আর্কাইভ  শনিবার ● ২০ এপ্রিল ২০২৪ ● ৭ বৈশাখ ১৪৩১
আর্কাইভ   শনিবার ● ২০ এপ্রিল ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: লালমনিরহাটে মোবাইল ফোনে কথা বলছিল, হঠাৎ পিছন থেকে ট্রেনের ধাক্কায় কাটা পড়লেন যুবক       ঠাকুরগাঁওয়ে নিখোঁজের ২ দিন পরে ছাত্রের মরদেহ উদ্ধার       ছুটি বাড়ল সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে       ডিমলা উপজেলা নির্বাচন॥ এমপির ভাই, ভাতিজা ও ভাতিজি বউ প্রার্থী-তৃণমূলে ক্ষোভ       কিশোরী গৃহকর্মীকে খুন্তির ছ্যাকা; রংপুর মেডিকেলে মৃত্যু যন্ত্রণায় পাঞ্জা লড়ছে নাজিরা      

 width=
 

সবার প্রত্যাশা একটি কার্যকর ভোক্তা অধিকার আইন

বুধবার, ১৫ মার্চ ২০১৭, দুপুর ১১:৩০

শেখ মাজেদুল হক

রংপুর রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের ঔষধের ডিসপেনসারি । মনোয়ার দোকানীর কাছে ভিটামিন ই ক্যাপসুল ’ই-ক্যাপ’ এর দাম জিজ্ঞেস করল। দোকানী তাকে ড্রাগ ফার্মাসিউটিক্যালের এক পাতা ’ই-ক্যাপ (২০০এমজি)’ বের করে দিলেন। দাম বললেন ৪০ টাকা। জানালেন, ৪০০ এমজি পাতা ৬০ টাকা। মনোয়ার একটু এগিয়ে পাশের একই ঔষধের দাম জানতে চাইলে দোকানী ২০০এমজি এবং ৪০০ এমজি যথাক্রমে ৩৮ টাকা ও ৫৬ টাকা করে জানান। দু’টো দোকান পরে লালবাগ মোড়ে এই দাম এসে দাঁড়ায় আরো তিন টাকা কমে। মনোয়ারের মনে প্রশ্ন, এটা যদি জরুরি ঔষধ হত তাহলে কোন যাচাই না করেই যে কোন দামে কিনতে হত! আবারো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজিলাতুন্নেসা হলের সীমা চক বাজারের এক দোকানে গিয়ে জুস কিনে প্যাকেট কেটে এক চুমুক জুস মুখে দিতেই বিকৃত হয়ে গেল সীমার মুখ। সীমার প্রশ্ন এইটা কী দিলেন ভাই? গন্ধ! দোকানদারের মুখ ঝামটা। দেন, খাইতে হইব না। প্যাকেটটা কেড়ে নিলেন দোকানী। চিরচেনা ওই দোকানদারকে মেয়াদোত্তীর্ণ পচা জুসের মতোই বিস্বাদ মনে হল সীমার কাছে।

এই অবস্থা এখন দেশের বেশিরভাগ ক্রেতা-ভোক্তার। দ্রব্য আর সেবা ক্রয় করতে গিয়ে বঞ্চনা আর প্রতারণার শিকার হতে হচ্ছে তাদের। আর তাই সচেতন নাগরিকের দীর্ঘ দিনের প্রত্যাশা একটি কার্যকর ভোক্তা অধিকার আইন। ১৯৯২ সাল থেকে শুরু হয় এই আইন প্রণয়নের কাজ। প্রায় ১৭ বছর পর অবশেষে ১৩ অক্টোবর ২০০৯ জারী হয়েছে এ আইন। কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-র এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকা ওয়াসার পানি গ্রাহকদের সাড়ে ৭১ ভাগ গ্রাহক নানবিধ অভিযোগ জানিয়েও কোন সুফল পান না। বেশির ভাগ গ্রাহক সমস্যার জন্য অভিযোগ করেন না বলে জানান। তাদের কৈফিয়ত হল অভিযোগ করে কোন প্রতিকার পাওয়া যায়না। এছাড়াও দেশের বাজারে বিক্রিত বাংলাদেশসহ ১৮টি দেশের উৎপাদিত আটা, গুড়া মরিচ, হলুদ, লবণ, গুঁড়া দুধ, ট্যাং, চকোলেট, চানাচুর, পাউরুটি ও বিস্কুট এই দশটি পণ্যের ১শ’ ৮৪টি ব্রান্ডের উপর ক্যাবের করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, শতকার ২২ দশমিক ২২ ভাগ পণ্যের লেবেলে মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ এবং শতকার ২৩ দশমিক ৩৭ ভাগে উৎপাদনের তারিখ নেই। শতকার ১৫ দশমিক ৭৬ ভাগ পণ্যের লেবেলে বিএসটিআই-এর মান সনদ চিহ্ন ব্যাবহার করা হয়নি। অথচ এই সনদ ছাড়া কোন পণ্য বাজারজাত করার কথা না।

