানসিক অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরবর্তিতে ডাক্তার-কবিরাজ দেখিয়েও সুস্থ হয়ে ওঠেনি। তাকে কয়েকদফায় মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তবে বেশ কিছু দিন ধরে অভাবের কারণে আর ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয় না। মাঝেমধ্যে খুব বেশি সমস্যা হলে ইনজেকশন দিয়ে টানা দুই-তিন দিন ধরে ঘুম পারিয়ে রাখা হয়’। তার নাওয়া- খাওয়াসহ কোনো কিছুরই কোনো ঠিক নাই। আমিই জোর করে বিভিন্ন জায়গা থেকে ওকে ধরে এনে যতœ করি। অথচ সেই ছেলে জেলখানায় কিভাবে দিন কাটাচ্ছি জানিনা’।

প্রত্যক্ষদর্শীশুভজিৎ এন্টারপ্রাইজের পূর্ব পাশে সাইকেল মেকানিক্স ওশ্রীখাতা গ্রামের বাসিন্দা কান্তেস্বর বর্মণ জানান,মঞ্জু পাগলাকে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে বেড় করে শুভজিৎ এন্টারপ্রাইজের পাশেই এসে দাঁড়ান দু‘জন ব্যক্তি। এর একজন আশরাফুল, তার হাতেই ছিল মঞ্জু পাগলাকে পড়ানো হ্যান্ডকাপের অপর একটি অংশ। হ্যান্ডকাপ দেখে মনে হয়েছে তারা পুলিশের লোক। পরে তারা আমার দিকে এগিয়ে এসে একজন বলল ( বসন্ত এস আই) এই লোকটাকে ( মঞ্জু পাগলা) চিনেন। আমি বললাম চিনিতো-ও একটা পাগলা। সারাদিন কোদাল ঘাড়ে নিয়ে এপাড়া-ওপাড়া বেড় হয়। আর একে ওকে বলে মোক (আমাকে) কামোত (কাজ) নিমেন। কিন্তু আমার কাছে এমন কথা শোনার পরেও ওরা মোটরসাইকেলে তুলে মঞ্জু পাগলাকে নিয়ে চলে যায়। প্রায় ঘন্টাখানেক পরে ওই দুজন আবার এসে আমার পাশের দোকানদার নূরমোহাম্মদ ওরফে মিস্টারের কাছে সই চায়। ওনি সই দিতে না পারায় আমার কাছে এসে সই ৯ (স্বাক্ষর) চায়। আমি সই দিতে পারবো না জানালে আমাকে হুমকি দিয়ে এসআই বলেন- ‘আমাকে চিনো? আমি দারোগা। তোমাকে আমি মামলার সহযোগি আসামি করবো বলে হুশিয়ারি দিয়ে চলে যায়।

অপর প্রত্যক্ষদর্শীদক্ষিণ দলাগ্রামের বাসিন্দা ও গলামাল দোকানদার নুরমোহাম্মদ ওরফে মিস্টার জানান, মঞ্জ পাগলাকে পড়ানো হ্যান্ডকাপ ছিল আশরাফুলের হাতে। আশরাফুল মোটরসাইকেল কেনা-বেচার কাজ করে। তবে স্থানীয় মানুষজন তাকে পুলিশের সোর্স বলেই চিনে। সেই আশরাফুলের সাথে থাকা ব্যক্তি ( দারোগা) আমাকে বলে, এই লোকোক (লোক) চিনেন। আমি বললাম- হ্যা চিনিতো, ওই একটা মেন্টাল( পাগল), রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। পরে তারা মঞ্জু পাগলাকে মোটরসাইলে করে নিয়ে গিয়ে কোথায় যেন রেখে এসে আমার কাছে সই (স্বাক্ষর) চায়। আমি বললাম, সই জানিনা, টিপসই নেন। তখন ওনি (এসআই বসন্ত) আমার সামনে কাগজ রেখে সই শেখাতে চায়। আমি আবারও বললাম, সই টাই জানিনা। টিপসই লাগলে নেন। কিন্তু টিপসই নাকি চলে না বলেই তখন তিনি আমার পাশের দোকানদার কান্তেস্বরের কাছে সই চান। তবে ওনি (কান্তেস্বর) সই জানলেও সই দেননি। স্থানীয়রা আরও বলেন মঞ্জুর পাগলামির কারণে মাঝে মধ্যে ওকে শিকল পড়িয়ে রাখা হয় বাড়িতে।

