আর্কাইভ  মঙ্গলবার ● ১৯ মার্চ ২০২৪ ● ৫ চৈত্র ১৪৩০
আর্কাইভ   মঙ্গলবার ● ১৯ মার্চ ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: চার ঘণ্টা পর উত্তরবঙ্গের সাথে ঢাকার ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক       ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন       রংপুরে মিস্টি ও সেমাই কারখানায় ৫০ হাজার টাকা জরিমানা       হিলিতে কেজিতে ২০ টাকা কমল পেঁয়াজের দাম       ‘অবন্তিকা’ই যেন শেষ হয়... প্লিজ      

 width=
 

প্লাসে মাইনাসে মাইনাস

বৃহস্পতিবার, ২২ জুন ২০১৭, দুপুর ০১:১৩

প্রভাষ আমিন

সেই বিরল ঘটনা ঘটিয়েছেন বলেই ওবায়দুল কাদের ধন্যবাদ পাবেন। তবে ধন্যবাদটা অর্ধেক দিচ্ছি। কারণ তিনি খালি আশ্বাস দিয়েছেন। যখন তার আশ্বাস বাস্তবায়িত হবে, তখনই ওবায়দুল কাদেরকে পুরো ধন্যবাদ দেবো। আশা করি তিনি নিছক রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে এ আশ্বাস দেননি, অন্তর থেকেই বলেছেন।

বাংলাদেশে কোনো কিছু ঘটলেই, তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস, তদন্ত কমিটি গঠন, বহিস্কার, সাময়িক বহিস্কার, ক্লোজ ইত্যাদি ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয় এবং পুরো বিষয়টিকে হিমাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এই ক্ষেত্রে যেন তেমনটি না হয়।

মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল রাঙামাটি যাচ্ছিল। যাওয়ার পথে রাঙ্গুনিয়া এলাকায় কয়েকজন দুর্বৃত্ত লাঠিসোটা নিয়ে গাড়িবহরে হামলা চালায়। তারা গাড়ি ভাংচুর করে। হামলায় আহত হন মির্জা ফখরুল, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজন। কারা হামলা করেছে? এই প্রশ্নের উত্তর এখনও মেলেনি।

হামলাকারীরা যাওয়ার সময় ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিয়েছে। জয়বাংলা স্লোগান দিলেই তারা আওয়ামী লীগের সমর্থক হবেন, এমন সরলীকরণে আমি একমত নই। ওবায়দুল কাদেরও এই প্রশ্নের কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর দেননি। তিনি বরং যে দলেরই হোক, রাজনৈতিক হোক আর অরাজনৈতিক; তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে নির্দেশ দেয়ার কথা জানিয়েছেন।

তবে বিএনপি সরাসরি ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের দায়ী করেছে। আর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আর এক ডিগ্রি বাড়িয়ে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই এ হামলা চালানো হয়েছে। ওবায়দুল কাদেরের আশ্বাসে আমি বিশ্বাস রাখছি। তবে দুইয়ে দুইয়ে চার মেলালে আমি বিএনপির দাবির সঙ্গেই একমত হবো।

যেখানে হামলা হয়েছে, সেটি আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদের এলাকা। হামলার দিন তিনি এলাকাতেই ছিলেন। ড. হাছান মাহমুদ সেদিন তার এলাকায় মাটি কাটার নাটক করেছেন। হাছান মাহমুদ একেক সময় একেক কথা বলে বিএনপির দাবিকেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন। প্রথমে তিনি বলেছেন, গাড়িবহরের ধাক্কায় স্থানীয় দুজন আহত হওয়ার ঘটনায় বিক্ষুব্ধ জনতা হামলা চালাতে পারে।

পরদিন আবার বলেছেন, বিএনপির অন্তর্দ্বন্দ্বে এ হামলা হয়েছে। আমি একটা ব্যাপারে নিঃসংশয়, হাছান মাহমুদের মত একজন প্রভাবশালী নেতার এলাকায় সরকারি দলের নেতাকর্মী ছাড়া অন্য কেউ বিএনপি মহাসচিবের গাড়িবহরে হামলা করবে, এটা ভাবাই যায় না।

