আওয়ামী লীগের গঠন প্রক্রিয়ায় যারা ছিলেন, তাদের অনেকেই পাকিস্তান আন্দোলনের সাথেও সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তির অসারতা বুঝতে তাদের সময় লাগেনি। ১৯৪৭ সালে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান গঠনের মাত্র দুই বছরের মাথায় ঢাকায় গঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ। তারমানে তখন দুটি মুসলিম লীগ- একটি ক্ষমতায় থাকা মুসলীগ লীগ, আরেকটি আওয়ামের মানে জনতার মুসলিম লীগ। দ্রুতই আওয়ামী মুসলিম লীগ সত্যিকারের জনতার দলে পরিণত হয়। ১৯৫৫ সালে দলের তৃতীয় সম্মেলনে নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি ফেলে অসাম্প্রদায়িক সংগঠনে পরিণত হয় আওয়ামী লীগ।
ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগ ধারণ করে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানির নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ গঠনের পর আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্ব চলে আসে শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে। তারপর থেকে তাঁর নেতৃত্বেই অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগের বিকাশ। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়ে গঠিত হয় জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল একটি উদার, অসাম্প্রদায়িক, উন্নত, বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক দেশ গঠন।
১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানেও ছিল সেই চেতনার প্রতিফলন, চার মূলনীতি ছিল- জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। স্বাধীন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ছিল ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। কিন্তু ৭৫এর পর পেছনে হাঁটতে থাকে বাংলাদেশ। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের হাত ধরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভুলে পাকিস্তানী ভাবধারায় চলতে শুরু করে বাংলাদেশ। তখন থেকেই মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত, ধর্মকে পুঁজি করে রাজনীতি করা দল ও ব্যক্তিরা মাঠে নামে এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায়। এরশাদ এসে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে বাংলাদেশের মৌলিক চেতনাকেই পাল্টে দেয়ার চেষ্টা করেন। দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা আবার দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম করছেন। কিন্তু সেই তাঁকেই যখন সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে আপস করতে দেখি, তখন হতাশ হই, ক্ষুব্ধ হই।
আশির দশক থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুটি ধারা স্পষ্ট হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক ধারার নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের হাতে। আর স্বাধীনতাবিরোধী, ইসলামী জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িক ধারার নেতৃত্বে আসে বিএনপি। একাত্তরেও এই ধারাটি বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছে। তখন ক্ষীণ হলেও পরে এই স্বাধীনতাবিরোধী ধারাটি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বেশ ফুলে ফেঁপে উঠে। তবে চলতে চলতে এই দুটি ধারা এখন মিলেমিশে একাকার। এখন আর আলাদা করার উপায় নেই। ভালো আর মন্দের পার্থক্য দ্রুতই ঘুঁচে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে ভালো আর মন্দ থেকে বেছে নেয়ার সুযোগ কমে যাবে, বেছে নিতে হবে মন্দের ভালো।
বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতির অনেক ধারা প্রচলিত। ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসাভিত্তিক ধারাটি বাংলাদেশে বিকশিত হয় কওমী মাদ্রাসা ঘিরে। বর্তমানে বাংলাদেশে এই ধারার প্রধান পুরুষ হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রধান আল্লামা শাহ আহমেদ শফি। ২০১১ সালে সরকার প্রণীত নারীনীতির প্রতিবাদে হেফাজতে ইসলাম নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলেন আল্লামা শফি। তবে হেফাজতে ইসলাম ও আল্লামা শফি আলোচনার কেন্দ্রে আসেন ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল ও ৫ মে। মূলত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে গড়ে ওঠা অভূতপূর্ব গণজাগরণ মঞ্চকে হেয় করতেই সুকৌশলে মাঠে নামানো হয় হেফাজতে ইসলামকে।
গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে শুরুতে বিএনপির অবস্থান ছিল চুপ থাকা। সরাসরি এমন একটি স্বতস্ফূর্ত গণজাগরণের বিপক্ষে অবস্থান নেয়া কঠিন ছিল বিএনপির জন্য। আবার যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে নৈতিক অবস্থানের কারণে বিএনপির পক্ষে গণজাগরণ মঞ্চকে সমর্থন করাও সম্ভব ছিল না। কিন্তু কৌশলে স্বাধীনতার পর দেশের সবচেয়ে মহৎ আন্দোলনের একটি গণজাগরণ মঞ্চকে ইসলামবিরোধী নাস্তিক-ব্লগারদের আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করে মাঠে নামানো হয় হেফাজতে ইসলামকে। তারা ১৩ দফা দাবি নিয়ে ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল ঢাকা ঘেরাও করে। বিপুল সমাবেশ দেখে বিএনপি নেতারা ভিন্ন স্বপ্ন দেখেন।
৬ এপ্রিলের সমাবেশে ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ৫ মে আবার ঢাকায় আসে হেফাজত। এবার তাদের লক্ষ্য আরো সুদূরে- গণজারগণ মঞ্চের মত রাজপথে অবস্থান নেয়া এবং সরকারের পতন ঘটানো। এমনকি সরকার পতনের পর কে কোন দপ্তরের মন্ত্রী হবেন, তার খসড়াও হয়ে যায়। দুরভিসন্ধি টের পেয়ে সরকার ৫ মে রাতেই হেফাজতের নেতাকর্মীদের মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে হটিয়ে দেয়। তারপর সরকারের বিরুদ্ধে হাজার হাজার আলেমকে হত্যা করে তাদের লাশ গায়েবের অভিযোগ আনা হলেও তা হালে পানি পায়নি।
৫ মে রাত পর্যন্ত বিএনপি ছিল হেফাজতের পক্ষে আর আওয়ামী লীগ ছিল গণজাগরণ মঞ্চের পাশে। গণজাগরণ মঞ্চ সরকারের পূর্ণ সহায়তায় রাজপথে টানা অবস্থান করছিল। সরকারের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গণজাগরণ মঞ্চকে সহায়তা করেছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও সংসদে গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষে তার অবস্থান ঘোষণা করেন।
হেফাজত ঢাকায় এসেছিল ‘নাস্তিক-ব্লগার’দের উৎখাতসহ ১৩ দফা দাবি নিয়ে। একটি দেশকে প্রগতি-অগ্রগতির রাজপথ থেকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়ার জন্য এই ১৩ দফার চেয়ে অশুভ-ভয়ঙ্কর কোনো দাবি হতে পারে না। এই সময়ে আল্লামা শফির ২৫ মিনিট ৩১ সেকেন্ডের একটি ওয়াজের ভিডিও ভাইরাল হয় ইউটিউবে।
আল্লামা শফি প্রতিবছর হেলিকপ্টারে ঘুরে ঘুরে দেশজুড়ে এমন শ’খানেক ওয়াজ করেন। তার মাত্র ২৫ মিনিটের এই বয়ানটি শুনলে আঁতকে উঠবেন সুস্থ চিন্তা-ভাবনার যে কোনো মানুষ। নারী তার কাছে নিছকই পণ্য, যাদের দেখলে আল্লামা শফির দিলে লালা ঝরে, তার ভাষায় যেমন তেঁতুল দেখলে লালা ঝরে মানুষের জিহবায়। তারপর থেকে আল্লামা শফি পরিচিত তেঁতুল হুজুর নামে। আর এই পরিচিতির জন্য সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর। তিনি দিনের পর দিন আল্লামা শফিকে তেঁতুল হুজুর বলে সম্বোধন করে এসেছেন। এমনকি সরকারের সাথে আল্লামা শফির সমঝোতার পরও হাসানুল হক ইনু বলেছেন, ‘তেঁতুল হুজুর গোষ্ঠি ধর্মবিরোধী চক্র।’
বর্তমানে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতির পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান গার্মেন্টস শিল্পখাতের। ভোরে গার্মেন্টস মুখে নারীদের পথচলা যেন অগ্রগতির মিছিল। অথচ আল্লামা শফি দেশকে পেছন থেকে টেনে ধরতে চান। গার্মেন্টসের নারী কর্মীদের তিনি গালি দেন জেনাকারী বলে। এখন বাংলাদেশের সব পর্যায়ে নারীরা পুরুষের পাশে পাশে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। অধিকাংশ পরীক্ষার ফলাফলে এগিয়ে থাকে মেয়েরা। ট্রেন থেকে ফাইটার প্লেন- সব চালাতে পারে নারীরা। জয় করতে পারে এভারেস্ট।
