আর্কাইভ  শুক্রবার ● ২৯ মার্চ ২০২৪ ● ১৫ চৈত্র ১৪৩০
আর্কাইভ   শুক্রবার ● ২৯ মার্চ ২০২৪
 width=
 

 

কুড়িগ্রামের খাবারে বেজায় খুশি ভুটানের রাজা

কুড়িগ্রামের খাবারে বেজায় খুশি ভুটানের রাজা

কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করলেন ভুটানের রাজা

কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করলেন ভুটানের রাজা

রানিকে নিয়ে কুড়িগ্রামে পৌঁছেছেন ভুটানের রাজা

রানিকে নিয়ে কুড়িগ্রামে পৌঁছেছেন ভুটানের রাজা

কুড়িগ্রামে সমৃদ্ধির হাতছানি

কুড়িগ্রামে সমৃদ্ধির হাতছানি

 width=
 
শিরোনাম: রংপুরবাসীর জন্য সরকারি চাকরি, পদ ১৫৯       স্বাস্থ্যের রংপুর বিভাগীয় পরিচালক ফজলুল হক কারাগারে       কুড়িগ্রামের খাবারে বেজায় খুশি ভুটানের রাজা       লালমনিরহাটে পুকুরে জাল ফেলতেই জালে উঠে এলো যুবকের মরদেহ       কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করলেন ভুটানের রাজা      

 width=
 

মুক্তিযুদ্ধের গল্প: বাদশা ও শহীদ মিনার

বুধবার, ২২ মার্চ ২০১৭, দুপুর ০২:৫৫

আফতাব হোসেন

এসব গ্রামের নামই মনে করে দেয় আদি রংপুরের হারানো অতীত। এসব এলাকার বিভিন্ন গ্রামের কৃষিজীবী, ব্যবসায়ী, পাইকার, হাওয়াইকারেরা কাজ শেষে দল বেঁধে আসে মাহিগঞ্জ বাজারে। কেউ জৈব সারে ফলানো দেশি ধান, পোলাও- কাউনের চাল, আলু, সরিষা, কেউ পাট, তামাক, সুপারী, কেউবা বিষমুক্ত গাছের পাকা আম-কাঁঠাল, জাম, ডালিম, পেয়ারা, নটকো, লিচু নেওয়া আনে বাজারে। বাড়ির পোষা গরু-ছাগলের খাঁটি দুধ, পুকুর-বিলের তাজা মাছ ব্যাচে। ভিটার আদা, হলুদ, মরিচ, রসুন, পিঁয়াজ, শাক-সবজীও। কেউ আবার মাজার-মসজিদে বড় জামাতে নামাজ আদায় করে। শীতলা-পরেশ নাথেও কেউ করে পূজা-অর্চনা। বাড়ি ফেরার আগে মনজা-শম্ভু, হরিসাধন-মধুর হুমাপ্যাথি, পাগলা ডাক্তারের মিকচার আর আফানউল্লা কবিরাজের গাছন্ত ঔষধ নেয় অসুখ-বিসুখে। ফরমান-কালুর মিষ্টির দোকানে আমিত্তি, বুট-বুন্দিয়া, চা-নাস্তা, গল্প-গুজব শেষে শাহালমের পানের দোকানে পান খায়। কেউ কেউ বিড়ি কেনে, আলোয়া-খইনি ডলে, রাস্তাহাটে, একসাথে দল বেঁধে। বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন পেশার মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত-দরিদ্র কর্মজীবী মানুষের হাট-বাজারের এই দৃশ্য অতিচেনা।