শুধু হাছান মাহমুদের এলাকা কেন, গত সাড়ে ৮ বছরে গোটা বাংলাদেশেই আওয়ামী লীগের এমন একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যে তাদের নেতাকর্মী ছাড়া আর কারো বুকের পাটা এত বড় নয় যে মির্জা ফখরুলের গাড়িবহরে হামলা চালাবে। ওবায়দুল কাদের চাইলেই পুরো ধন্যবাদটা পেতে পারেন। এটা এমন কোনো জটিল মামলা নয়। যারা হামলা করেছে, তাদের ছবি ছাপা হয়েছে পত্রিকায়।

কোনো কোনো পত্রিকায় হামলাকারীদের জবানিতে হামলার বিবরণ ছাপা হয়েছে। অনেক পত্রিকায় হামলাকারীদের নাম-ধাম-পরিচয় ছাপা হয়েছে। হামলাকারীরা নিজেদের নাম প্রকাশ করতে রাজি না হলেও, বিবরণ শুনে মনে হচ্ছে, তারা পূর্ব পরিকল্পিতভাবেই মির্জা ফখরুলের গাড়ি বহরে হামলা চালিয়েছে।

এত অল্পতেই বিএনপি মহাসচিবকে ফিরিয়ে দিতে পেরে তারা চমকিত ও সন্তুষ্ট। ঘটনার তিন দিন পরও কাউকে গ্রেপ্তার করতে না পারায়, ওবায়দুল কাদেরের আন্তরিকতা নিয়ে আমার সংশয় তৈরি হচ্ছে। পুলিশ যে চাইলেই যে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে, তার অসংখ্য উদাহরণ আছে।

সর্বশেষ বনানীর হোটেল রেইনট্রিতে ধর্ষণ মামলার আসামীদের গ্রেপ্তারে পুলিশ দারুণ সাফল্য দেখিয়েছে। কিন্তু রাঙ্গুনিয়ার ঘটনায় পুলিশের কোনো হেলদোল নেই। একবার ভাবুন, এই হামলা যদি ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের ওপরে হতো, এতক্ষণে আমাদের শিরোনাম করতে হতো ‘গ্রেপ্তার আতঙ্কে রাঙ্গুনিয়া পুরুষ শুন্য’।

আইন তো অন্ধ হওয়ার কথা। সে তো দেখবে না, কে আক্রান্ত হলো, বিএনপি মহাসচিব না আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক। তার কাজ হলো, কেউ আইন হাতে তুলে নিলে, তাকে আইনের আওতায় আনা। কিন্তু রাঙ্গুনিয়া থানার ওসি প্রথম দিনেই বলে দিয়েছেন, বিএনপি প্রতিনিধিদল রুট পরিবর্তন করেছেন বলে রাঙ্গুনিয়ায় নিরাপত্তা ছিল না।

এই কথা বলার পর সেই ওসি এখনও বহাল তবিয়তে আছেন! সরকারকে বিপাকে ফেলার দায়ে তাকে এখনও অন্তত ‘ক্লোজ’ও করা হয়নি। সাধারণত সরকারের বিরাগভাজন হলে কাউকে রাঙ্গুনিয়ার মত এলাকায় শাস্তিমূলক বদলি করা হয়। রাঙ্গুনিয়ার ওসি তেমন কেউ নন তো? সুযোগ পেয়ে সরকারকে একহাত দেখিয়ে দিল।

আর ওসি সাহেবের জানা উচিত, নির্দিষ্ট কোনো রাস্তা নয়, সব রাস্তা, সবার জন্য নিরাপদ রাখাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ। মির্জা ফখরুলের গাড়ি বহরের হামলার ঘটনা এমন যে এর পক্ষে বলার কোনো সুযোগ কারোরই নেই। তাই শুধু ওবায়দুল কাদের নন, আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রায় সবাই এই ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন।

তবে বাকি সবাই নিন্দা জানানোর সাথে সাথে অতীতে বিএনপি কোথায়, কবে, কত ভয়ঙ্কর হামলা চালিয়েছে; তার বিবরণ দিতে শুরু করেন। যেন বিএনপি হামলা চালিয়েছে বলেই, তাদের ওপর হামলা চালানোটা জায়েজ হয়ে যায়। অতীতের কোনো খারাপ ঘটনা, তা যত খারাপই হোক, তা বর্তমান কোনো খারাপ ঘটনাকে জাস্টিফাই করতে পারে না।