কিন্তু আল্লামা শফি মনে করেন, মেয়েরা ‘কেলাস ফোর-ফাইভ’ পড়লেই যথেষ্ট, যাতে তারা স্বামীর টাকা-পয়সার হিসাব রাখতে পারে, ছেলে সন্তানের লালন-পালন করতে পারে। সরকার যেখানে জন্মনিয়ন্ত্রণের পেছনে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে, সেখানে আল্লামা শফি অশ্লীল ভাষায় জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করেন।
বাংলাদেশ এখন নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বেরই উদাহরণ। আর সেই ক্ষমতায়নের ধারায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি এখন আর শুধু বাংলাদেশের নেতা নন, গোটা বিশ্বেই তার নেতৃত্ব প্রশংসিত। কিন্তু সেই শেখ হাসিনাকে যখন আল্লামা শফির পাশে শ্রদ্ধাবনত দেখি, তখন লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যায়। ২০১৩ সালে স্পষ্ট হওয়া বিভক্তিতে একটা ব্যাপার ছিল খুব মজার। যিনি ফজরের নামাজ আর কোরান পড়ে দিন শুরু করেন, সেই শেখ হাসিনাকে চিত্রিত করার চেষ্টা হয় নাস্তিকদের নেত্রী হিসেবে। আর যার দিন শুরু হয় দুপুরের পর সেই বেগম খালেদা জিয়া হলেন ইসলামী জাতীয়াতাবাদের নেত্রী। এই বৈপরীত্য ঘুঁচিয়ে শেখ হাসিনার এখন আপ্রাণ চেষ্টা ধর্মীয় গোষ্ঠির মন জয় করা।
আওয়ামী লীগের সাথে হেফাজতে ইসলামের সখ্যটা অবশ্য আজকের নয়। ২০১৩ সালের প্রবল বিরোধের পর থেকেই গোপন সমঝোতার শুরু। বিশেষ করে পাঁচ সিটি করপোরেশনে সরকারি দলের ভরাডুবির পর নতুন করে ভাবতে থাকে সরকারি দল। ব্যাপক উন্নয়ন কাজের পরও পাঁচ সিটি করপোরেশনে পরাজয়ের জন্য তখন হেফাজতের অপপ্রচারকে দায়ী করা হয়। এরপর থেকে গোপনে হেফাজতের সাথে যোগাযোগ চলতে থাকে। আদর্শিক অবস্থান উল্টো হলেও নানারকমের সুবিধা দিয়ে হেফাজতকে পোষ মানানো হয়। কিন্তু দুধ কলা দিয়ে পুষলেও যে বিষধর সাপ পোষ মানে না, এটা বুঝতে চান না কেউ কেউ।
সমঝোতার ধারায় ৫ মে’র তাণ্ডবের ঘটনায় দায়ের করা মামলার কোনো অগ্রগতি হয় না। ৫ মে রাতে হেফাজতীদের মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে তাড়িয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছিল সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের দৃঢ়তায়। আজ সৈয়দ আশরাফরা আওয়ামী লীগে আড়ালে চলে যান, আর হাছান মাহমুদদের ষড়যন্ত্রের জয় হয়। হেফাজতের সাথে সরকারের গোপন সমঝোতা এতদিন গোপনই ছিল। প্রথম আঘাতটা আসে এ বছরের জানুয়ারিতে পাঠ্যপুস্তকে। হেফাজতের দাবি একশভাগ মেনেই এবার পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হয়েছে। তারা যা বলেছে তা অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে; যা বলেছে, হুবহু তা বাদ দেয়া হয়েছে।
তাদের এই দাবি ছিল পুরোটাই ধর্মভিত্তিক। এ নিয়ে অনেক হইচই হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। প্রেস রিলিজ দিয়ে দাবি আদায় হয়ে গেলে আর মতিঝিলে সমাবেশ করতে হয় না। তাই হেফাজত একটু আড়ালেই ছিল এতদিন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গনে স্থাপিত নারী ভাস্কর্য অপসারণের দাবিতে হেফাজত আবার শাপলা চত্বরে আসার হুমকি দিচ্ছিল। তাদের টার্গেট ছিল গতবছর ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাওয়া পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাও।
প্রধানমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণের ‘মূর্তি’টি তিনিও চান না। আর এবার পহেলা বৈশাখের আগে পুলিশ এমন কড়াকড়ি আরোপ করে যে বর্ষবরণের আয়োজনে স্বতস্ফূর্ততা ছিল না। পুলিশ পারলে বলে দিতো, আপনারা বর্ষবরণে ঘরের বাইরে আসবেন না। এমনকি আওয়ামী লীগ এবার তাদের ঐতিহ্যবাহী শোভাযাত্রাও বাতিল করে। আমাদের শঙ্কাটাও এখানেই। তবে কি প্রতিক্রিয়াশীল হেফাজতই জিতে যাবে?
সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত ভাস্কর্যটি আমারও পছন্দ নয়। সেই অপছন্দ শৈল্পিক মান বিবেচনায়। আমি অত শিল্পবোদ্ধা নই, কিন্তু আমার চোখে ভালো লাগেনি। সেই বিবেচনায় যদি দেশের শিল্পীদের নিয়ে গঠিত কোনো কমিটি যদি এই ভাস্কর্য নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয় আমার আপত্তি নেই। আমি বরং অবিলম্বে এমন একটি কমিটি করে দেয়ার সুপারিশ করছি। যারা শুধু সুপ্রিম কোর্টের সামনের ভাস্কর্য নয়, ঢাকার সব ভাস্কর্যের ব্যাপারেই ভাববেন। ঢাকাকে একটি পরিকল্পিত শৈল্পিক নগরী হিসেবে গড়ে তুলবেন।
কিন্তু যেভাবে হেফাজতে ইসলামের দাবির কাছে নতিস্বীকার করে সুপ্রিম কোর্টের সামনের ভাস্কর্যের ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী, তা দুঃখজনক। আর হেফাজতের এই অবস্থান নতুন নয়। ২০১৩ সালে তাদের অশুভ ১৩ দফার ৭ নম্বর দাবিটি ছিল, ‘মসজিদের নগর ঢাকাকে মূর্তির নগরে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করা’। সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে ভাস্কর্য সরাতে পারলে এরপর নিশ্চয়ই তারা অপরাজেয় বাংলা, স্বোপার্জিত স্বাধীনতার দিকে আগাবে। কারণ তাদের মূল দাবি সব ভাস্কর্য অপসারণ। অথচ বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম দেশে চমৎকার সব ভাস্কর্য রয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, হেফাজতে ইসলামের সাথে আওয়ামী লগের কোনো জোট হয়নি। তথ্য হিসেবে একদম ঠিক। কারণ ১১ এপ্রিল গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে হেফাজতে ইসলামের নেতাদের বৈঠক হয়নি, বৈঠক হয়েছে কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক আলেম ওলামাদের সাথে। কিন্তু কওমি মাদ্রাসার প্রধান আল্লামা শফি একইসঙ্গে হেফাজতের প্রধান। আর সরকার যেভাবে কওমী মাদ্রাসার আলেমদের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেছে, তা দুঃখজনক। দেশে প্রায় ১৪ হাজার কওমী মাদ্রাসায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থী আছে। এরা সরকারের সব ধরনের নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির বাইরে। আমি দীর্ঘদিন ধরে এই কওমী মাদ্রাসাকে সরকারের কোনো না কোনো কাঠামোর মধ্যে আনার দাবি জানাচ্ছি।
কারণ কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও আমাদেরই সন্তান। দেশের এতিম ও গরিব পরিবারের সন্তানরাই কওমী মাদ্রাসায় পড়ে। যাদের জীবনের লক্ষ্য বড় হুজুর হওয়া। কওমী মাদ্রাসায় জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় না। কারণ তারা মনে করে ‘চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস’ বলাটা শিরক, কারণ আকাশ-বাতাস সব আল্লাহর। এই ১৪ লাখ শিক্ষার্থীই আল্লামা শফির অস্ত্র। এদের ইচ্ছামত মাঠে নামিয়েই তারা দাবি আদায় করতে চায়। কিন্তু কওমী মাদ্রসার শিক্ষার্থীদের কোরআন-হাদিসের পাশাপাশি তাদের উন্নত ও জীবনমুখী শিক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের। যাতে কওমী মাদ্রাসার বাইরের জগতটাও তারা দেখতে পায়, চিনতে পারে।