প্রতিদিনের বাজারহাটের এই চলাচলে দেশ, চলমান রাজনীতির হালচাল, কৃষি, যোগাযোগ, ভোট, হারজিত, উন্নতি-অবনতি নানা বিষয় জমে ওঠে গল্পে। আলাপে-আলোচনায় বাদ যায় না গ্রামীণ মানুষের ঘর-গেরস্তি, আবাদ-সুবাদ, খরা-বন্যা, ফসলহানি, বাজারদর, লাভ-লোকসান, চাকরি-ব্যবসা। বাদ পড়ে না অসুখ-বিসুখ বা ঝগড়া-ফ্যাসাদ, মামলা-মোকদ্দমা, সমাজ-জামাত, শালিস-বিচার কোন কিছুই। হারানো দিনের গ্রাম-সমাজের বুনিয়াদ, ঐতিহ্য-সভ্যতার সাতকাহন হয় রাতের মতো গভীর। আফানউল্লা স্কুলের পাশেই মসজিদ সংলগ্ন মাজার। একটু পূবেই গার্লস স্কুল এর পাশ দিয়ে দখল, দুষণে মৃত প্রায় নদী ইছামতি। একসময় ছিলো ভরা যৌবনা। দুকুল ছাপিয়ে ছিলো স্রোতের ধারা। সর্পীল ফেনিল ঢেউয়ে ছিলো উত্তাল। খরস্রোতা নদীতে ছিলো পাথরবাঁধা ঘাট। দেশ-বিদেশের নৌকা আসতো। সারি সারি নৌকা ছিলো ঘাটে বাঁধা। পাল তুলে চলতো নৌকার মিছিল, নানা পণ্যের পসরায়। মাঝি-মাল্লার ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালীর সুরে মুখরিত ছিলো দিগন্ত বিস্তৃত। সরব ছিলো নদীপথ, পাথরঘাটা ছিলো কর্মমুখর। নদী তীরে কাশবনে দোল খেতো শরতের বাতাস। ধবল জলে জোস্নার লুকোচুরি, প্রতিচ্ছবি ভাসতো সুনীল আকাশের। গ্রীষ্ম-বর্ষায় দুরন্ত কিশোর-তরুণের উদোম সাঁতার, নদী পারাপারের চেনা কতনা দৃশ্য। ছিলো যাযাবর বেদে-বেদেনির ভাসমান জীবন। সাপ খেলা, সিংঙ্গা লাগা, সাপের তেল, তাবিজ-কবজ নিয়ে ধোকা খেত গ্রামের সরল নারী-পুরুষ।

