জনমতকে প্রভাবিত করার ‘কঠিন মতাদর্শিক সংগ্রামের পথ’ এড়িয়ে জনমতকে গুরুত্ব দিয়ে জনপ্রিয়তার শর্টকার্ট রাস্তা নিতে হবে। তিনি তাই করেছেন। এটা করে নিশ্চয়ই তিনি সাফল্যও পাবেন!
আসলে আমাদের রাজনীতিতে ধর্ম, বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রুপ গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টরে পরিণত হয়েছে। এখানে মাদ্রাসার ছাত্রশিক্ষকরা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। এখানে বিভিন্ন ধর্মীয় দলগুলো গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। জামায়াত ফ্যাক্টর, হেফাজত ফ্যাক্টর। সরকার আপাতত জামায়াতের পরিবর্তে হেফাজতকে রানিংমেট হিসেবে পাবার চেষ্টা করছে।
এতে করে দেশে অসাম্প্রদায়িক উদার রাজনীতির হয়তো ক্ষতি হবে, কিন্তু আওয়ামী লীগের লাভ তো হবেই। আগামীতে যেন-তেন একটা নির্বাচন আয়োজন করে ক্ষমতায় টিকে থাকার খেলায় এই কাঠমোল্লাদের সমর্থন চাইবে। সরকার যেভাবে হেফাজতিদের দাবি-দাওয়া বাস্তবায়ন করছে, তাতে তারা নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যাবে না! আওয়ামী লীগ অন্তত তাই আশা করে!
আসলে আমাদের আমাদের প্রিয় বাংলাদেশটা সবার অলক্ষ্যে একটু একটু করে বদলে গেছে। গত তিন দশকে সেই চিরচেনা বাংলাদেশটা একবারে পাল্টে গেছে। বাংলাদেশে এখন যত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়, তার চেয়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয় অনেক বেশি। রাস্তঘাটে তাকালে মনে হয়, আমরা কোনো ধর্মরাষ্ট্রে আছি! দেশজুড়ে কেবল ধর্মভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মকেন্দ্র, সবখানে ধর্মপালনকারী মানুষের সদম্ভ পদচারণা!
মানুষ ধর্মমুখী হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ব্যক্তিগত লাভ-লোভকে কেউ এতটুকু বিসর্জন দিয়েছে বলে মনে হয় না। দেশে দুর্নীতি বেড়েছে। নারী নির্যাতন, চুরি-ডাকাতি অনিয়ম অনাচার মাহামারির মতো ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। আবার ধর্মচর্চার সমারোহও বেড়েছে! তার মানে এই ‘ধর্মচর্চাকারী’রা একটি বিশেষ উদ্দেশ্য থেকে ধর্ম পালন করেন।
এটাকে অনেকেই বলেন, ‘রাজনৈতিক ধর্ম!’ সব অপকর্ম করে ধর্ম পালন করেন, স্রেফ মুখোশের জন্য, নিজেকে বিরাট ধার্মিক প্রমাণের জন্য!
এখন বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের মননেও ধর্ম। কোনো একটা প্রগতিশীল ইস্যু নিয়ে কিছু একটা লিখলে তেমন কেউ আমলে নেয় না। কিন্তু ধর্ম নিয়ে কিছু লিখলেই সবাই কেমন তেড়েফুঁড়ে উঠে। বিভিন্ন অনলাইনে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন ও লেখার নিচে মন্তব্য দেখলেই বোঝা যায়, আমরা আসলে কোন স্বর্গে আছি!