এ ব্যাপারে বর্তমান সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কওমী মাদ্রাসাকে একটি কাঠামোর মধ্যে আনতে ২০১২ সালেই তারা একটি কমিশন গঠন করেছিল। সে কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন আল্লামা শফি, কো চেয়ারম্যান ছিলেন মাওলানা ফরিদউদ্দিন মাসউদ। মাওলানা মাসউদ সরকারি নিয়ন্ত্রণসহ কওমী মাদ্রাসাকে কাঠামোর মধ্যে আনার যে সুপারিশ করেছিলেন, শফিপন্থিরা তা প্রত্যাখ্যান করে এবং এ সুপারিশ বাস্তবায়ন করলে লাখ লাখ লাশ পড়বে বলে হুমকি দেয়। তারপর বিষয়টি আর এগোয়নি। ৫ মে’র পর তো আর এগোনোর সুযোগও ছিল না। শেষ পর্যন্ত কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা তাদের সনদের স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছেন বটে, তবে তাতে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকছে না।
আল্লামা শফিরা কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের পৃথিবী থেকে আড়াল করেই রাখতে চান। যেভাবে চেয়েছিলেন, ঠিক সেভাবেই স্বীকৃতি পেয়েছেন তারা। দীর্ঘদিন ধরে হেফাজত ও জঙ্গীবিরোধী অবস্থান নিয়ে সরকারের পাশে থাকা মাওলানা মাসউদকে কোনঠাসা করে কওমী মাদ্রাসার পুরো নিয়ন্ত্রণ দিয়ে দেয়া হয়েছে কট্টরপন্থি শফিদের হাতে। সরকারি প্রজ্ঞাপনের পর কওমী মাদ্রাসার স্বীকৃতি বাস্তবায়নে যে ৩২ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে, তার ২২ জনই হেফাজতপন্থি।বাকি ৫টি কওমী বোর্ড থেকে নেয়া হয়েছে দুজন করে। কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের পিইসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি, অনার্স সমমানের কোনো পরীক্ষা বা সনদ নেই। তাদের একমাত্র সনদ হবে মাস্টার্স সমমানের।
সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রায় ২০ বছর পড়ে দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে মাস্টার্স সনদ পাবে, আর কওমী মাদ্রাসার একজন শিক্ষার্থী মাত্র ১৪ বছর পড়েই পেয়ে যাবে সমমানের দাওরায়ে হাদিস সনদ। দুটি সনদ সত্যিই সমমানের হবে? রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া এই সনদ কি আসলেই কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের কোনো কাজে লাগবে?
এটা ঠিক, শেখ হাসিনা শুধু আওয়ামী লীগের প্রধানমন্ত্রী নন, দেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রধানমন্ত্রী। কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও তার বাইরে নয়। সবার যৌক্তিক দাবি মেনে নেয়া অবশ্যই সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু যে কারো অযৌক্তিক দাবির কাছে নতিস্বীকার সরকারের দুর্বলতাকেই চিহ্নিত করে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, বড় যুদ্ধ জয়ের জন্য কখনো কখনো পিছিয়ে আসতে হয়। তারা বলছেন, এটা আপস নয়, সাময়িক কৌশলমাত্র। কৌশলটা বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না। শেখ হাসিনা তার শত্রুদেরও দূরে না রেখে চোখের সামনে রাখতে পছন্দ করেন। মন্ত্রিসভার, এমনকি দলের অনেকেও তাঁর বন্ধু নয়। জেনেশুনেই তিনি তাদের সামনে রাখেন। কিন্তু সেই কৌশল আর মৌলবাদী গোষ্ঠির সব দাবি মেনে তাদের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করা এক কথা নয়। বিএনপি জামায়াতের সাথে জোট করলে সেটা যদি আপস হয়, আওয়ামী লীগ হেফাজতীদের সাথে সমঝোতা করলে সেটা কৌশল হবে কেন?