খোর্দ্দ রংপুর গ্রামের আসমতের ছেলে মজিবর, গাছ-গাছড়া ঔষধ দিয়ে ভাংগা-মচকা ভালো করা কবিরাজ, আব্দুল দেওয়ানীর ছেলে গ্রামের প্রবীণ তৈবুল মিয়া। সম্পর্কে মামা-ভাগ্না, দুজনের খুব মিল। ঘর-গেরস্তির কাজ শেষে প্রতিদিন হাট-বাজারে যায়, বাড়ি ফেরে একসাথে। কখনও সাথে থাকে মজিবরের জ্যাঠা কিসমতের ব্যাটা বক্কর, কাদের, তৈবুলের ভাই মগবুলের ব্যাটা মহুবর, তার বউয়ের বড় ভাই জয়নালের ব্যাটা লুৎফর। বাজার যাওয়া-আসার মেঠো পথে চলে কতো গল্প। মজিবর বলে, ফরমান চাচার ব্যাটা বাদশা, মুই, বক্কর ভাই, কাদের, মহুবর, ইছামতি নদীত কতো সাঁতার কাটচি, কলার ভুরাত ভাসি বেড়াইচি, কাগজের নৌকা বানেয়া ভাসে দিচি। ক্লাস আর পড়া ফাঁকি দেওয়ায় স্কুল ও লজিং মাস্টার খায়রুল স্যারের কত ডাং খাচি। নদীর তীরত ধান পাহারা দিবার সময় নাড়াবাড়িত কদুর ডগি-আন্ডা আলুর ডাইল দিয়া ভাত খাচি। চেংরা চেংরি মিলি বাড়ি থাকি চুপকরি চাউল, কালাই, আলু, টাপা থাকি হাঁস মুরগি আনি নদীর ঘাটত কাশিয়াবাড়িত পিকনিক খাচি। স্কুল শেষে রাস্তাত মারবেল খেলাইচি, ভুইয়ত চেংগু-ডান্টি, দাডিয়াবান্দা, ছি বুড়ি, গোল্লাছুট খেলাইচি। বাদশার বইন, এনছানের বইন, আবুল হাওয়াইকারের ব্যাটা-বেটি, ইলিয়াস মামার ছাওয়ারা কাশিয়াফুল, তারাফুল, গেন্দাফুল তুলি খোপাত দেচে তাক নিয়া কতো হইচই। পানখায় মুচকি হাসে আর মামা বলে-তার জন্যে তোর মাও ঝাকালিবুর কতো ডাং খাচিস! বাদশার মামা আবুল হাওয়াইকারের বেটির সাথে বাদশার খুব ভাব আচিল। ইস্কুল না যায়া নদীর পার দিয়া হাত ধরি কতো বেরাইচে, নুকানুকি খেলাইচে, তাক নিয়া কতো কানডো ! আঙ্গুরের মার জাঙ্গির শোমাস, ঢাংগার গাচের জমবুরা, কাচামিটা আম, লুৎফরের মার সইদি সুপরি, মোস্তপার মার কামরেঙ্গা, বাদশার মার নেচু, বাবলুর মার নটকো কতো সাবার কচ্চে; কাজির বাড়ির আমলি, তোফার বাপের আড়ার বেতগুয়া, রশিদের মার আমলক্কী, জুলহাসের মার জলপাই, শিয়ালুর বাড়ির ডাব, আজাদের মার বড়াই, কান্দরার বাড়ির পানিয়াল খায়া কান্দরির কতো কথা, কতো গাইল খাচি। গাইলের ভয়োত বাড়িত থাকপার পাইস নাই, কোনো কোনোদিন অনেক খোঁজাখুজি করি মাইনষের বাড়িত থাকি ধরি আনছি কতো রাইতে মামা কয় আর হাসে। মামা বলে, বাদশার সাহস যেমন আচলো, খচ্চরো আচলো তেমন। ছোটথাকাৎ ওরকম অনেক খচরামো কচ্চেলো, বাড়িত কাকো না কয়া কতো পালে বেড়াইচে। স্কুল ও খেলার সাথী বাদশার বদনাম সহ্য হয় না মজিবরের। বলে-চেংরা বয়সে এর চ্যায়া আরও কতো কি মানুষ করে? খালি বাদশা আর মোর দোষ! মামার বিরক্ত বুঝতে পেরে অন্য প্রসঙ্গে কথা তোলে মজিবর,বলে- মামা আগে তো ইছামতি নদীর পাথরঘাটের নামের জন্যে নাম হচিল পাথরঘাটা। তার নাম এ্যলা মাহিগঞ্জ হইল ক্যানে? সউগ জানিস, বুজিস এ্যটা ফির জানিস না?