আর্কাইভ  মঙ্গলবার ● ১৯ মার্চ ২০২৪ ● ৫ চৈত্র ১৪৩০
আর্কাইভ   মঙ্গলবার ● ১৯ মার্চ ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন       রংপুরে মিস্টি ও সেমাই কারখানায় ৫০ হাজার টাকা জরিমানা       হিলিতে কেজিতে ২০ টাকা কমল পেঁয়াজের দাম       ‘অবন্তিকা’ই যেন শেষ হয়... প্লিজ       রংপুরে দিনে গরম রাতে শীত, ভাইরাসজনিত জ্বর-সার্দির প্রকোপ বৃদ্ধি      

 width=
 

ভাষা আন্দোলনে রংপুর

মঙ্গলবার, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, রাত ০৯:৫৩

আব্দুর রহমান মিন্টু

বায়ান্ন’র মহান ভাষা আন্দোলনে রংপুরের যে সমস্ত ভাষা সৈনিক সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের মধ্যে ৫/৬ জন বেঁচে আছেন। যতদূর জানা গেছে, জীবিতদের মধ্যে কেউ কেউ রংপুরের বাইরে বাস করেন। রংপুরের বর্তমান প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও শিক্ষক শাহ আব্দুর রাজ্জাক ও শাহ তবিবর রহমান তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৪৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রংপুর কারমাইকেল কলেজে বিক্ষোভ মিছিল করে ছাত্ররা। তখন থেকেই রংপুরে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন শাহ আব্দুর রাজ্জাক। বর্তমানে তাঁর বয়স ৮৯। বছর খানিক আগে ব্যক্তি এবং রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গী তার স্ত্রী (সাবেক মহিলা আ.লীগ সভানেত্রী ও জেলাপরিষদ প্রশাসক) রেজিনা রাজ্জাকের মৃত্যুর পর পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছেন। ছেলে-মেয়েরা কেউই কাছে নেই। এখন তিনি বড়ই নিঃসঙ্গ। অধিকাংশ সময় বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছেন। বাসা থেকে তেমন একটা বের হতে পারেন না। নগরীর মাহিগঞ্জে নিজ বাসভবনে বয়সের ভারে নুয়ে পড়া শাহ আব্দুর রাজ্জাক ভাঙা ভাঙা গলায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করেন। তিনি বলেন, ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি তখন থেকেই ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি। ’৫২ সালে কারমাইকেল কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র ছিলাম। ১৯৪৮ সালে ইস্ট পাকিস্তান ছাত্রলীগ গঠন করা হয়। কারমাইকেল কলেজের তৎকালীন ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এবং জেলা কমিটির সদস্য ছিলাম। ১৯৫৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ইস্ট পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল হয়। সেই কাউন্সিলে সদস্য নির্বাচিত হই। তিনি বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় ছাত্র মিছিলের ওপর গুলি বর্ষণের খবর রংপুরে সন্ধ্যার দিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজ প্রতিবাদে এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাতেই মিছিল নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করে। পুলিশের অবিরাম লাঠিচার্জে মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। রংপুরের অনেক তরুণ ছাত্রই সেদিন মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন। ২২ ফেব্রæয়ারি কারমাইকেল কলেজে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং পুনরায় এক বিরাট মিছিল নিয়ে শহরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এ মিছিলটিকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করেছিল পুলিশ। কিন্তু বাধা উপেক্ষা করে মিছিলটি সারা শহর প্রদক্ষিণ করে। তারপরে প্রতিদিনই কারমাইকেল কলেজে প্রতিবাদ সভা হতো, বেরুতো মিছিলও। মাতৃভাষার দাবীতে রংপুরে ছাত্র আন্দোলনের এই পর্যায়ে গ্রেফতার করা হয় অনেককে। এতে অবশ্য থেমে থাকেনি আন্দোলন। চলেছে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত। অবশেষে আসে শহীদের রক্তে রাঙানো বিজয়।