আমাদের বড় দুই দলের ভোটের হিসাবে এভাবে মূলধারায় টিকে থাকে কখনো রাজাকার, কখনো স্বৈরাচার, কখনো হেফাজত। বুঝতে অসুবিধা হয় না, সব কৌশলই ভোটের। এতদিন আমরা বলতাম, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। এখন দেখছি, রাজনীতিতে শেষ কথা ক্ষমতা। এখানে এখন আর নীতি-আদর্শ বলে কিছু নেই। তবে হেফাজতের সাথে সমঝোতার আগে ভোটের হিসাবটাও আরো ভালো করে মিলিয়ে নিতে পারতেন শেখ হাসিনা। ২০১৩ সালের দুটি বড় সমাবেশ দেখে হেফাজতে ইসলামকে যত শক্তিশালীই মনে করা হোক না কেন, ভোটের মাঠে তাদের অবস্থান ততটা শক্ত নয়। আর যত ঘুষই দেয়া হোক হেফাজতের ভোট কখনো আওয়ামী লীগের বাক্সে পড়বে না, এটা নিশ্চিত।
বরং এই সমঝোতার মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক মানুষদের, যারা আওয়া্মী লীগের সহজাত ভোটার, তাদের সমর্থন হারানোর ঝুঁকিটা নিলেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে যে চেতনায়, যে স্বপ্নে স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ; হেফাজতের স্বপ্নের বাংলাদেশ তার পুরো উল্টো। এখন বিশ্বকে চমকে দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সমৃদ্ধির যে রাজপথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, হেফাজত তাকে আটকে দিতে চায়, পিছিয়ে নিতে চায়। সরকারের এ সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ, ব্যথিত প্রগতিশীল মহল। দীর্ঘদিন আওয়া্মী লীগের সমর্থক হিসেবে পরিচিত বুদ্ধিজীবীরাও সরকারের এ অবস্থানের বিরুদ্ধে সোচ্চার। এমনকি মন্ত্রিসভার তিনজন সদস্যও এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন।
হেফাজতের বিশাল সমাবেশ দেখে যদি সরকার তাদের সাথে সমঝোতা করতে প্রলুব্ধ হয়ে থাকে, তাহলে গণজাগরণ মঞ্চকে ভুলে গেল কেন? গণজাগরণ মঞ্চে তো হেফাজতের চেয়ে বেশি লোক সমাবেশ হয়েছিল। আর গণজাগরণ মঞ্চে যারা এসেছিলেন, তারা তো আওয়ামী লীগের উপায়হীন সহজাত সমর্থক। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ যদি মনে করে থাকেন, গণজাগরণ মঞ্চ আর হেফাজতের ভোট একসাথে নৌকার বাক্সে পড়বে, তাহলে ভুল করবেন। তেলে জলে কখনো একসাথে মেশে না।
সুন্দরবনের কাছে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরোধিতা করছেন বামদের একটি অংশ। সরকারের একটি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের প্রশ্নে এরাও শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের পাশেই থাকে, থাকবে। কিন্তু সুন্দরবন বাঁচানোর দাবিতে তারা রাস্তায় নামলেই পুলিশ চড়াও হয়। আর যারা সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র করে, তাদের সাদরে বরণ করা হয় গণভবনে। হায় ক্ষমতা!
