২০০৯ সালে বাংলাদেশে আসার পর এ দেশকে ভালো লেগে যাওয়ায় এখানেই থেকে যান মাইকেল এল ফস্টার। ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীর দুওসুও গ্রামে গড়ে তোলেন গরুর খামার। পাশাপাশি স্থানীয় কৃষকদের আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ শেখাচ্ছেন। তাঁর এ কর্মকান্ডে স্থানীয় শিতি বেকার আর কৃষকদের মধ্যে কর্মতৎপরতার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি যেন তাদের জন্য সেই ডুবন্ত নাবিকদের ত্রাতা 'অ্যালবাট্রস' হয়ে এসেছেন।
মি. মাইক জানান, জন্মসূত্রে তিনি কানাডার নাগরিক। কানাডায় তিনি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের শিা দপ্তরে কাজ করতেন। সেখানে চাকরিতে অবসর নেওয়ার পর দুই বছরের চুক্তিতে ঢাকায় এসে কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে অধ্য হিসেবে চাকরি করেন। এ সময় বাংলাদেশকে তাঁর ভালো লেগে যায়।
রাজধানী ঢাকার আভিজাত্য ছেড়ে তিনি চলে এসেছেন ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার দুওসুও গ্রামে। গড়ে তুলেছেন গরুর খামার। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঝুঁকে পড়েছেন কৃষিকাজে। প্রত্যন্ত এ গ্রামে বিদ্যুতের ব্যবস্থাও করেছেন। েেত-খামারে কর্মরত শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করছেন।
খামার থেকে দুধ, মাংস, গ্যাস ও জৈবসার উৎপাদন তথা বহুমুখী উন্নয়নে তিনি তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। সত্তরোর্ধ্ব এ বিদেশির পরিশ্রম আর আধুনিক উৎপাদন কৌশলে এলাকায় উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন ছুটে আসছে এ বয়সী মানুষটির কর্মকৌশল দেখতে। শিতি বেকাররাও বুঝতে শিখেছে, কাজ করার ইচ্ছা থাকলেই বেকারত্ব দূর করা সম্ভব। তাদের কেউ এখন কৃষি খামার, কেউ হাঁস-মুরগির, কেউ বা গরু-ছাগলের খামার করে বেকারত্ব ঘুচিয়েছেন।
মাইকেল এল ফস্টার বলেন, 'পৃথিবীতে আমার যদি আরো আসার সুযোগ হয়, আমি বাংলাদেশে আসতে চাইব। বাংলাদেশের মানুষ সহজ-সরল। তারা মানুষকে সম্মান-শ্রদ্ধা করতে জানে। গ্রামের মানুষ তো আরো ভালো। তারা এতটাই নিরীহ যে, শুধু ভালোবাসতেই জানে। এ এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা উন্নত করতে কিছু পদপে প্রয়োজন। কৃষকরা এখনো পুরনো পদ্ধতিতে কৃষি কাজে অভ্যস্ত। আধুনিক কৃষি ও বাজারজাতকরণে তাদের শিা নেই বললেই চলে।' সে েেত্র এ অঞ্চলে তিনি একটি কৃষি প্রশিণ কেন্দ্র ও আন্তর্জাতিক মানের স্কুল প্রতিষ্ঠা করবেন বলে জানান।
বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে তিনি কুষ্টিয়া, খুলনা, ফেনী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বগুড়াসহ বেশ কিছু অঞ্চল সফর করেন। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে তিনি বিমোহিত। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সম্পদ আছে অনেক কিন্তু এসবের সুষ্ঠু ব্যবহার নেই। উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি শিা উল্লেখ করে তিনি বলেন, কৃষকদের যদি শিতি করা যায়, তবে দেশ দ্রুত এগিয়ে যাবে। নিজের জন্য তথা সবার জন্য এ মুহূর্তে শিতি হওয়া প্রয়োজন।
তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, এখানে আন্তর্জাতিক মানের শাক-সবজিসহ নানাবিধ কৃষি পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির বিপুল সম্ভাবনা আছে। আধুনিক কৃষিতে কৃষকরা তাদের প্রয়োজন মিটিয়ে তা রপ্তানি করলে দেশের অর্থনীতিতে আরো বেশি বৈদেশিক মুদ্রা যোগ হবে। এতে কৃষকদের ভাগ্যও বদলে যাবে।
কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী বেলাল হোসেনের হাত ধরে ঠাকুরগাঁওয়ে আসেন মাইক। ওই দরিদ্র বেলালের জন্য তিনি পাকা বাড়ি নির্মাণ করে দেন। মাইকের সুবাদেই প্রত্যন্ত ওই গ্রামের ২১টি পরিবার এখন বিদ্যুৎ সুবিধা ভোগ করছে।
গ্রামের শিতি কয়েকজন বেকার জানান, উদ্যমী মাইককে দেখে তাঁরা রীতিমতো বিস্মিত। মাইকের কথায় আকৃষ্ট হয়ে তারা চাষাবাদ ও খামার তৈরির কাজে লেগে যান। পিছিয়ে পড়া গ্রামটির সবাই এখন কর্মমুখী। গ্রামবাসী গ্রামটির নাম দুওসুও পাল্টে মাইক ভিলেজ রাখার প্রস্তাব করেছে।
স্থানীয় মো. জুয়েল, হুমায়ুন কবীর, সাদেকুল ইসলামসহ কয়েকজন জানান, মি. মাইক নিজ হাতে ইট ভাঙা, ঘর নির্মাণ করাসহ সব কাজ করছেন। খামারে গরুর পরিচর্যা করছেন। খামার থেকে বায়োগ্যাস উৎপাদন করে তা রান্নাবান্নার কাজে লাগিয়েছেন। গোবরের অবশিষ্টাংশ তিনি সবজি ও কৃষি উৎপাদনে ব্যবহার করছেন।
ওই গ্রামের গৃহবধূ ফাতেমা বেগম, আরজিনা খাতুনসহ অনেকে জানান, তাদের কারো বাড়ির উঠান এখন আর খালি নেই। সেখানে তারা নানা জাতের সবজি লাগিয়েছেন। তারা শিখেছেন কিভাবে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছাড়াই সবজি উৎপাদন করতে হয়। এখন গ্রামের অধিকাংশ মানুষ গরু পালন করছেন। তাঁরা আশা প্রকাশ করেন, এ বছরই নিজেরা বায়োগ্যাস পান্ট তৈরি করতে পারবেন।
এ ব্যাপারে ঠাকুরগাঁও-২ আসনের সংসদ সদস্য দবিরুল ইসলাম বলেন, 'মি. মাইক প্রত্যন্ত অতি দরিদ্র একটি পল্লীকে আধুনিক করছেন, এটি বেশ আনন্দের। তাঁর পরিশ্রম দেখে লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট হয়ে আসে। আমরা সবাই তাঁর মতো উদ্যমী হলে এ দেশ স্বর্গভূমিতে পরিণত হতো।'