আর্কাইভ  শুক্রবার ● ২৯ মার্চ ২০২৪ ● ১৫ চৈত্র ১৪৩০
আর্কাইভ   শুক্রবার ● ২৯ মার্চ ২০২৪
 width=
 

 

কুড়িগ্রামের খাবারে বেজায় খুশি ভুটানের রাজা

কুড়িগ্রামের খাবারে বেজায় খুশি ভুটানের রাজা

কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করলেন ভুটানের রাজা

কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করলেন ভুটানের রাজা

রানিকে নিয়ে কুড়িগ্রামে পৌঁছেছেন ভুটানের রাজা

রানিকে নিয়ে কুড়িগ্রামে পৌঁছেছেন ভুটানের রাজা

কুড়িগ্রামে সমৃদ্ধির হাতছানি

কুড়িগ্রামে সমৃদ্ধির হাতছানি

 width=
 
শিরোনাম: স্বাস্থ্যের রংপুর বিভাগীয় পরিচালক ফজলুল হক কারাগারে       কুড়িগ্রামের খাবারে বেজায় খুশি ভুটানের রাজা       লালমনিরহাটে পুকুরে জাল ফেলতেই জালে উঠে এলো যুবকের মরদেহ       কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করলেন ভুটানের রাজা       রানিকে নিয়ে কুড়িগ্রামে পৌঁছেছেন ভুটানের রাজা      

 width=
 

“আমি চিরদিনের তরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেবো না ভুলিতে”

রবিবার, ২৭ আগস্ট ২০১৭, দুপুর ১০:০৬

আনওয়ারুল ইসলাম রাজু

বিদ্রোহী কবি কাজী নরুল ইসলাম-যিনি আমাদের জাতীয় কবিও বটে, এভাবেই মাথা উঁচু করে বিশ্ব-বিধাতৃর বুকে আবির্ভূত হয়েছিলেন চির-বিস্ময় রূপে।

যথার্থই এক বিস্ময়কর ও বহুমুখি প্রতিভার অধিকারী ছিলেণ নজরুল। কবি তাঁর প্রধান পরিচয় হলেও সাহিত্যের সকল শাখায় ছিল তাঁর সদম্ভ বিচরণ। তিনি ছিলেন কবি, উপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক। সঙ্গীতের ভুবনেও তিনি ছিলেন অনন্য প্রতিভার অধিকারী। একাধারে তিনি ছিলেন গীতিকার-সুরকার-শিল্পী-সঙ্গীত পরিচালক। পাশাপাশি চলচ্চিত্রে অভিনয় ও পরিচালনা, সাংবাদিকতা-পত্রিকা সম্পাদনা ও রাজনীতির সাথেও সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন তিনি।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যখন বাংলা সাহিত্যের মধ্যগগনে পুর্ণপ্রভায় দেদীপ্যমান, ঠিক তখনই এক বৈপ্লবিক প্রতিভা নিয়ে ধূমকেতুর মত আবির্ভাব ঘটে নজরুলের। কবি নিজেও বলেছেন- ‘আমি যুগে যুগে আসি আসিয়াছি পুঃণ মহা বিপ্লব হেতু / আমি ¯্রস্টার শনি মহা ধূমকেতু’।

নজরুলের সৃষ্টিকাল খুব বেশি প্রলম্বিত নয়; মাত্র ২৩ বছর। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে নজরুল লিখেন ২২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩টি কাব্যানুবাদ, ২টি কিশোরকাব্য, ৩টি উপন্যাস ৩টি গল্পগ্রন্থ, ৩টি নাটক, ২টি কিশোর নাটিকা, ৫টি প্রবন্ধ গ্রন্থ, ১৪টি সংগীত গ্রন্থ। বিষয়বৈচিত্র, আঙ্গিক ও প্রকরণগত ক্ষেত্রে তাঁর সৃষ্টি অনন্য।

নজরুলের বিরুদ্ধে নালিশ ছিল তার কবিতায় ‘চিরকেলে বাণী’ পাওয়া যায় না। তিনি হুজুগের কবি, যুগের হুজুগ কেটে গেলেই তাঁর আবেদন ফুরিয়ে যাবে। কিন্তু নজরুল-নিন্দুকদের এধরণের বিরূপ মন্তব্যকে মিথ্যে প্রমাণিত করে নজরুল তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আজও বেঁচে আছেন, থাকবেন চিরকাল।