তিনি বলেন, ভাষা সৈনিক শাহ তোফাজ্জল তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। ৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ‘কমিটি অব এ্যাকশন’ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে তাকেসহ অনেককেই পাঠিয়ে দেয়া হয় রংপুর। তিনিসহ সাবেক মন্ত্রী রংপুরের মরহুম মতিউর রহমান, এ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান, ইয়াকুব আলী, মাহফুজ আলী, কাজী মুহাম্মদ এহিয়া, মণি কৃষ্ণ সেন, শংকর বসু, শাহ আবদুল বারী, ধীরেন ভট্টাচার্য, জীতেন্দ্রনাথ দত্ত, ইদ্রিস লোহানী, সুফী মোতাহার হোসেন, কছিম উদ্দিন. আমজাদ হোসেন, আজমল হোসেন, আবুল হোসেন, ডা. মোজাহার উদ্দিন, ডা. আবতাব উদ্দীন তালুকদার, ভিখু চৌধুরী, শাহ আবদুল বারী, এ্যাডভোকেট নুরুল হক, দবির উদ্দিন আহম্মদ, খয়রাত হোসেন, নাজিম খন্দকার, আফজাল, আজিজার রহমান, নাজমুল আলম চৌধুরী হেবিন, মতিয়ার রহমান, আজিজুল হক সেলিম, আবদুস সোবহান, কৃষক নেতা দরাজ আলী ও শাহ তবিবর রহমান প্রধান তখন রংপুরের আন্দোলনে পুরোধা হিসেবে কাজ করেছেন। রংপুরে ভাষা আন্দোলনে আরও যারা সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন, তারা হলেন, লে. কর্নেল জাহিদুল হক চৌধুরী, শামসুল হুদা (আবু), নজরুল ইসলাম এ্যাডভোকেট, সিদ্দিক হোসেন, ডা. রোকেয়া আলমগীর রুবি, কমরেড বিনয় সেন, মজিবর রহমান মতি মিয়া, ডা. শোভান খান, ডা. দীনেশ চন্দ্র ভৌমিক (মন্টু ডাক্তার), মকবুল হোসেন, কানু ঘোষ, আফান উল্লাহ, মোসলেম আলী খান, ইব্রাহিম খান সুরুজ, ডা. কবির খান বখতিয়ারি, এ্যাডভোকেট গাজী রহমান, কামরান শাহ আবদুল আউয়াল, অধ্যাপক রেজা শাহ তৌফিকুর রহমান, এ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম, তোজাম্মেল আলী, এ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী, আশরাফ হোসেন বড়দা, তনসিম উদ্দিন আহমেদ মনু ও পানার উদ্দিনসহ নাম না জানা আরও অনেকে।