কমবেশি দেশের সব এলাকার দোকানে এখন পর্যন্ত সঠিক বাটখারার মাপ দেওয়া হচ্ছে না। অনেক দোকানেই বাটখারার বদলে পাথর বা ইট দিয়ে পরিমাপের কাজ চলছে। তেল পরিমাপের ক্ষেত্রে চলছে মানধাত্তা আমলের সেই কৌটা। এর গায়ে কোন পরিমাণ লেখা থাকে না। এগুলো যাচাই করে দেখার সুযোগও কম। যাচাই করতে গেলে অনেক সময়ই বিক্রেতার রোষানলে পড়তে হয়। অনেক সময় তারা রেগে পণ্য বিক্রি করে না। ট্রেন, বাস কিংবা ব্যাটারি চালিত অটো রিকশাসহ গণপরিবহনে দেখা যায় বিভিন্ন ধরণের লিফলেট। স্বপ্ন পাওয়া মহা ঔষধ, ১০০% খাটি, জীবনের শেষ চিকিৎসা, টাক এক ঘন্টায় ঢেকে যাক, খাট লোক লম্বা হবে, চিকন হবে মোটা, যৌন রোগমুক্তির এসব বিজ্ঞাপন চটকদার হলেও তা মূলত বিভিন্ন শ্রেণীর ভোক্তাদের প্রতারিত করার ফাঁদ। হোটেল বা ফাস্ট ফুড গুলোতে মরা মুরগি সরবরাহ করা হচেছ। মাছের মধ্যে ফরমালিন। মহিষকে গরুর মাংস বলে চালিয়ে দিচ্ছে।

বাজারে যত জুস পাওয়া যায় তা কোনটাই মানব দেহের জন্য নিরাপদ নয়। এতে করে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানবতা। শিশু এবং রোগীরা ফলমূলাদি খেতে নিরাপদ বোধ করে না। বাজারে ফরমালিন পরীক্ষা করার কোন ব্যবস্থা নাই। কিছু ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালিত হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগন্য। যদিও বিভিন্ন সরকারি মার্কেট সহ বিভিন্ন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানে দ্রব্য মূল্যের তালিকা প্রকাশ্যে দেওয়ার কথা থাকলেও খুব কম ক্ষেত্রেই তা পাওয়া যায়। থাকলেও সব পণ্যের দাম লেখা থাকে না।

তবে কনজ্যুমার এসোসিয়েসন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সংস্করণের আইনগুলো থেকে দেখা যায়, ভোক্তা অধিকার অধ্যাদেশ-২০০৮ অনুসারে “কোন ব্যক্তি মূল্যের বিনিময়ে প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে সরবরাহ না করলে অর্থদন্ড, কারাদন্ড বা উভয় ধরণের দন্ডে দন্ডিত হবে।” আবার “কোন সেবা প্রদানকারীর অবহেলা, দায়িত্বহীনতা বা অসতর্কতার জন্য সেবাগ্রহীতার অর্থ, স্বাস্থ্য, জীবনহানী ঘটলে তার শাস্তি অনূর্ধ্ব তিন বছর কারাদন্ড বা অনধিক দুই লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।”

সহজে দেখা যায় এমন স্থানে পণ্যের মূল্য তালিকা প্রদর্শন করার জন্য বলা হয়েছে। না করলে অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ পঞ্চাশ হাজার টাকার জরিমানা বা উভয় প্রকার দন্ডের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ওজনে কারচুপির শাস্তি হিসেবে অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ পঞ্চাশ হাজার টাকার জরিমানা বা উভয় প্রকার দন্ড ,খাদ্যে ভেজালের জন্য তিন বছর কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ দুই লক্ষ টাকার জরিমানা বা উভয় প্রকার দন্ড, মিথ্যা বিজ্ঞাপনের জন্য অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদন্ড বা দুই লক্ষ টাকার জরিমানা বা উভয় প্রকার দন্ড, পণ্যের নকলের শাস্তি তিন বছর কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ দুই লক্ষ টাকার জরিমানা বা উভয় প্রকার দন্ডের কথা বলা হয়েছে। এসব নিয়ম বাস্তবায়নের জন্য এই অধ্যাদেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর নামে প্রতিষ্ঠান কতটুকু বাস্তবায়ন করছে সে বিষয়ে ভোক্তাদের স্পষ্ট হওয়া উচিত। ভোক্তাদের অধিকার ভোক্তাদেরকেই আদায় করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ক্যাব গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে।

পণ্য বা সেবা কেনার সময় ভোক্তারও উচিত দেখেশুনে ক্রয় করা। আমরা ভেজাল পণ্য না কিনলে উৎপাদনকারী কোম্পানি যত বড়ই হোক একদিন পথে বসবেই। আসুন, আমরা ভোক্তার অধিকার বিষয়ে সচেতন হই, সচেস্ট হই। আর সবাই মিলে ভেজালমুক্ত বাংলাদেশ গড়ি। নিজে ভাল খাই অন্যকেও ভাল খেতে সাহায্য করি।

লেখক- সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মার্কেটিং বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।

মন্তব্য করুন


 

Link copied