- মামা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে, তোমার স্কুলের পাচ দিয়ে যে ইছামতি নদী, ঐ নদী দিয়া মাছের পিটোত চড়ি এক বুজুর্গ আচ্চিলো বুখারা শহর থাকি ইসলাম প্রচারে, তার নাম জানিস? স্কুলের পাশত মসজিদের ভেতরত তার মাজার আছে কবার পাইস? মামার কথায় সায় দেয় ভাগ্না বলে জানো। তার নাম শাহজালালুদ্দিন জাহাগাশত বোখারী। তার নামে মাহিগঞ্জ হইচে, মামার জবাবে সন্তোষ্ট হয় না ভাগ্না, হয় না সাথে চলা অন্যরা, বক্কর সহ সবায় জানতে চায়-পীরের নাম যদি শাহাজালাল হয়, তাইলে শাহজালালগঞ্জ হইবে-মাহিগঞ্জ ক্যানে ? আর বোখারা শহর তো অনেক দূর, মাচটা ফির কতো বড় তার পিটত চড়ি এতদূর আইসা যায়? মামা ক্ষিপ্ত হয়ে বলে-বক্কর আর মহুবর তো স্কুল ফাকি দিয়া খালি টিকটিক খ্যালে ব্যারাইচে,ওমরা কি জানে ? অনেক দিন আগের কথা- তখন নদীত স্রোত আচলো। নদী ওসার আচলো অনেক, সেই নদীত মাচের মতো নৌকাত চড়ি আচ্চেলো ঐ পীর, তাক মাহিসওয়ার কয়? তাক শুনচিনো আফানউল্লার নাতী তালেব মৌলবির কাচোত। মাহিসওয়ার হওয়ায় মাহিগঞ্জ হইচে? সেটা না হয় বোজনো, তা খোর্দ্দ রংপুর হামার গ্রামটা ফির হাওয়াইকারটারি হইল ক্যানে? সবাই মামার কাচোৎ জাইনবার চায়- মামা মাথা চুলকায় আর কয়- ঐ যে বাদশার কথা আর আবুল হাওয়াইকারের কতা কনু, আঙ্গুরের কতা কইনেন সেটে ঐ নামের রহস্য ? রহস্যটাও জানতে চায় ভাগ্না সহ সবাই, বলে- রহস্যটা একনা কন মামা শুনি, এ্যগলাতো জানা খায়, মামা বলে- মাহিগঞ্জ বাজার ডাকিনিচলো বাসতউল্লা। উয়ার বাপ দাদারা এই বাজারের ইজারাদার আচলো। বাজার ডাকি তোলা তোলচেলো। খুব প্রভাবশালী আচলো। বাসতউল্লার বওনাই বারেক হাজীর বাড়ি হামার খোর্দ্দ রংপুরত। য্যাটে বাদশার বাপ ফরমানের বাড়ি। হাজির ছাওয়া পোয়া আচলো না। বাসতউল্লার ব্যাটা ফরমান উয়ার ভাগ্না, তাক বিয়াও দেয় বারামউল্লার বেটি সিদ্দিকাক দিয়া। গোরা ভুলভুলা ছাওয়া, দেখতে খুব সুন্দর। লেখাপড়া কম করলেও নামাজ- কোরাণ জানচেলো, খুব পরহেজগার আচলো। পরহেজগার হওয়ায় হাজি ভাগ্নাক বউ সহ বাড়িত আনি থোচলো। বারামউল্লারা হাওয়াইকার আচলো। আতশবাজি,ফটকা,গাটিয়া বন্দুক,মেলা রকমের হাওয়াই বাজি- রংতামাশার ব্যবসা আচলো। রোজাত এপতার, পাচারাইতে সেহেরি, ইদের জামাত, বিয়াও, মহরম, আকড়া, মেলা- বান্যি, পূজা সউগ অনুষ্ঠানত বন্দুক ফটকা আতশবাজির খুব চল আচলো। এ্যলকার মতো মাইক, গান বাজনা আচলো না। রোজা ইদের নামাজের আগত দমকলের সাইরেনও আচলো না। কারেন্টের মরিচ বাতি, আতশবাজিও আচলো না। তখন হাওয়াইকারের উপর আচলো আনন্দ ফুত্তি আর তামাশার সউগ ভস্যা। নাম ডাকও আচলো হাওয়াইকারের। ব্যবসাও হচলো ভালো। মেলা জাগা থাকি হাওয়াইকারের বাড়িত খরিদ্দারেরা আচ্চেলো। হাওয়াইকারের নাম বারায় হামার গ্রামের নাম বদলি যায়। হয় হাওয়াইকারটারি। তখন এই রকম অনেক গ্রামের নাম বদলি গেইচে। নাম হইচে সর্দ্দারটারি, মুন্সিটারি, কাজিটারি।