মামলার কথিত স্বাক্ষী ও ঘটনার দিন মঞ্জু পাগলাকে হাতকড়া ধরে রাখা আশরাফুল বলেন, ঘটনার দিন আমি কামারপাড়া গেলে এসআই বসন্ত দাদার সাথে দেখা হয়। তখন ওনি আমাকে বলে চলেন তো একটু আসি। পরে ওনি সহ এক বাড়িতে গিয়ে দেখি দুই জন দাঁড়িয়ে আছে। এরমধ্যে একজনের হাতে একটি বাগ ছিল। তাই বসন্ত দাদা তখন বলল, ওটা কি? এই কথা বলতে লম্বা করি ছেলেটা দৌঁড় দিয়ে পালিয়ে যায়। তাই বাগসহ মঞ্জুকে আটক করা হয়। পরে শুনলাম ওই বাড়িটা নাকি যে পালিয়ে গেছে তার ( বাড়িওলা রাখিঁ)। তার এক মামার সুবাধে পুলিশের সাথে ভালো সর্ম্পক আছে স্বীকার করে আশরাফুল বলেন, আমাকে স্বাক্ষী রাখছে কিনা? আমি জানিনা। তবে আজকে(গত বুধবার) আমাকে একজন ফোন করে বলল, তুমি নাকি স্বাক্ষী হয়েছো। এসময় প্রতিবেশী ও এলাকার অতি পরিচিত মঞ্জু পাগলাকে চিনে বলেই দাবি করেন মামলার কথিত স্বাক্ষী ও পুলিশের সোর্স আশরাফুল।

দলগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নং ওয়াড সদস্য মোফাজ্জল হোসেন জানান, ছেলেটার বাড়ি আমার বাড়ির সাথে। সে ছোট বেলা থেকে পাগাল। সবাই তাকে মঞ্জু পাগলা বলে চিনে। সেই হিন্দু মুসলমান সবার কাছে যায়। কখনো মসজিদে আবার কখনো কালীমন্দিরে থাকে। তার প্রতিবন্ধী কার্ডও আছে। এমন একজন পাগল পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে শুনে আমি এক দারোগাকে ফোন দিয়ে বলেছিলাম যে সে একটা প্রতিবন্ধী মানুষ। তবুও পুলিশ তাকে নাকি মাদক মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছে।

দলগ্রাম ইউ, পি চেয়ারম্যান শফিকুল আলম খন্দকার জানান, মঞ্জু মানসিক প্রতিবন্ধি, এটা সবাই জানে। সে পথে-ঘাটে মসজিদ মন্দিরে ঘুরে বেড়ায়। যেখানে যা পায় তাই খায়। তাকে এভাবে ধরে নিয়ে গিয়ে মাদকের সাথে যুক্ত করা কারই ঠিক হবে না। তাই তার মতো একজন প্রতিবন্ধী মানুষকে যেন অন্যায়ভাবে শাস্তি দেয়া না হয় বলে দাবি তোলেন ইউ,পি চেয়ারম্যান।

সরেজমিন ওই এলাকায় মানুষের সাথে কথা বলে কথিত গাঁজা বিক্রির দায়ে গ্রেপ্তারকৃত মঞ্জু যে মানসিক রোগী বা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী সে বিষিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তার প্রতিবেশি, পাশ্বিবর্তি বাজারসহ আশপাশের এলাকার বিভিন্ন শ্রেনী-পেশার মানুষসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সে একজন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। তবে মঞ্জু বিড়ি খেত।শ্রীখাতা এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আনসার-ভিডিপি এক সদস্য বলেন, ‘সে (মঞ্জু পাগলা) কখনো কোদাল ও কখনো টুকরী ঘাড়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আবার কোনো দিন বাঁশ ঘাড়ে নিয়ে সাড়া উপজেলায় ঘুরে বেড়ায়। সে কখনো মাদক গ্রহিতা-বিক্রেতা হতেই পারে না’। শ্রীখাতা গ্রামের বৃদ্ধ হরিশংকর বলেন, ‘মঞ্জু আগে ভালো ছিল। কিন্তু বহুদিন আগে তার ব্রেনশর্ট হয়। অথচ তাকে গাঁজার সাজানো মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হয়েছে’। আদর্শপাড়া জামে মসজিদের ইমাম মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ৭ বছর ধরে এই মসজিদে আছি। এতে প্রায় দিন ফজরের আযান দেয়ার সময় এসে দেখি মসজিদের বারান্দায় সে (মঞ্জু) শুয়ে আছে। সে একটা পাগল। সে কোন ব্যবসা করা তো দূরের কথা কোনদিন নেশা পর্যন্ত করেনি।’

দলগ্রাম ইউনিয়নের কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সভাপতি আলহাজ্ আব্দুল জব্বার বলেন, মঞ্জু একজন প্রতিবন্ধী। তাকে কেন যে পুলিশ গ্রেফতার করলেন তা আমারও বোধগম্য হচ্ছে না। তিনি আরো বলেন মঞ্জুকে আটকের সংবাদ পেয়ে এএসআই বসন্তকে ফোন করলে তিনি মঞ্জুকে আটকের কথা অস্বীকার করেন।

বৃহস্পতিবার মামলার বাদি এএসআই বসন্ত রায়কে সাংবাদিক এ বিষয়ে প্রশ্œ করলে তিনি বলেন, মঞ্জুকে মাদকের ব্যাগসহ আটক করা হয়েছে। তাই তার নামে মামলা দায়ের হয়েছে।

কালীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মকবুল হোসেন বলেন, মঞ্জু প্রতিবন্ধী কিনা আমি জানি না।

এ ব্যাপারে লালমনিরহাটের পুলিশ সুপার এস এম রশীদুল হক বলেন, বিষয়টি আপনার মাধ্যমে জানলাম, তদন্তকরে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

মন্তব্য করুন


 

Link copied