বেশিরভাগ মন্তব্যকারীই ধর্ম, ধর্মীয় অনুশাসন, ধর্মীয় বিধানের মাধ্যমে সব ধরনের সামাজিক-রাষ্ট্রীয় ব্যাধির নিদান খোঁজে।
আসলে আমরা কিছু মানুষ এখনও যে স্বপ্নের বাংলাদেশকে খুঁজে ফিরি তা একটু একটু করে আমাদের সকলের অলক্ষ্যে লুট হয়ে গেছে। এই দেশে ধর্ম, ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি, ধর্মীয় লেবাস, ধর্মীয় ধ্যানধারণা সব কিছু পুরো সমাজকে গ্রাস করেছে।
আমরা ছোটবেলায় দেখেছি, ধর্মপালন নিয়ে কারও মধ্যে কোনো বাড়াবাড়ি ছিল না। মানুষ নীরবে-নিভৃতে ধর্মপালন করত। অন্যকে তো নয়ই, নিজের সন্তানকে পর্যন্ত অভিভাবকরা ধর্মপালনের ব্যাপারে পীড়াপীড়ি করত না। যে যার ইচ্ছে ও মর্জিমাফিক ধর্মপালন করত। এলাকার ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলো অল্পকিছু মানুষের পদধূলিধন্য ছিল।
আশির দশক থেকেই দেশে ভিন্ন সংষ্কৃতির চাষাবাদ শুরু। সমাজের কিছু কিছু মানুষ জীবিকার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমায়। সেখান থেকে দেশে ফিরে তারা উপার্জিত অর্থের সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার সংস্কৃতিও কিছুটা নিয়ে আসে।
এই মধ্যপ্রাচ্যফেরৎ ব্যক্তিরা ক্রমেই সমাজে প্রভাবশালী ব্যক্তিতে পরিণত হন। তারা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি এবং বাড়ির নারী সদস্যদের উপর ধর্মীয় লেবাস চাপিয়ে দেন। তাদের হুজুগে ও পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মের সামাজিক চর্চা ও এর রাজনৈতিক ব্যবহার বেড়ে যায়। পেট্রো-ডলার রাজনৈতিক ধর্ম পালন ও চর্চায় বিরাট ভূমিকা পালন করে।
একবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবী যখন দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে, আমাদের দেশে তখন চলছে উল্টোযাত্রা। কোথায় ছেলেমেয়েরা জ্ঞানের আলোর মুখ দেখবে, সেখানে তাদের হাতছানি দিয়ে পিছু ডাকছে আদিম অন্ধকার। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবকালেই ধর্ম একটা ফ্যাক্টর। আজও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। কবে ঘটবে তাও কেউ বলতে পারে না।
৭৫-এর পট পরিবর্তন, জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখল, বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে স্বাধীনতা বিরোধীদের পুনর্বাসন আবারও স্বাধীনতাবিরোধীদের দৌরাত্ম্য বাড়িয়ে দেয়। গ্রামে গ্রামে ওয়াজ মাহফিল ধর্মসভার আড়ালে রাজাকার সাঈদীকে দিয়ে জনসভা করায় জামায়াত।
ধর্মের বাণী শুনিয়ে, শ্রোতাদের মন গলিয়ে তাদেরকে দিয়ে দিয়ে ওয়াদা করিয়ে নেওয়া হয়, দাড়িপাল্লা ছাড়া অন্যকিছুতে যেন ভোট না দেয়। ফলও পায় জামাত। সেসময়কার বৃহত্তর যশোর, কুষ্টিয়া আর সাতক্ষীরার সীমন্তবর্তী আসনগুলোর এমপিদের অনেকেই ছিল জামায়াতি।
রাজনৈতিক ঘটনা পরম্পরায় এরপর আওয়ামী লীগকে হটাতে জামাতসহ তিনটি ছোটদল নিয়ে চার দলীয় জোট গঠন করে বিএনপি। তখন থেকেই আবার শুরু হয় জামায়াতের দৌরাত্ম্য। ওয়াজ মাহফিল করে, ধর্মের দোহাই দিয়ে নিরীহ সাধারণ মানুষকে জামাতে ভেড়ানোর চেষ্টা করে।
পরে নতুন যেটা করে, সেটা হলো নারীদের ব্যবহার। দেশকে কব্জায় নিতে তারা বিশেষ কৌশল গ্রহণ করে। গঠন করে জামায়াতি নারীদল। বিশেষ করে গামাঞ্চলে, শহরতলি এলাকায়। এরা মাথায় হিজাব পরে, ধর্মীয় বই পুস্তক নিয়ে পাড়ায় গৃহিনীদের তালিম দেয়।
সপ্তাহে দুদিন একটা নির্দিষ্ট বাড়িতে পাড়ার মহিলাদের নিয়ে মজলিশ বসায়। ধর্মের বাণী শোনানো হয় তালিমে, ধর্মের রীতিনীতি, স্বামীর প্রতি, শ্বাশুড়িদের প্রতি বউদের কী কর্তব্য তা শেখানো হয়। দোজখের ভয়াবহ আজাবের কথা আর ইসলামের করুণ কাহিনী শুনে মন সিক্ত হয়ে যায় সরলা গৃহিনীদের। চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি ফেরে। সহজ-সরল বাঙালি বধূদের এই দুর্বলতা তালিমকারীরা কাজে লাগায় শতভাগ।
দেশে আজ ইসলাম হুমকির মুখে, ইসালামী নেতাদের জেলে পুরে ফাঁসি দিয়ে দেশকে কাফির রাষ্ট্রে পরিণত করছে সরকার--তালিমের আসরে চলে এমন বক্তব্যও। সরলা নারীরা ভাবে, সত্যিই তো, যেসব মানুষগুলো সারাদেশে ওয়াজ নসিয়ত করত, মানুষকে দীন ইসলামের পথে আসার আহবান জানাত, তারাই কিনা আজ ফাঁসির দড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। এ অন্যায়, মহা অন্যায়। এর সমাধান কী?