অন্যায় সবসময়ই অন্যায়, তা যে আমলেই ঘটুক। সব অন্যায়েরই বিচার হতে হবে। আগেই বলেছি, নিশ্চিত না হলেও এ হামলার সাথে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ বা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাই জড়িত; বিএনপির এ দাবির সাথে আমি অনেকটাই একমত।

হতে পারে, তারা নিজেরাই অতি উৎসাহী হয়ে এ হামলা চালিয়েছে বা স্থানীয় কোনো নেতা তাদের উস্কানি দিয়েছে। কিন্তু রুহুল কবির রিজভী যখন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এ হামলা হয়েছে, তখন বুঝি, এ হামলায় বিএনপি যতটা সহানুভূতি পেয়েছিল, রিজভী সাহেব তা বিসর্জন দিতে উঠে পড়ে লেগেছেন।

হামলার পরপরই মির্জা ফখরুল এ হামলাকে গণতন্ত্রের ওপর, চলাফেরার স্বাধীনতার ওপর, মতপ্রকাশের ওপর হামলা হিসেবে অভিহিত করেন; আমরা একমত হই। কিন্তু রিজভী যখন বলেন, এটা মানবতাবিরোধী অপরাধ; তখন বুঝি অপরাধকে লঘু করার অ্যাসাইনমেন্ট নিয়েই মাঠে নেমেছেন তিনি।

আচ্ছা, মির্জা ফখরুলের গাড়িবহরে হামলায় কার লাভ হয়েছে, কার ক্ষতি? কারো কারো কাছে মনে হতে পারে, মির্জা ফখরুলকে রাঙামাটি যেতে না দিয়ে খুব বেটাগিরি দেখানো গেছে। কিন্তু লাভ হয়েছে পুরোটাই বিএনপির। প্রথম কথা হলো, অনেক কষ্ট করে রাঙামাটি না গিয়েও ব্যাপক কাভারেজ পেয়ে গেল বিএনপি। আর কাভারেজের পুরোটাই তাদের পক্ষে সহানুভূতি এনেছে।

রুহুল কবির রিজভী অনেক চেষ্টা করছেন, সেই সহানুভূতি কাটিয়ে দিতে। তারপরও পুরোটা পারবেন বলে মনে হয় না। হামলার পর রুহুল কবির রিজভী সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মর্সূচি ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু বিএনপির আবাসিক নেতা রিজভী কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারেন, পালন করতে পারেন না।

এমন ন্যাক্কারজনক একটা ঘটনার পরও তারা মাঠ গরম করতে পারেনি। কোথাও বিক্ষোভ হয়েছে বলে শুনিনি। রাজপথে উত্তাপ না থাকলেও গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম আর টক শোতে এ হামলা যথেষ্টই উত্তাপ ছড়িয়েছে। বিএনপিকে রাঙামাটি যেতে না দেয়ার আত্মতুষ্টি ছাড়া এ ঘটনায় সরকারি দলের কোনো অর্জন নেই। পুরোটাই লস। কিন্তু এই লাভ লসের হিসাবটা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বোঝেন বলে মনে হয় না।

লেখাটা শুরু করেছিলাম ওবায়দুল কাদেরের কথা দিয়ে। শেষও করতে চাই তাকে দিয়েই। তিনি বলছেন, এমনিতেই বিএনপি মাইনাসে আছে। আমরা কেন তাদের হাতে ইস্যু তুলে দিয়ে তাদের প্লাস করবো? কথা শুনে মনে হচ্ছে, সাধারণ কর্মীরা লাভ লসের হিসাব না বুঝলেও ওবায়দুল কাদের অংকে যথেষ্টই পাকা। তিনি প্লাস-মাইনাসের হিসাবটা ভালোই বোঝেন।

আমি খালি অংকের আরেকটা হিসাব মনে করিয়ে দিতে চাই। প্লাসে মাইনাসে কিন্তু মাইনাস হয়ে যায়। মুখে যাই বলুন, রাঙ্গুনিয়ার ঘটনায় দায়ীদের গ্রেপ্তার করা না হলে অনেক প্লাসই কিন্তু মাইনাস হয়ে যেতে পারে। মান্যবর ওবায়দুল কাদের আপনার জন্য অর্ধেক ধন্যবাদ কিন্তু বহাল রইলো।

কবে আপনাকে পূর্ণাঙ্গ ধন্যবাদ দিতে পারবো?

লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক; বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ। probhash2000@gmail.com

মন্তব্য করুন


 

Link copied