জামায়াতের সাখে জোট করে বিএনপি যেমন অনেক ভোট হারিয়েছে, হেফাজতের সাথে সমঝোতা করে আওয়ামী লীগও তেমনি অনেক ভোট হারাতে পারে। আর আল্লামা শফি তো বাংলাদেশে ইসলামের লিজ নেননি। বাংলাদেশে আরো অনেক গোষ্ঠি আছে, যারা ধর্মের নামে রাজনীতি করে। ইতিমধ্যে আহলে সুন্নাত জামাত কওমী শিক্ষার সনদের স্বীকৃতির প্রাতিবাদে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, অথচ এরা এতদিন আওয়ামী লীগের পাশেই ছিল।
ত্বরীকত ফেডারেশনও আওয়ামী লীগের সাথেই আছে। কিন্তু তারাও হেফাজতের বিপক্ষে। তাই হেফাজতেকে কাছে টানলে ইসলামী অনেক শক্তিও দূরে সরে যেতে পারে। তাই হেফাজতকে পাশে টানার আগে ভোটের যোগ-বিয়োগের হিসাবটা আরেকবার মিলিয়ে নিলে ভালো করতেন শেখ হাসিনা।
যোগ-বিয়োগের হিসেবে ভোট যদি বাড়েও, তবুও দলের নীতি-আদর্শ বিসর্জন দিয়ে, দীর্ঘদিনের লালিত, অর্জিত সুনাম বিসর্জন দিয়ে আদর্শের বিপরীত লোকজনের সাখে কৌশলের কারণে সমঝোতা করাও ঠিক নয়। এক মঞ্চে নিজামীর সাথে শেখ হাসিনার এক ছবি নিয়ে বিএনপি বছরের পর বছর ধরে রাজনীতি করছে। আল্লামা শফির সাথে শেখ হাসিনার ছবিও নিশ্চয়ই আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেই যাবে। ইতিমধ্যে বেগম খালেদা জিয়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার অভিযোগ এনেছেন।
ভালো-মন্দের ব্যবধান দ্রুত ঘুচে যাচ্ছে এটা ঠিক। তবে এখনও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের প্রশ্নে, বাঙ্গালি সংস্কৃতির বিকাশের প্রশ্নে শেষ ভরসা শেখ হাসিনাই। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেই প্রাণখুলে জয়বাংলা স্লোগান দেয়া যায়, বঙ্গবন্ধুর গল্প করা যায়। কিন্তু যে বাংলাদেশে হেফাজতের দাবি মেনে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হয়, শর্তহীনভাবে কওমী সনদের স্বীকৃতি দেয়া হয়, সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে ভাস্কর্য সরানোর সিদ্ধান্ত হয়; সে বাংলাদেশ আমাদের নয়।
হেফাজতের সাথে সমঝোতার দুদিন পরই কিন্তু শেখ হাসিনাকে দেখা গেছে চেনা রূপে। পহেলা বৈশাখে গণভবনে বর্ষবরণের আয়োজনে শেখ হাসিনা শিল্পীদের সাথে গলা মিলিয়েছেন, গেয়েছেন ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে...’। শেখ হাসিনা আসলে মধ্যবিত্ত বাঙালির আসল রূপ- একইসঙ্গে ধর্মপ্রাণ এবং অসাম্প্রদায়িক, অন্তরে লালন করেন বাঙালি সংস্কৃতি। নামাজ ও কোরান পড়ে দিন শুরু করেন, তেমনি রবীন্দ্রসঙ্গীতেও আশ্রয় খোঁজেন।
১৪ এপ্রিলের শেখ হাসিনা যতটা চেনা, ১১ এপ্রিলের শেখ হাসিনা ততটাই অচেনা। ১৯৭৫ এর পর আওয়ামী লীগ ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে ছিল। কিন্তু আদর্শে অটল ছিল বলেই আওয়ামী লীগ টিকে থাকতে পেরেছে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার তৃণমূল নেতাকর্মীরা ধরে রেখেছেন সংগঠন। জনগণ ভোট না দিলে আবার ক্ষমতার বাইরে যাবে। এটাই গণতান্ত্রিক রীতি।
কিন্তু যেনতেন ভাবে ক্ষমতায় থাকতে মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করলে আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগ থাকবে না, ফিরে যাবে আওয়ামী মুসলিম লীগ আমলে। বঙ্গবন্ধু কন্যার হাতে নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের এত বড় ক্ষতি হবে না।
লেখাটি শেষ করছি আওয়ামী লীগ সম্পর্কে আহমদ ছফার একটি ঐতিহাসিক উক্তি দিয়ে, ‘আওয়ামী লীগ যখন জিতে, তখন শুধু আওয়ামী লীগই জিতে; যখন হারে, তখন বাংলাদেশ হারে।’
লেখক : সাংবাদিক, কলাম লেখক; বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ।
probhash2000@gmail.com