আর্কাইভ  শুক্রবার ● ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ● ৬ বৈশাখ ১৪৩১
আর্কাইভ   শুক্রবার ● ১৯ এপ্রিল ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: পলাশবাড়ীতে আসামির ছুরিকাঘাতে বাদীর মৃত্যু, গ্রেফতার ১       মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সন্তান-স্বজনের ভোটে না দাঁড়ানোর নির্দেশ       ভোজ্যতেলের দাম বাড়ল, খোলা তেলে সুখবর       বিএনপি নেতা সোহেলের নিঃশর্ত মুক্তি দাবিতে রংপুরে  মানববন্ধন ও সমাবেশ        খরার ঝুঁকিতে রংপুর অঞ্চল      

 width=
 

অজস্র আত্মার আহাজারি রংপুরের দমদমা বধ্যভূমিতে

সোমবার, ৩০ এপ্রিল ২০১৮, দুপুর ১১:৩১

ফরহাদুজ্জামান ফারুক: আজ ৩০ এপ্রিল। দমদমা ব্রীজ বধ্যভূমি দিন। ১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে কারমাইকেল কলেজ ক্যাম্পাসে অতর্কিতভাবে ঢুকে পড়লো পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কনভয়। গভীর রাতে গাড়ির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া ক্যাম্পাসের শিক্ষক কোয়াটার্সগুলোর বাসিন্দারা ভীত সন্ত্রস্ত। কোথাও কোন শব্দ নেই। গভীর রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে শঙ্কিত ক্যাম্পাসবাসী শুনতে পারলো হানাদার বাহিনীর বুটের শব্দ। গাড়ি থেকে নেমে মুখ বাঁধা কয়েকজন অবাঙ্গালী চিনিয়ে দিলো হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষকদেরকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এক এক করে ধরে নিয়ে আসা হলো অধ্যাপক সুনীল বরণ চক্রবর্তী, অধ্যাপক রামকৃষ্ণ অধিকারী, অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন রায় এবং অধ্যাপক কালাচাঁদ রায়কে। শুরু হলো রাইফেলের বাট দিয়ে বেধড়ক পিটুনি। অধ্যাপক কালাচাঁদ রায়ের সহধর্মিণী মঞ্জুশ্রী রায় সহ্য করতে পারলেন না তাঁর পতিসহ অন্যান্য শিক্ষকদের উপরে এমন অমানুষিক নির্যাতন। এক ছুটে তিনি বেরিয়ে আসলেন এবং সাথে সাথে ঘাতকের দল তাঁকেও রেহাই দিলো না। রাইফেলের বাট দিয়ে মারধোর, বুট পড়া পায়ের লাথি মারতে মারতে সবাইকে টেনে হিঁচড়ে তোলা হলো গাড়িতে। রাতের নিস্তব্ধতায় আবারও গাড়ির ইঞ্জিন চালুর শব্দ ভেসে আসতে লাগলো। এক সময় সেই শব্দ আর শোনা গেলো না। পাকিস্তানী হানাদারদের কনভয় ক্যাম্পাস ত্যাগ করেছে। এদিকে শিক্ষকদের বাড়িগুলো থেকে ভেসে আসতে থাকলো মরা কান্না। আস্তে আস্তে একজন একজন করে বের হয়ে আসলো ক্যাম্পাসের বাসিন্দারা। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আবারও কান্না। যেন একজন আরেকজনকে সাহস দিয়ে যাচ্ছেন। এরপর কারমাইকেল কলেজের ক্যাম্পাস থেকে মিলিটারিদের গাড়ি বের হয়ে এগিয়ে চললো রংপুর-বগুড়া মহাসড়ক ধরে। প্রায় দেড় মাইল যাওয়ার পরে দমদমা ব্রীজ এর কাছে গিয়ে হানাদারদের কনভয় থামলো। রাস্তা সংলগ্ন একটি বাঁশের ঝাঁরে নিয়ে যাওয়া হলো হাত পিছ মোরা করে বাঁধা শিক্ষকদের। দাড় করিয়ে দেওয়া হলো সারিবদ্ধভাবে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই গর্জে উঠলো হানাদারদের রাইফেল। মুহূর্তের মধ্যে লুটিয়ে পড়লেন কারমাইকেল কলেজের শিক্ষক অধ্যাপক সুনীল বরণ চক্রবর্তী, অধ্যাপক রামকৃষ্ণ অধিকারী, অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন রায়, অধ্যাপক কালাচাঁদ রায় এবং তাঁর সহধর্মিণী মঞ্জুশ্রী রায়। মৃতদেহগুলি সেখানেই রেখে চলে গেলো মানুষরুপী হানাদার বাহিনীর গাড়ি বহর। এলাকার লোকজন যারা গুলির শব্দ শোনার পর সারা রাত অজানা আশংকায় ভীত সন্ত্রস্ত বিনিদ্র রাত কাটিয়েছেন, পরদিন সকালে তাঁরা বাইরে বেরিয়ে আসলেন। বাঁশের ঝাড়ের কাছে গিয়েই থমকে দাঁড়ালেন তাঁরা। একজনের উপরে আর একজন এমনভাবে পড়ে রয়েছে কয়েকটি লাশ। কারোরই আর বুঝতে বাকি থাকলো না। দেশের