ডেস্ক: মন্ত্রিসভার বৈঠকে যে দুই মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী 'সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৭'-এর খসড়া অনুমোদনে মত দিয়েছেন, তাদের নেতৃত্বাধীন সংগঠনগুলোই বর্তমানে এর বিরোধিতা করছে; প্রস্তাবিত আইনকে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের 'স্বার্থের পরিপন্থী' ও 'কালাকানুন' আখ্যা দিয়ে সংশোধন করার দাবি জানিয়েছে। আগামী ১ মে সারাদেশে যান চলাচল বন্ধ রাখার মতো কঠোর কর্মসূচির সিদ্ধান্তও নিয়েছে এসব সংগঠন। এ ধরনের কর্মসূচিও নেওয়া হচ্ছে মন্ত্রীদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে।
গত ২৭ মার্চ মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন পায় বহুল আলোচিত সড়ক পরিবহন আইনের খসড়া। এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন নৌপরিবহনমন্ত্রী ও শ্রমিক সংগঠন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি শাজাহান খান এবং পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী, মালিকদের সংগঠন সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান রাঙ্গা। মন্ত্রিসভায় তারা উভয়েই আইনে অনুমোদনের পক্ষে জোরালো মত দিলেও বাইরে এসে এর বিরোধিতা করছেন। গত সপ্তাহে তাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংগঠন দুটির সভা থেকে এ আইন পরিবর্তনের দাবি তোলা হয়েছে। এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতেও শাজাহান খান ও মসিউর রহমানের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সভা থেকে চালকের সাজার 'প্রতিবাদে' 'কর্মবিরতি'র নামে যান চলাচল বন্ধ করে দিয়ে দু'দিন দেশজুড়ে দুর্ভোগ সৃষ্টি করা হয়।
কী আছে মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত আইনে :মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত আইন অনুযায়ী চালককে লাইসেন্স পেতে কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণি পাস হতে হবে। চালকের সহকারীকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করতে হবে। লাইসেন্সের বিপরীতে ১২টি পয়েন্ট থাকবে। পূর্ণ পয়েন্ট কাটা গেলে লাইসেন্স বাতিল হবে। অতিরিক্ত পণ্য বহনে তিন বছরের জেল এবং ভুয়া লাইসেন্সে গাড়ি চালালে দুই বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হবে। বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে কাউকে হতাহত করলে চালককে তিন বছরের জেল ও ২৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। মৃত্যু ঘটলে বিচার হবে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি অনুযায়ী। আদালত অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করে দণ্ডবিধির যে কোনো ধারায় বিচার করতে পারবেন। মৃত্যুর ক্ষেত্রে ৩০২ ধারায় বিচার করা যাবে। অর্থাৎ বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর কারণে কারও মৃত্যু হলে চালকের ফাঁসিও হতে পারে। এ ধরনের শাস্তির বিরোধিতা করছেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। বর্তমানে প্রচলিত আইনে এ ধরনের অপরাধে মাত্র তিন বছর সাজার বিধান রয়েছে।
প্রস্তাবিত আইনটি বিদ্যমান 'মোটরযান অধ্যাদেশ, ১৯৮৩'-এর তুলনায় কিছুটা কঠোর। মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পাওয়ার পর থেকেই এর বিরোধিতা করছে দুই মন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সংগঠন দুটি। সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ সভায় দুই মন্ত্রীও চালক লাইসেন্স পেতে অষ্টম শ্রেণি পাস এবং বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর কারণে মৃত্যুর বিচার ও উচ্চ জরিমানার বিধানের বিরোধিতা করেছেন।
মন্ত্রীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে কর্মসূচি :দুই মন্ত্রীর এ দ্বিমুখী ভূমিকাকে 'নৈতিকতাবিরোধী' বলে মনে করছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহ্দীন মালিক। তিনি বলেন, 'মন্ত্রিত্ব চাকরি নয়। তারা সরকারের অংশ। তাদের দায়িত্ব সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা। কিন্তু তারা মন্ত্রিসভায় যে আইন অনুমোদনে সমর্থন করছেন, সাংগঠনিকভাবে সেই আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তাদের এ অবস্থান নৈতিকতাবিরোধী।'
তবে মসিউর রহমান তা মনে করেন না। তিনি বলেন, 'মন্ত্রীদের পরিবহন সমিতির পদে থাকতে আইনে বাধা নেই।' তার দাবি, তিনি সরকারের বিরোধিতা করছেন মাত্র। প্রতিমন্ত্রী জানান, তাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভাগুলো থেকেই সরকারের সিদ্ধান্ত বদলাতে আন্দোলনের কর্মসূচি নির্ধারণ করা হচ্ছে। সভাগুলোয় উপস্থিত পরিবহন নেতারাও এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
গত ৬ ও ৭ এপ্রিল সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয় শাজাহান খানের সভাপতিত্বে। ফেডারেশনের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা নিশ্চিত করেছেন, এ সভায় আন্দোলনের কর্মসূচিসহ খসড়া পরিবর্তনের দাবিতে ১০ দফা সিদ্ধান্ত হয়। শাজাহান খান শ্রমিক নেতাদের আশ্বস্ত করেন, প্রস্তাবিত সড়ক আইনের বিরুদ্ধে তিনি শক্ত অবস্থান নেবেন। চালক-শ্রমিকদের জেল-ফাঁসি হতে দেবেন না।
সভায় ভারতীয় মোটরযান আইন, ১৯৩৯ এবং মোটরযান অধ্যাদেশ, ১৯৮৩-এর সঙ্গে প্রস্তাবিত আইনকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহকে আহ্বায়ক ও শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলীকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করেন শাজাহান খান। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, এ কমিটি ১৭ এপ্রিলের মধ্যে প্রস্তাবিত আইনের পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের স্বার্থবিরোধী ধারাগুলো সম্পর্কে সুপারিশ করবে। এর পর এসব সুপারিশ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী, সড়ক পরিবহন সচিব এবং আইনমন্ত্রী ও সচিবের সঙ্গে বৈঠক করে তুলে ধরা হবে।