চা মিষ্টির দোকানে শুধু কৃষিজীবীই নয়, গ্রাম রাজনীতির দেওয়ানি, দরবারি, সর্দ্দার, কাজি, মুন্সি, হাওয়াইকার, মাতাব্বর, নেতা- পাতিনেতারাও বসে। বসে এলাকার নাম ডাক আলা ভালো মন্দ সব মানুষ। চায়ের সাথে চলে খোশ গল্পো । ফরমানের দোকানে তার তিন ছেলেই খরিদ্দার চাহিদা মেটায় । কোনো দিন খরিদ্দার কিছুটা কম থাকলে নিজ গ্রামের পরিচিত মানুষদের সাথে তারাও যোগ দেয় গল্পে । সেকেন্দার তৈবুল মিয়াকে বলে, চাচা শুক্রবার বাদ জুম্মা মসজিদে মা’র জন্য খাজে খতম ও দোয়া হইবে , থাকেন গ্রামের সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে । তৈবুল মিয়া জানতে চায় , তোর মা’র অবস্থা ক্যামোন ? খুব খারাপ , সেকেন্দার উত্তর দেয়-বলে কি হয়, জানি না । ছোট ভাই সামচুল বলে – বিছানাত কতো বছর , সুকি পাত নাগচে , রেজা বলে-মরার মতো বিছানাত পড়ি আচে, এতো কষ্টের চ্যায়া তওবা আর খতম পড়াইলে যদি কিচু হয় । সেকেন্দার বলে-মুন্সির কথায়, আল্লা যদি মাফ করে তাহলে ভালো হবার পায়, নাহলে কষ্ট থেকে বাঁচবে । তৈবুল মিয়া বলে , রেজার বউয়ে তো খেজমত করে , তার জন্যেতো বুড়ি এলাও উপরোত আচে । নাইলে এতোদিন থাকে । বাদশা মুক্তিযুদ্ধে যায়া ফিরি না আসিল তখোন থাকিতো তোর মাও বিছানাত পড়িল , আর ভাল হইল না । সেকেন্দার বলে- এজন্য চাচা , আমিই বেশি দায়ি । মজিবর বলে-দোষের কি ? বয়স হইলে মানুষ মরবে , সেটাতো অস্বাভাবিক নোওয়ায় । মজিবরের কথায় তৈবুল মিয়া বলে –হায়াত মউত সউগ আল্লার হাতত- মাইনসের কিচু করার আচে ? তৈবুল মিয়ার কথার উত্তরে- সামছুল বলে , বাদশা ভাই যুদ্ধে গেলো, ফিরি আসিল না , সেই চিন্তায় বাবা গেল , মা বিছনাত পড়িল , হামার সংসার এলোমেলো হয়া গেইল , সেই শোকে দুই বইনো মরিল , আর মার মরার দশা ; রেজা বলে , ঢাকাত তখন বড় ভাইজান ইপিআর বাহিনীত চাকরি করে , বাদশা হটাৎ উয়ার বন্দুর ঘরে সাতে আসি মাক কইল মুই ঢাকা যাও মা , বড় ভাইজানের সাথে দেকা করবার । মা মনে কচ্চে , সামনাত পরীক্কা হয়তো কোনো দরকার , সেইজন্যে বাদা করে নাই, খালি কইচে , দেকি শুনি যাইস, রাস্তা ঘাটত ফির বিপদ না হয় । বাদশা মাক কচলো , ভাইজানের সাথে দেকা করি একদিন পরেই আসিম মা , চিন্তা করিস না, তারাতারি আসিম। যুদ্ধে যাওয়ার কথা মোকো কচলো বাদশাহ, পরীক্কার জন্যে মতিন ভাইজান মোক যাবার দেয় নাই-মজিবর বলে। সেকেন্দার বলে, বাদশা যুদ্ধে যায়া ফিরে আসবে না জানলে-যুদ্ধে যাওয়ার পারমিশন দিতাম না। আমি তখন ঢাকার পিলখানায় ইপিআর সদর দপ্তরে, ১৯৭১ সালের ৭ ই মার্চ সকালে আমার সাথে দেখা করে বাদশা। ভাবলাম সামনে মেট্রিক পরীক্ষা টাকা পয়সার দরকার সেজন্য হয়তো এসেছে। খাওয়া-বিশ্রাম শেষে জিজ্ঞেস করি হঠাৎ ঢাকা কেন ? সামনে পরীক্ষা কোনো দরকার, কোনো গন্ডগোল হয়েছে নাকি ! বাদশা মাথা নিচু করে বললো-ভাই আমি বঙ্গবন্ধুর ভাষন শুনতে এসেছি,তুমি আমাকে রেসকোর্স মাঠে নিয়ে যাও। দেশে গন্ডোগোল লাগবে,বঙ্গবন্ধু কি ভাষন দেয়-তা শুনতে রংপুর থেকে অনেক ছাত্র নেতারা এসেছে। তখন বুঝলাম ছোট ভাই লেখাপড়া ছেড়ে রাজনীতিতে জড়িয়েছে। দু‘ভাই রেসকোর্স মাঠে যাই। মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ। বঙ্গবন্ধু মাঠে আসার আগেই মাঠ লোকে লোকারণ্য,লাখো জনতা অধীর অপেক্ষায়,শ্লোগানে শ্লোগানে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হচ্ছে-ধ্বনিত হচ্ছে “তোমার আমার ঠিকানা,পদ্মা-মেঘনা-যমুনা”।