তালিমকারী তাদের বোঝায় মোমিন মুসলমানদের এক হতে হবে, ইসলামের শক্তি বাড়াতে হবে। একমাত্র জামাত ছাড়া আর কোনও দল ইসলাম মানে না। তাই ইসলামকে রক্ষা করতে হলে জামাতে যোগ দিতে হবে, দাড়িপাল্লায় ভোট দিতে হবে।
সহজ-সরল গ্রাম্যবধুরা তাদের এই চাতুরি বোঝে না, ওয়াদা করে আসে জামাতে ভোট দেবে। তারপর তারা তালিমকারীদের শিখিয়ে দেয়া কথাগুলো স্বামীর কাছে পাড়ে। কোনও কোনও স্বামী স্ত্রীর কথায় খুঁজে পায় যুক্তি। নিজেও তওবা করে আগের দল ছেড়ে জামায়াতে যোগ দেয়। যোগ না দিলেও মনোভাবটা বদলে যায়।
জামায়াত-শিবিরের তালিম কর্মকাণ্ডের প্রভাবে বাংলাদেশ আজ বদলে যেতে বসেছে। এভাবে চলতে থাকলে সহজ-সরল বাঙালিদের একটা বিরাট অংশকে ধর্মের দোহাই দেখিয়ে নিজেদের করে নেবে না তার নিশ্চয়তা কী? বিএনপির মতো আওয়ামী লীগও যে তাদের গ্রাম্য ভোটার জামায়াতের কাছে খোয়াবে না সেকথা কি জোর দিয়ে বলা যায়?
আওয়ামী লীগ জামায়াতকে বাদ দিয়ে হেফাজতকে রাজনৈতিক মিত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে। আদর্শগতভাবে এই দুই দলের তেমন কোনো তফাৎ খুঁজে পাওয়া যায় না। উভয়ই মৌলবাদী। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত বলেছিলেন, 'মৌলবাদী জঙ্গিরা মাও সেতুংয়ের কায়দায় গ্রাম দখল করার পরিকল্পনা নিয়েছে।
চলতি বছরে মৌলবাদীরা দেশের ৪০০ গ্রামে একসঙ্গে ইজতেমা করেছে ২০১৭ সালে তারা ২০ হাজার গ্রামে ইজতেমা করবেন এবং অচিরেই পুরোদেশের গ্রামগুলো তারা দখল করে নেবে'।
হ্যাঁ, এই প্রক্রিয়ায় গ্রাম দখল করার অভিযানে মৌলবাদী শক্তিগুলো অনেকটাই এগিয়ে গেছে। এখন তাদের সঙ্গে সন্ধি না করলে টিকে থাকা যাবে না। আওয়ামী লীগ আপাতত হেফাজতনির্ভর হয়ে ‘রাজনৈতিক ধর্ম’ পালনের পথে এগিয়ে চলছে।
এই দেশে ধর্ম বাদ দিয়ে, ধর্মীয় দল বাদ দিয়ে আর রাজনীতি হবে না। শেখ হাসিনা তা বুঝেছেন। বুঝেছেন বলেই সময় থাকতেই নিজের সমর্থন ও গন্তব্যও ঠিক করে নিয়েছেন। আমরাই আসলে আহাম্মক। আহাম্মক বলেই অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিয়ে এখনও বেহুদা চিৎকার করি!
চিররঞ্জন সরকার : লেখক, কলামিস্ট।
chiroranjan@gmail.com