আসলে সাহিত্য সমাজের দর্পণ। সঙ্গত কারণে তাই কবি-সাহিত্যিকরা সমকালীন সমাজ ও সময়ের প্রতিভূ। আবার কবি-সাহিত্যিকরা প্রাগ্রসর দূরদৃষ্টি সম্পন্ন। তাই তাদের তাদের সৃষ্টি, চিন্তা-দর্শন কালকে অতিক্রম করে কালোত্তীর্ন মহিমা লাভ করে থাকে। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রেও এ কথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য।

নজরুলের জন্ম, তাঁর বেড়ে ওঠা ও সৃষ্টিকাল ও সমকালীন সমাজের দিকে একবার ফিরে দিয়ে দেখা যাক।

নজরুলের জন্ম উনিশ শতকের শেষ বছরে অর্থাৎ ১৮৯৯ সালে ব্রিটিশশাসিত পরাধীন ভারতবর্ষে, আর বেড়ে উঠা বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে দারিদ্যের সাথে সংগ্রাম করে। সাহিত্য জগতে পরিপূর্ণরূপে আবির্ভাবের আগেই শুরু হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, আর তিনি যখন বাস্তবে পূর্ণ-প্রতিষ্ঠিত, তখন শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। নজরুল তাঁর বেশির ভাগ কবিতা-গান লিখেছেন এই দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে।

তাই স্বাভাবিকভাবেই তাঁর সৃষ্টিতে সমকালীন সমাজ-বাস্তবতার বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। তাহলে কেমন ছিল দুটি বিশ্বযুদ্ধের বিভিষিকা আর পরাধীনতার শৃক্সক্ষলে বন্দী স্বদেশের তৎকালীন সমাজ-বাস্তবতা ? বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপলব্ধি থেকেই তা সম্যক আঁচ করা যেতে পারে-

‘নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস ,/ শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস-’ কিংবা- ‘আমি যে দেখেছি গোপন হিংসা কপটরাত্রি-ছায়ে/ হেনেছে নি:সহায়ে।/ আমি যে দেখেছি প্রতিকারহীন, শক্তের অপরাধে/ বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।’ অপর দিকে নজরুলের প্রায় সমসাময়িক কিশোর কবি সুকান্ত’র কবিতায় তৎকালীন সমাজ-বাস্তবতার ছবি।

‘অবাক পৃথিবী ! অবাক করলে তুমি/ জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি ।/ অবাক পৃথিবী ! আমরা যে পরাধীন/অবাক কি দ্রুত জমে ক্রোধ দিন দিন ;/অবাক পৃথিবী ! অবাক করলে আরো-/ দেখি এই দেশে অন্ন নেইকো কারো ।/ অবাক পৃথিবী ! অবাক যে বারবার/ দেখি এই দেশে মৃত্যুরই কারবার ।/হিসেবের খাতা যখনই নিয়েছি হাতে/ দেখেছি লিখিত- 'রক্ত খরচ' তাতে ;/ এদেশে জন্মে পদাঘাতই শুধু পেলাম,/ অবাক পৃথিবী ! সেলাম, তোমাকে সেলাম !’

এই যখন অবস্থা, তখন অসম্ভব রকম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও মানবতাবোধ, সাম্যবাদ ও স্বদেশচেতনায় উদ্বুদ্ধ কবি কাজী নজরুল ইসলামও শান্ত-সুবোধ-অবোধ বালকের মত চুপ করে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেননি। তিনি সব রকম অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, অমানবিকতা, শোষণ-বঞ্চনা, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় কূপমুন্ডুকতার অবসান ঘটানোর জন্য তাঁর লেখনীর মধ্য দিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। বাজিয়েছেন ‘অগ্নিবীনা’ ও ‘বিষের বাঁশি’। লিখেছেন ‘বিদ্রোহী’র মত অনন্য সাধারণ কবিতা।

নজরুল বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে যে সময়ে আবির্ভূত হন, তখন এ দেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ছিলেন আন্দোলনরত। ব্রিটিশ শাসন-শোষণ, অত্যাচার-নিপীড়নে লাঞ্ছিত-বঞ্চিত-হতশ্রী এ দেশবাসীর অন্তরে যে ক্ষোভ এবং প্রতিবাদের অনুভুতি জমে উঠেছিল তার প্রকাশ ঘটে নজরুলের কাব্যে-গানে এবং সাহিত্য-চেতনায়। দীর্ঘ দিনের পরাধীনতার গ্লানিবাহী এ দেশবাসীর চেতনায় দেশপ্রেম, স্বদেশভাবনা, জাতীয়তাবোধ, স্বাধীনতা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সাম্যবাদ ইত্যাদির যে ভাব সুপ্ত অবস্থায় ছিল, সেসব ভাবই যেন কাজী নজরুলের সৃষ্টিতে ভাষা পেয়ে বাক্সময় রূপ লাভ করে। ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘সাম্যবাদী, ‘সর্বহারা’, ‘ফণিমনসা’, ‘জিঞ্জীর’, ‘সন্ধ্যা’, ‘প্রলয়শিখা’ ইত্যাদি কাব্য তাঁর দেশপ্রেম ও স্বদেশভাবনার উজ্জ্বল উদাহরণ।