বিকেল ৩ টা ২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু মঞ্চে আসলেন লখো জনতার করতালিতে মূখরিত রেসকোর্স। ২০ মিনিট ভাষন দিলেন বঙ্গবন্ধু। বজ্রকন্ঠে দিলেন স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষনা-“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। লাখো তরুণ-যুবক-জনতার মতো সাহসী বাদশার রক্তেও প্রবাহিত হয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ফলগুধারা। বড় ভাইকে অনুনয় করে চায় যুদ্ধে যাবার অনুমতি,বলে-ভাই আমি যুদ্ধে যাবো,তুমি আমাকে বাঁধা দিয়োনা। এসব কথা শুনে দোকানে বসে থাকা সবাই নিশ্চুপ প্রায়।

সামছুল বলে ওঠে-“তখন বাদা দেলে বাদশা যুদ্ধে যাবার পারিল না হয়,হামার বাড়িত এমন শোকের ছায়া পড়িল না হয়”। চোখ মুছতে মুছতে রেজা বলে-“মরার আগোত বোধায় বাদশার সাথে আর দেখা হবার ন্যায়রে রেজা-মা সেকতা কয় আর কান্দে”। সামছুল বলে-স্বাধীনের ২ মাস আগে একবার বাড়ি আসিল,হামরা তখন দোকান যাবার ব্যাড়াচি-ঘারত অস্ত্র,হাতোত ব্যাগ,তাতে বোমা; দাড়ি-চুল বড় বড় দেকি চেনায় যায় নাই। পরে মার পাত ছালাম করি কয়-“মা মুই বাদশা”। মা অবাক হয়া,কোলত জরে ধরিয়া হুক হুক করি কান্দে । কইল বাজার থাকি আন্ডা আলা ইলিশ মাচ আনবার। তারা তারি মুই দোকান যায়া আব্বার কাচে টাকা নিয়া বাড়ি আসনু,দ্যাকো মা দরপা থাকি মুরগি ধচ্চে,গচি মাচ আন্ধচে,সেদলের ভত্তা,নাপা শাগের ঝোল কচ্চে। তারাতারি ইলিশ মাচ আন্ধিয়া মাতাত হাকায় আর ভাত তোলে খিলায়। বেশি দেরি করে নাই বাড়ির বগলোত গোসইবাড়ি,স্যাটে ইপিআর ক্যাম্প,যানবার পাইলে গুলি করি মারবে,আর হামার বাড়ি ঘর পুরি দেবে,সেই ভয়ে তারাতারি চলি গেইচে। রাইতোত যাওয়ার সময় মাতাত হাত দিয়া দোয়া করে আর মা কয় দ্যাশ স্বাধীন করি ফিরিস বাবা। কিন্তু দ্যাশ স্বাধীন হইল,কত মুক্তি ফৌজ ফিরি আসিল,বাদশা আসিল না। মহিন্দ্রার মোস্তফা,মাহিগঞ্জের তোফা মিলিটারি,সুলতান,সাজু চদরি,জলিল সবায় আসিল,সবায় আসি বাদশার খোজ ন্যায়,তামার খোজ করা দ্যাখি মা বাবা সহ গ্রামবাসি সবার সন্দেহ হয়-বাদশা বুজি নাই। তোফা মিলিটারি হামার বওনাই,তায় ফিরি আসি বাবাক কইচে-৬ নম্বর সেক্টরে এক সাথে যুদ্দ কচ্চেলো। দুলাভাই মোক কইচে, প্রথমেতো তিস্তা ব্রিজোৎ ক্যাপ্টেন নওয়াজেসের সাথে যুদ্দ কচ্চেলো,সেকতা উয়ার স্কুলের মাষ্টার মোল্লা ছারও কইচে-বলে রেজা। সামছুল বলে,তিস্তার যুদ্দতোৎ গুলি খায়া আহত হচলো,মহিন্দ্রার এক মুক্তি ফৌজ খবর দেচলো,মুই উয়াক দেকপ্যার ইন্ডিয়ার হাসপাতালোত গেচনু। মজিবর আফসোস করি কয়-বাদশা সেকেন্দার ভাইর অটে ঢাকা থাকি ফিরি মোকো যুদ্দে যাবার কচলো,পরীক্ষা দেকি ভাইজান মোক যাবার দেয় নাই। বাদশার এসব কথা শুনে হতভম্ব হয় দোকানের সকলে। তৈবুল মিয়া বলে-কোটে মরিল,ক্যামন করি মরিল,জানাযা দাফন হইল কিনা তাও বুঝি জানা যায় নাই ! রেজা কয় তোফা দুলাভাই জাহেদা বুক কচলো, ৬ নম্বর সেক্টর আচলো নদীর সীমানায়। তিস্তা নদীর পাটগ্রাম না থেতরাইত একবার পাকবাহিনীর সাথে যুদ্দ কচ্চেলো বাদশা। পানা মাতাত দিয়া নদী সাতরেয়া খানসেনাক বোমা মাচ্চেলো,টের প্যায়া পাকবাহিনী খই ফোটার মতো গুলি ছোচ্চেলো। তাতে বোধায় মারা যাবার পারে-এই কতা জায়েদা বু কচলো। সেকেন্দার বলে, একাত্তুরের যুদ্দের সময় ঢাকার পিলখনায় বন্দি থাকায় বাড়ির আর বাদশা কারো খোজ নিতে পারেনি। বাদশা শহীদ হয়েছে এটা আমাদের গর্ব।