শিক্ষিত কোন বাঙ্গালীকেই রেহাই দেবে না হানাদারের দল। সবাই বুঝতে পারলেন মানুষ হত্যার নেশায় উন্মত্ত পাকিস্তানীরা আর মানুষ নেই। খুনের নেশায় তারা হয়ে গেছে হিংস্র হায়েনা। নিজ বাসাতেই যেন অবরুদ্ধ হয়ে পড়লো এই অঞ্চলের দেহাতী মানুষগুলো। এভাবেই ৩০ এপ্রিলের মতো ভয়ঙকর ভীত আর অজানা অশঙ্কায় কাটতে থাকে রাতের পর রাত। অভিযোগ রয়েছে, সেদিন কারমাইকেল কলেজের শিক্ষক-পত্মীকে হত্যায় নেতৃত্ব দেয় আল-বদর বাহিনীর রংপুর শাখার কমান্ডার ও জামাতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের (বর্তমানে ছাত্রশিবির) রংপুর জেলা কমিটির তৎকালীন সভাপতি জামায়াত নেতা ও যুদ্ধাপরাধ মামলায় বিচারাধীন এটিএম আজহারুল ইসলাম। এদিকে ৩০ এপ্রিলের দমদমা ব্রীজের কোল ঘেষে ঘটা সেই ঘটনায় শহীদ শিক্ষকসহ মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদ ও সম্রমহানির শিকার নারীদের আজ গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছে রংপুরের মানুষ। পাশাপাশি আবারো মানবরূপী দানবকুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী এটিএম আজহারুলের ফাঁসির দাবি তুলেছে শহীদ পরিবার ও আজহারুলের নিজ গ্রাম বদরগঞ্জের মানুষ। এদিকের ৩০ এপ্রিলের ঘটনার রেশ না কাটতেই ৭ জুন দমদমা এলাকার মানুষ আবারও রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে হটাত করে শুনতে পারলেন গুলির শব্দ। একটি দুইটি নয়, থেমে থেমে সারা রাত ধরেই শোনা গেলো গুলির শব্দ এবং মৃত্যুর মুখে দাঁড়ানো একদল মানুষের আহাজারি। কয়েকজন দুঃসাহসী মানুষ চুপি চুপি ঝোপ জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে থেকে দেখলেন পাক হানাদারদের কনভয়ের সাথে তিনটি ট্রাক এসে থামলো দমদমা ব্রীজের পশ্চিম পাশে। ট্রাকগুলো থেকে নামিয়ে আনা হলো দুই শতাধিক সাধারণ মানুষকে। লাইন করিয়ে দাঁড় করিয়ে খুনের নেশার অমানুষ বনে যাওয়া পাক হানাদার বাহিনীর হাতের অস্ত্রগুলো গর্জে উঠলো। অজস্র মানুষের আহাজারি এবং গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢলে পরা। এমন করে প্রায় দেড় ঘণ্টা ব্যাপী চললো নির্মম ও বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ। অবশেষে চলতে শুরু করলো মিলিটারিদের গাড়িগুলো। একদল নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে হত্যা করে ফিরে গেলো হানাদারেরা। তাদের চোখে মুখে পৈশাচিক উল্লাস। স্থানীয় লোকজনের কাছে পরে জানা যায়, যাদের হত্যা করা হয়েছে তাঁরা কেউই ঐ অঞ্চলের বাসিন্দা না। ধারণা করা হয় বাহিরের থেকে তিনটি ট্রাক ভর্তি বাঙ্গালীকে এই নির্জন এলাকায় এনে হত্যা করা হয়। এই শহীদদের সম্পর্কে পরে বিস্তারিত কোন তথ্যই সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতার বেশ কিছুদিন পরে ঐ বাঁশ ঝাড় সংলগ্ন একটি পার্কের মতো করা হয়েছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী নব্বই এর দশকের মাঝের দিকে এসে ঐ পার্ক ভেঙ্গে ফেলা হয়। রংপুরের অসংখ্য বধ্যভূমির মধ্যে রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের দমদমা ব্রীজ সংলগ্ন এই বধ্যভূমিতে কয়েক বছর আগে একটি স্মৃতি ফলক নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু অবহেলায় অযত্মে এখনও সার্বজনীন হয়ে উঠতে পারেনি এই বধ্যভূমি। মূলত কারমাইকেল কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাই ৩০ এপ্রিল এবং ১৪ ডিসেম্বরসহ বিভিন্ন দিবসে নাম না জানা শত শহীদদের শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে এখানে ছুটে আসেন। এছাড়া সম্প্রতি কারমাইকেল কলেজে শহীদ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের স্মরণে তাঁদের নাম উল্লেখ করে একটি স্মৃতি ফলক নির্মাণ করা হয়েছে।

মন্তব্য করুন


 

Link copied