নজরুলের কবিতায় ক্ষোভ ও আবেগের বহি:প্রকাশ নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে, ব্যঙ্গ করা হয়েছে। নজরুলের আবেগ-এই ক্ষোভকে অনেকেই ‘যুগের হুজুগ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং যুগের এই হুজুগ কেটে গেলে নজরুলের আবেদনও ফুরিয়ে যাবে বলে বিরূপ মন্তব্য করা হয়েছে। কিন্তু নজরুল এসবের কোন পরোয়াই করেননি।

তিনি লিখেছেন- ‘বন্ধু গো আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে।/ দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।’ বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের যুগে জন্ম নিয়ে এর অভিযান সেনাদলের তূর্যবাদকের একজন হয়ে দম্ভের সাথে উচ্চারণ করেছেন- ‘পরোয়া করি না, বাঁচি বা না বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,/ মাথার ওপরে জ্বলিয়েছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।/প্রার্থনা করো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,/যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ।’ গর্বের ও গৌরবের বিষয়- নজরুল তার রক্ত লেখায় যথার্থই তাদের সর্বনাশের গোড়াপত্তন করেছিলেন। আর নিন্দুক-সমালোচকদের মুখে ছাই ছিটিয়ে বিগত শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকের সেই হুজুগে নজরুল আজ একুশ শতকে এসেও স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে রয়েছেন। তাঁর কবিতা-গান, প্রবন্ধ-ভাষণ-অভিভাষণের বাণী ও মর্ম বিশ শতকে যেমন পরাধীন জাতিকে জাগরণী মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছিল, আজ এই একুশ শতকেও সকল প্রকার শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ, আত্ম নির্ভরশীল ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে।

আমি খুব গুরুগম্ভীর বিষয়ে যাবোনা, নজরুলের দুটি শিশুতোষ কবিতার উদাহরণ দিয়েই বলি- ‘ভোর হলো দোর খোল খুকুমণি ওঠরে’ এবং ‘আমি হবো সকাল বেলার পাখি, সবার আগে কুসুম বাগে উঠবো আমি ডাকি’- আপাতদৃষ্টিতে শিশুতোষ কবিতা হলেও, এর রূপকে কবি পরাধীন-নির্জীব ঘুমন্ত জাতিকে জাগরণী মন্ত্র শুনিয়েছেন। তাইতো তিনি বলেছেন- “আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে/ তোমার ছেলে উঠলে মাগো রাত পোহাবে তবে।”-

নজরুলের এই জাগরণী মন্ত্রই দেশবাসীকে ব্রিটিশ শাসনের শৃক্সক্ষল ছিন্ন করার আন্দোলনে যেমন অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে, তেমনি সাতচল্লিশের দেশ বিভাগের পর ৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলন, ৬৬তে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯এর গণ অভ্যূত্থান, ৭০এর নির্বাচন এবং সর্বোপরি ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধে ‘যার যা আছে তাই নিয়ে’ জয়বাংলা বলে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য বাঙালি জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, নজরুলই প্রথম বাঙালি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং ‘জয়বাংলা’ বলে জয়ধ্বনি দিয়েছিলেন। তাঁর এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটিয়েছেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুই ১৯৭২ সালে অসুস্থ নজরুলকে কলকাতা থেকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে এ দেশের নাগরিকত্ব প্রদান, তাঁর চিকিৎসা এবং আবাসনের ব্যবস্থা করেন। সর্বোপরি, কবিকে বাংলাদেশের ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে বিরল সম্মানে ভূষিত করেন। নজরুলের সৃষ্টি জাতির আশা-আকাংকা, স্বপ্ন-কল্পনা, সংগ্রাম-সাধনার রূপায়ন ঘটাতে সক্ষম বলেই তিনি জাতীয় কবির আসনে সমাসীন। নজরুলের ‘চল চল চল/ উর্ধ গগনে বাজে মাদল’ গানটি এ দেশের রণসঙ্গীতের মর্যাদা লাভ করেছে।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও নজরুলের কবিতা ও গানের বাণী এবং তাঁর আদর্শ শোষণ-বৈষম্যমুক্ত সুখি-সমৃদ্ধ দেশ গঠন, সাম্যবাদ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিধান, স্বৈরাচার বিরোধী ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলন, এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও ফাঁসির দাবিতে দেশের তরুণ ও যুব সমাজকে জাগ্রত করে তুলেছে।

