তপন মাহমুদ
তবে বড়লোক অর্থমন্ত্রী এবার হিসাবে একটু গড়মিল করে ফেললেন। হাজার হাজার কোটি টাকার হিসাব যার কাছে ডাল-ভাত, তার কাছেই কি না ব্যাংকে রাখা এক লাখ টাকার মালিকদের বিশাল সম্পদশালী মনে হলো। তাইতো এই টাকার ওপর আবগারি শুল্ক বসিয়ে দিলেন তিনি। এক লাখ টাকার ওপর ব্যাংকে থাকলেই ৮০০ কেটে নেবে রাষ্ট্র। কিন্তু জনগণ কি তার এই সিদ্ধান্ত মানে! চারদিকে প্রতিবাদের ঝড় উঠল।
মন্ত্রীরা সাধারণ মানুষের প্রতিবাদকে সহজে গাঁয়ে মেখেছে এমন নজির খুব বিরল, অন্তত আমাদের দেশে। কিন্তু খোদ নিজের দলের সংসদ সদস্য, মন্ত্রীদের কাছ থেকে এমন সমালোচনা আসবে অর্থমন্ত্রী মনে হয় কস্মিনকালেও ভাবতে পারেননি। কিন্তু বিধি বাম! তাই হলো। এমনকি তার পদত্যাগ চেয়ে বসলেন বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা। এহেন সমালোচনায় জনগণ মনে হয় খুশিই! কিন্তু আমার কিছু কথা আছে।
হঠাৎ সব দোষ কেন অর্থমন্ত্রীর ঘাড়েই চাপল। একটা দেশের বাজেট তৈরির একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া আছে। সেটা কখনই অর্থমন্ত্রীর একক কোনো কাজ নয়। হুম, তাতে তার বড় ভূমিকা আছে বটে। কিন্তু বড় বড় বা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো তিনি অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীসহ অনেকের সাথেই আলাপ করে নেন। অন্তত তাই হওয়ার কথা।
আর বাজেট সংসদে পেশ করার আগে মন্ত্রিসভার অনুমোদন নিতে হয়। সেখানেও বাজেটের নতুন ও উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো আলোচিত হয়। আমার মনে হয়, লাখে আটশো’ টাকা আবগারি শুল্ক ধার্যের বিষয়টাও তাই প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রীদের আগেই জানার কথা। তখন তাঁরা কী করেছেন ? নাকি তাঁরা এক্সপেরিমেন্ট করতে চেয়েছেন ? এখন জনগণের বিরোধিতার মুখে নিজেদের ও দলের ইতিবাচক ইমেজ তৈরির জন্য সব দোষ অর্থমন্ত্রীর ঘাড়ে চাপাতে চাইছেন ? তাকেই সেই যত দোষের নন্দ ঘোষ বানিয়েছেন। অথচ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে আমরা কিন্তু এই ইঙ্গিতই পাচ্ছিলাম যে, আবগারি শুল্কের বিষয়টা পুনর্বিবেচনা করা হবে। আর প্রধানমন্ত্রী চাইলে এটা খুব সহজেই হবে। কারণ সবার ভোটেই তো বাজেট পাস হবে। অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশ করতে পারেন, কিন্তু পাস করে তো সংসদই।
কেউ কেউ হয়তো ভাবছেন , আমি অর্থমন্ত্রীকে বাঁচিয়ে কথা বলছি। বিষয়টা আসলে তা নয়। আগেও দেখা গেছে , এ রকম জনবিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত এলেই সবাই অর্থমন্ত্রীর ওপররই হামলে পড়েন। আর বেচারা অর্থমন্ত্রীও এমন একটা ভাব করেন যে , সব ক্ষমতা তার হাতেই। ‘না আমি পারব না’ ‘হবে না’ ইত্যাদি ইত্যাদি বলে বোঝাতে চান তিনি না চাইলে কিচ্ছু হবে না। কিন্তু ব্যাপারটা কি তাই? তিনি বড়জোর একটু আধটু জোরাজুরি পারেন। এর বেশি করার কোনো ক্ষমতাই নেই। কারণ কোন সিদ্ধান্তই শেষ পর্যন্ত তার একক ক্ষমতায় পাস হয় না।
তাই অর্থমন্ত্রীকে করা মন্ত্রী এমপিদের কড়া সমালোচনায় আমি আহ্লাদিত হতে পারছি না। বরং তাদের করা নিন্দামন্দের কয়েকটা ভিন্ন মানে দাঁড়াচ্ছে আমার কাছে। তারা আসলে এর মাধ্যমে উদোর পিন্ডি বুঁদোর ঘাড়ে চাপাতে চাইছেন। কারণ একটা বিষয় আমরা খেয়াল করলে দেখবো, এই বাজেটের প্রশংসার ভাগ কিন্তু সব সরকার বা দলকেই দিয়েছেন মন্ত্রী এমপিরা। কখনো কখনো প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলা হয়েছে তাঁর নেতৃত্বে এই বাজেট বাস্তবায়ন হবে। ভালো বাজেট করার জন্য অর্থমন্ত্রী কখনই একক প্রশংসা পাননি। কিন্তু মজার ব্যপার হলো, দোষের ভাগিদার হলেন তিনি একা। অর্থাৎ যা কিছু এ বাজেটে জনবিরোধী হয়েছে তার দোষ অর্থমন্ত্রীর ঘাড়ে দিয়ে বাকি সুনামের ভাগ কিন্তু কেউ ছাড়ছে না। মানে, ভালো করলে দল করেছে, আর দোষ করলে অর্থমন্ত্রী! আর এটা কিন্তু শুধু বর্তমান অর্থমন্ত্রীর বেলায়ই নয়, যুগ যুগ ধরেই হয়ে আসছে। অধঃস্তনদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে ঊর্ধ্বতনদের বেঁচে যাওয়ার সংস্কৃতি নতুন কিছু নয়। আর রাজনীতিতে এটা বেশ কার্যকর! বিশেষ করে জনগণকে বোকা বানানোর কজে! কারণ সবাই যখন একজনক ব্যক্তিকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তখন প্রতিষ্ঠান, ব্যবস্থার অনেক ফাঁকফোকর আড়াল হয়ে যায়।
লেখক : জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