মুরাদ মাহমুদ
সাধারণত আমাদের দেশের জনপ্রতিনিধিদের মাঠে- ঘাটে দেখাযায় নির্বাচনের আগের ১ বছর। বাকি ৪ বছর তাদের দেখা পাওয়া মুশকিল। জয়ী প্রার্থী জয় লাভ করার পর সাধারণ ভোটারদের তেমন খবর রাখে না। অন্যদিকে পরাজিত প্রার্থী পরাজয়ের পর ক্ষোভ অভিমান আর রাগে ভোটারদের খোজ খবর নেয় না। রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের বছর খানেক আগ থেকে অতিথি পাখির মত ঝাঁকে ঝাঁকে প্রার্থীদের আগমন হতে শুরু হয়েছিলো। রাজনৈতিক দলগুলো মনোনয়ন চূড়ান্ত করার আগ পর্যন্ত প্রতিদিনই নগরী জুড়ে মিছিল-মিটিং এ কান ঝালাপালার মত অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিলো। বড় দলগুলি তাদের মনোনয়ন চূড়ান্ত করার পর হঠাৎ করেই যেন নীরব হয়ে গেলো রংপুর নগরী। থেমে গেলো প্রচারণার মহাযজ্ঞ। অতিথি পাখিরা একে একে রংপুর ত্যাগ করলেন। স্থানীয় প্রার্থীরাও (মনোনয়ন বঞ্চিত) নীরব হয়ে গেলো।
ঠিক এই জায়গাটাতেই পুরোপুরি ভিন্ন একজন মানুষ মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। ২০১২ সালের নির্বাচনে পরাজিত হয়ে তিনি একদিনও বসে থাকেননি। ভোটারদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ভোট দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। নির্বাচনের পরের দিন থেকে রংপুর নগরীর বিভিন্ন এলাকায় আবার গণসংযোগ শুরু করেন তিনি। গত ৫ বছরে রংপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় তিনি ঘুরেছেন। ফলে রংপুর সিটি কর্পোরেশনে ২০৪ বর্গকিলোমিটার এলাকায় দিনের পর দিন ঘুরে-ঘুরে মানুষের মনে নিজের স্থান করে নিতে সক্ষম হন তিনি। নগরীর প্রতিটি পাড়া-মহল্লার নাম থেকে শুরু করে এলাকার বেশিরভাগ মানুষের নামও তার মুখস্থ। কোনও এলাকায় কোনও ধরনের সমস্যা হলে তিনি খবর পাওয়া মাত্রই ছুটে যান। এভাবেই মোস্তফা নিজেকে গণ-মানুষের প্রিয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন।
সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে অকল্পনীয় ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েও তিনি থেমে থাকেননি। ভোটের এই বিশাল কর্মযজ্ঞ তাকে ক্লান্ত করতে পারেনি। জয়ের মালা পরে তিনি এখনও ছুটে চলেছেন নগরীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। নগরবাসীর সাথে এখন শুভেচ্ছা বিনিময়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি। নির্বাচনের সময় ভোটারের দ্বারে দ্বারে ছুটেছেন ভোট আর দোয়া চেয়ে। এখন ছুটছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে। রসিকের নতুন এই মেয়র নিজেই মোটরসাইকেল চালিয়ে নগরীর বিভিন্ন স্থানে নির্বাচন পরবর্তী কুশল বিনিময় করছেন। মোটরসাইকেল থামিয়ে হাতে হাত রেখে কোলাকুলি করছেন দিন মজুর থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের সাথে। শুধু তাই নয় নির্বাচিত হবার পরের দিন ফুল নিয়ে যান তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের পরাজিত প্রার্থী ও বিদায়ী মেয়র সরফুদ্দীন আহমেদ ঝন্টুর বাসায়। এরপর সাক্ষাত করেন বিএনপির প্রার্থী কাওছার জামান বাবলার বাসায় গিয়ে।
মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা মেয়র হলে রংপুরের উন্নয়ন হবে না এমনটা যারা ভেবে রেখেছেন তাদের উদ্দেশ্যে আমার প্রশ্ন হলো, বিগত ৫ বছরে রংপুরের এমন কি উন্নয়ন হয়েছে? অনেকেই বলছেন, রংপুরে উন্নয়নের জোয়ার বইছে। কিন্তু আমার কাছে তেমনটা মনে হয়নি। আমার কাছে মনে হয়েছে রংপুরে যেসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হয়েছে সেটাকে রুটিন উন্নয়ন বলা যায়। একটি সিটি কর্পোরেশনে ভালো ড্রেনেজ ব্যবস্থা থাকবে, ভালো রাস্তা থাকবে, সড়ক বাতি থাকবে, বিনোদনের জন্য থাকবে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। গত ৫ বছরের এই কাজগুলোই করার চেষ্টা করা হয়েছে। সাবেক মেয়র কতটা করতে পেরেছেন সেটা রংপুর নগরীতে ঘুরে দেখলেই বোঝা যায়।
একটি সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়ন শুধু একজন মেয়রের উপরই নির্ভর করে না। উন্নয়নের জন্য সরকার, নাগরিক এবং সিটি কর্পোরেশনের যৌথ সহযোগিতার প্রয়োজন। শুধু মাত্র সিটি কর্পোরেশনের আয় থেকে নগরীর উন্নয়ন সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন সরকার ও উন্নয়ন সহযোগী সংগঠনের বরাদ্দ। তবে আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতা হলো, কোন জনপ্রতিনিধি যদি সরকারী দলের বাইরে থেকে নির্বাচিত হয় তবে সেই এলাকায় সরকারি বরাদ্দ এবং উন্নয়ন প্রকল্প কমে যায়। তবে আসার কথা হলো, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী রংপুরের পুত্রবধূ। তিনি অনেকবারই বলেছেন রংপুরের উন্নয়নের দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে নিয়েছেন।এছাড়া জাতীয়পার্টি বর্তমান সরকারেরই অংশ। সে দিক থেকে বিবেচনা করলে রংপুরের উন্নয়ন পিছিয়ে পরার কোন সম্ভাবনা নেই। শুধু প্রয়োজন সকলের সদিচ্ছা।
৩৩টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত এ সিটির জনসংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। এই জনগোষ্ঠীর সকলকে সন্তুষ্ট করা একজন মেয়রের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে ব্যবহার, কথা দিয়ে সকলকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। মেয়রের চেয়ার যেন সকলের ‘মোস্তফা ভাই’ কে দূরে সরিয়ে না দেয় সেদিকটায় খেয়াল রাখা জরুরী। নিজের কষ্টের কথা বলতে আসা সাধারণ একজন মানুষকেও যেন ফিরে যেতে না হয় মেয়রের সাক্ষাৎ না পেয়ে। কিছু দিতে না পারুক অন্তত আগের মত বুকে জড়িয়ে ধরে বলুক, এটা করার মত সামর্থ্য আমার নেই।
লেখক: প্রকাশক, উত্তরবাংলা ডটকম