শুধু বাদশাই নয় ত্রিশলাখ শহীদের রক্তে স্বাধীন আমাদের দেশ। সামছুল বলে-বাদশা ভাই ছাড়াও যুদ্দের সময় খান সেনারা মাহিগঞ্জের সিবেন মুখার্জী,খাম্বাখান,গনেশইপিয়ার,দ্বিজেন ঘোষ,উপেন পানাতি আরও কতো নারি পুরুষক গুলি করি মাচচে। নব্দীগঞ্জোৎ,শসানোৎ কতো ইপিয়ার,নেতাক গুলি করি মাচচে। হামরা শহীদ পরিবারের সন্তান এটা হামার বড় গর্ব। গর্বের সাথে বলে রেজা। বলে-১৬ ডেসেম্বর,২৬ শে মার্চ অংপুরের ম্যালা শহীদ পরিবার ষ্টেডিয়াম যায়,টাউন হল যায়,স্যাটে সবাক ফুল দ্যায়,সম্মান করে,উপহার দ্যায়,সমবর্ধনাও দ্যায় এ্যাটা কি কম পাওয়া। আগে ভালো থাকতে মা গেচলো,মা’র সাথে মুইয়ো গেচনু,মা বিচনাৎ পরি থাকায় মুই এ্যালা যাও,মুই বাদশা ভাইর ভাতাও তোলো-রেজা অনেকটা গর্ব ভরে বলে। তবে মা’র খুব দুক্কো আচলো,কচলো-সেকেন্দার ভাই য্যামন অল্প লেখাপড়া করি ইপিআরোৎ গেচলো, বাদশা ভাইক আইয়ে বিয়ে পড়েয়া সেনাবাহিনীর অপিসার হবার কচলো। অয় অপিসার হইল হয় আর ভাইয়ের বেটি সালমাক দিয়া বিয়্যাও দেলে হয়। মা’র খুব আশা আচলো-সালমাক খুব পচন্দ করচেলো মা’ও। বাদশা ভাইয়ো উয়াক খুব ভালোবাচ্চেলো। মা’র মতো সালমাও এ্যালাও বাদশার অপেক্ষায়,বাদশা বোদায় একদিন আসপে ! অয় মোক কচলো,স্কুল পড়ার সময় ইছামতি নদীর রতবাড়ি পুলের কাচোৎ একটা বকুল গাচ আচলো। সেই বকুল ফুলের মালা তুলি দুই জনে দুই জনোক মালা বদল কচ্চেলো। সেই স্মৃতি বুকে নিয়ে পথ চেয়ে আজও বেচে আছে সালমা।

বাদশার জন্য গর্ব বাদশার মা’র,ভাই বোনের,পরিবারের। এই গর্বে গর্বিত মাহিগঞ্জ,খোর্দ্দরংপুর,হাওয়াইকারটারি গ্রাম। ফতেপুর রোডের চৌমাথায় রংপুর-পীরগাছা সড়কের পাশে গড়ে উঠেছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইছামতির তীরে আফানউল্লা স্কুলের মাঠে শহীদ মিনার। হাজারো শহীদের আত্মার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধায় ফুলে ফুলে ভরে ওঠে স্মৃতির মিনার।

বাদশার মতো শত শহীদের আত্মোৎস্বর্গে গর্বিত স্বদেশ, শহীদ পরিবার-সমুচ্চরে সম্মিলিত উচ্চারণ সবার। পূবে খোর্দ্দরংপুর, ছোট রংপুর, বড় রংপুর গ্রামের উপরে উঠেছে রক্তলাল সূর্য। প্রভাত ফেরিতে আফানউল্লা স্কুলে এগিয়ে আসছে শিক্ষার্থীর ঢল। বাসাবাড়ি দোকান খামারে উড়ছে সবুজের বুকে লাল পতাকা। মাহিগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারেও জনতার ঢল। ফুলে ফুলে ভরে যায় শহীদ মিনারের বেদি। তখনো দুরে ভেসে আসে গানের সুর- “এক সাগরের রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা আমরা তোমাদের ভূলবোনা”।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

মন্তব্য করুন


 

Link copied