আজ স্বাধীনতার চার দশকের বছর পরেও এদেশে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে আর ধর্মের নামে ধাপ্পাবাজি করে ফায়দা হাসিলের অপচেষ্টায় লিপ্ত। এই অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেও আমাদের অনুপ্রেরণা যোগায় নজরুলের কবিতা-গান- ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম, ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন ?/ কান্ডারি ! বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার।’ ‘খোদার ঘরে কে কপাট লাগায় কে দেয় সেখানে তালা/ সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা।’

মানবতার কবি-সাম্যের কবি নজরুল ‘মানুষ’ ‘কুলি-মজুর’, ‘দারিদ্র্য’, ‘সাম্যবাদী’ কিংবা ‘নারী’সহ বিভিন্ন কবিতায় মানুষের সামাজিক পরিচয়ের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে মানুষ হিসেবে তার যে মৌলিক অধিকারগুলো রয়েছে তার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। সমাজে নারীকে যথাযথ অধিকার ও মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা, নারীর প্রতি সব ধরণের বৈষম্য-বঞ্চনার অবসানেও নজরুল তার কবিতায় যে কথাগুলো বলে গেছেন, তা যুগে যুগে দেশে দেশে সমানভাবে প্রযোজ্য। ‘মম একহাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর হাতে রণতূর্য’- নজরুল যেমন বিদ্রোহের কবি, তেমনি প্রেমের কবিও বটে। মূলত তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রেমের জয়গান গেয়েছেন। মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত কবি প্রেমের শাশ্বত আবেদনের কাছে হার মেনে স্বস্তি খুঁজে পেতে চেয়েছেন- ‘হে মোর রাণী! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে/ আমার বিজয় কেতন লুটায় তোমার চরণ-তলে এসে।’

নজরুল রচনায় তেজোদীপ্ত ও উদ্দীপিত জীবনচেতনার বিপরীতে যে প্রেমচেতনা সেখানে নারীও ভিন্ন মাত্রায় উপস্থাপিত। তাঁর প্রেমমূলক কাব্য ভাবনায় প্রেমিক নজরুলের বিরহী, অভিমানী, অতৃপ্ত ও ক্ষুধার্ত রূপ দেখা যায়। প্রেমের কবিতা ও গানে তাঁর মূল সত্তাটি হচ্ছে বিরহী আত্মার প্রতীক। নজরুল তার প্রেমের কবিতা ও গানে মানবমনের যে শাশ্বত স্বরূপকে বিধৃত করেছেন তার আবেদনও চিরকালীন। সঙ্গীত সৃষ্টিতেও অনবদ্য নজরুল। স্বদেশচেতনামূলক জাগরণী সঙ্গীত, ভক্তিমুলক ইসলামী সঙ্গীত, শ্যামা সঙ্গীত, প্রেম-প্রণয়গীতি, প্রকৃতি ও ঋতুবন্দনামূলক সঙ্গীত ইত্যাদি বিচিত্র ধারার পাশাপাশি তিনি পাস্য রীতির অনুসরণে বাংলা সঙ্গীতের ক্ষেত্রে ‘গজলগীতি’র প্রবর্তন করেছেন। তাঁর সৃষ্টির অন্য সব বিষয় বাদ দিলেও তিনি সঙ্গীতের যে বিশাল ও বৈচিত্রময় সম্ভার উপহার দিয়েছেন তার মধ্যদিয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবেন। নজরুল তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে সব ধরণের অন্যায়-অবিচার, শোষণ-বঞ্চনা, অত্যাচার-নির্যাতন-বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণার পাশাপাশি বাঙালি জাতিকে পরাধীনতার শৃক্সক্ষল ছিন্ন করে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন। একই সাথে প্রেম-প্রকৃতি, সত্য-সুন্দর ও মানবতার জয়গান গেয়েছেন। ব্রিটিশ শাসন-শোষণ, অত্যাচার-নিপীড়নে লাঞ্ছিত-বঞ্চিত-হতশ্রী পরাধীন দেশবাসীর অন্তরে যে ক্ষোভ এবং প্রতিবাদের অনুভুতি জমে উঠেছিল তার প্রকাশ ঘটেছে নজরুলের কাব্যে-গানে এবং সাহিত্য-চেতনায়। স্বাধীনতাকামী দেশবাসীর চেতনায় দেশপ্রেম, স্বদেশভাবনা, জাতীয়তাবোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সাম্যবাদ ইত্যাদির যে ভাব সুপ্ত অবস্থায় ছিল, তাই যেন নজরুলের সৃষ্টিতে ভাষা পেয়ে বাক্সময় রূপ লাভ করে। ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘সাম্যবাদী, ‘সর্বহারা’, ‘ফণিমনসা’, ‘জিঞ্জীর’, ‘সন্ধ্যা’, ‘প্রলয়শিখা’ ইত্যাদি কাব্য তাঁর দেশপ্রেম ও স্বদেশভাবনার উজ্জ্বল উদাহরণ।

নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা কেবল তার সৃষ্টির বিষয়বৈচিত্রেই নয়; আঙ্গিক ও প্রকরণ ক্ষেত্রে মুন্সীয়ানার পাশাপাশি তার ভাষার ব্যবহার এবং ব্যবহৃত রূপক এবং প্রতীকগুলোর মধ্যেও বিধৃত। কবি নিজেই বলেছেন, অমর কবি হওয়ার সাধনা তিনি করেননি। কিন্তু বিশ শতকের প্রথমার্ধে সেই যুগের হাওয়া কেটে গেলেও এবং এই একুশ শতকের সভ্যতা, সমাজ ও সংস্কৃতির এক ভিন্নতর প্রেক্ষাপটেও তিনি বেঁচে আছেন শুধু বিদ্রোহের কবি হিসেবে নয়, প্রেমের এবং সাম্যের কবি হিসেবেও।

একুশ শতকে এসে একদিকে সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তির তান্ডব এবং বিশ্বকে পদানত রাখার জন্য দেশে দেশে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী সংঘাত সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে নজরুলের উদার মানবতাবাদী, সাম্যবাদী, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, একুশ শতকের রুগ্ন পৃথিবীকে পথের দিশা দেখাতে পারে। আজকের পৃথিবীর একদিকে তথ্যওস যোগাযোগ প্রযুক্তির বিপ্লব, অপরদিকে পরাশক্তির সৃষ্ট মৌলবাদী সংঘাতে মানুষ দিশাহারা। শিল্পোন্নত দেশগুলো পৃথিবীর পরিবেশগত ভারসাম্য ধ্বংস করে দিয়ে নিজেদের অপরিসীম লোভ, লালসা ও জিঘাংসা চরিতার্থ করছে। একুশ শতকের পৃথিবী এক মহাবিপর্যয়ের মুখোমুখি। এই বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের স্মরণ করতে হবে সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, সামন্তবাদ, মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা প্রভৃতি মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টিকারী মানবতাবিরোধী উপাদানগুলোর সম্পর্কে নজরুলের বাণী ও আদর্শ। সেই আদর্শে দীক্ষিত হয়ে মানবসমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।

বাক্ ও বোধ শক্তি হারাবার আগে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে নজরুল ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির’ বিশেষ অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন- ‘আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলামÑ সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।’ বস্তুত এমন অভিমান নিয়েই নজরুল দীর্ঘ ৩৪ বছর নীরবে কাটিয়ে ৭৭ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়েছেন। তবে প্রেমের কাঙাল এই কবি ব্যক্তিগত শত ব্যথা-বঞ্চনা ও দুঃখ-দারিদ্রের মাঝেও এক অপরিমেয় শক্তিবলে জীবনের ভান্ড শুন্য রেখে সৃষ্টির ভান্ডকে পরিপূর্ণ করে তুলেছিলেন । জীবনভর দুঃখ-দারিদ্র তাড়িত চুরুলিয়ার সেই দুখুমিয়া বৈষয়িক জীবনে সুখ নামের শুকপাখিটির ধরা না পেলেও তাঁর স্বর্ণালী সৃষ্টি-সম্ভারের বদৌলতে মানুষের কাছ থেকে যে ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও সম্মান পেয়েছেন এবং পাচ্ছেন সেটাই তার জন্য পরম প্রাপ্তি, বিরাট সৌভাগ্য। পৃথিবীর আর কোন কবির ভাগ্যে এমনটি ঘটেনি। ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকীতে এই মহান কবির প্রতি জানাই সশ্রদ্ধ অভিবাদন ।

 

মন্তব্য করুন


 

Link copied