ভাষা আন্দোলনের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে রংপুরের রাজপথে মিছিল করেছিলেন এ আন্দোলনের প্রধান সৈনিক শাহ তবিবর রহমান। পোস্টার লিখে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় লাগিয়েছিলেন। অধ্যাপক নুরুল ইসলামের সঙ্গে গ্রামে-গঞ্জে গান গেয়ে বেড়িয়েছিলেন। ভাষার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে সাতবার জেলে গেছেন ছাত্র ইউনিয়ন করা এই ছাত্র নেতা। তবিবর রহমানের বাড়ি শহরের গুপ্তপাড়ার নিউক্রস রোডে। এখনো সে বাসাতেই অবসর জীবন যাপন করছেন। তাঁর নেতৃত্বে জিলা স্কুল থেকে মিছিল বের হতো। ৫২ সালের ২৮ ফেব্রæ“য়ারির কথা। ওইদিন এক বিশাল জনসভা হয় জেলার বদরগঞ্জ থানায়। এর উদ্যোক্তা ছিলেন প্রয়াত কমিউনিস্ট নেতা জিতেন দত্ত। সেই জনসভা চলা অবস্থায় রংপুরের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক শাহ বারীকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর তাকে ট্রেনে করে রংপুর রেলওয়ে স্টেশনে নিয়ে আসা হলে হাজার হাজার মানুষ তাকে দেখতে আসে এবং বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এক পর্যায়ে শাহ বারীকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ। তিনি বলেন, শহরের নুরপুরের হেবিন চৌধুরীর বাড়িটি ছিল ভাষা আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র। হেবিন চৌধুরীর মা আফতাবুন্নাহার ছিলেন আমাদের সবার মা। তাকে আমরা মা বলেই ডাকতাম। তিনি ভাষা আন্দোলনের সময় যেভাবে সহযোগিতা করেছেন তা আজও ভোলার নয়। তিনি ভাষা সৈনিকদের নিজ হাতে চা বানিয়ে খাওয়াতেন। হেবিন চৌধুরীর দু’বোন ডলি এবং ডজি তারাও নিয়মিত মিছিলে যেতেন এবং ডজি শ্লোগান দিয়ে মাতোয়ারা করতে পারতেন। মুন্সীপাড়া মরহুম কাজী মো. ইলিয়াছের বাড়ির অবদানের কথাও বলেন তিনি। শাহ আব্দুর রাজ্জাক বলেন চলেন, রংপুরে তখন মাইক পাওয়া কষ্টকর ছিল। মাইকের দোকান ছিল মাত্র দু’টো। যে কারণে মিছিলে চোঙ্গা ফুঁকতেন তবিবর। এক পর্যায়ে তার নাম হয়ে যায় ‘চোঙ্গা তবি’। তখন দলবদ্ধ হয়ে আড্ডা ও পোস্টার লেখা হতো বর্তমান জি.এল.রায় রোডস্থ খ্রিস্টানদের কবরস্থানে। এ তথ্যও জেনে যায় পুলিশ। এজন্য প্রায়ই সেখানে হানা দিত তারা। এছাড়া রংপুরের ভাষা সৈনিকরা নিয়মিত ওঠাবসা করতেন নগরীর বর্তমান পায়রা চত্বরের পাশে বর্তমান লুক টেইলার্স ও সাবেক পাকিস্তান বুক হাউসে। সেটি ছিল আওয়ামী লীগ নেতা আবুল হোসেনের অফিস। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভাপতি ভাষা সৈনিক ডা. মোজাহার উদ্দিনের সিটি ফার্মেসিতেও বসা হতো। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ভাষার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে তিনি সাতবার জেলে গেছেন। ভাষা আন্দোলনের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে রংপুরের রাজপথে মিছিল করেছেন। পোষ্টার লিখে তা বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় লাগিয়েছেন। অধ্যাপক নুরুল ইসলামের সঙ্গে গাঁয়ে-গঞ্জে গান গেয়ে বেড়িয়েছেন । তবিবর রহমানের বাড়ি নগরীর গুপ্তপাড়ার নিউ ক্রস রোডে। জন্ম তার ১৯৩৮ সালের পয়লা জানুয়ারি। বাবা শাহ এছহাক প্রধান, মা ফাতেমা খাতুন। ১৯৫৩ সালে রংপুর জেলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করে রংপুর কারমাইকেল কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন তিনি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি পড়তেন রংপুর জিলা স্কুলের দশম শ্রেণীতে। অষ্টম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় তিনি এই ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। এত কম বয়সে তার এই আন্দোলনে যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওই সময় সকলের দাবি ছিল মায়ের ভাষা বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা করা। কারমাইকেল কলেজ থেকে মিছিল বের হতো। সেই মিছিলটি শহরে আসার পর সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই বের হওয়া মিছিলগুলো ওই মিছিলে যোগ দিত। বৃটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশসহ তিন দেশের সরকারি ব্যাজ দেখা কজনের ভাগ্যে হয়। শেষ বয়সে তার কিছুই চাওয়া পাওয়ার নেই। তবে সরকার যদি ভাষা সৈনিকদের কিছু ভাতা দিত তা দিয়ে নাতি নাতনিদের চকলেট কিনে দিতাম আর গর্ব করে বলতাম এ টাকা সরকারি টাকা। আমাদের মূল্যায়ন করে সরকার দিয়েছে। কথাগুলো বায়ান্ন সালের রাজপথ কাঁপানো ভাষা সৈনিক শাহ তবিবর রহমানের। সরকারি প্রথম গেজেটের যে কজনের নাম তালিকা ভুক্ত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম তিনি। ভাষা আন্দোলনের মাসে তিনি স্বীকৃতি স্বরূপ ভাতা দাবি করে বলেন, ভাষা সৈনিকদের যথাযথ মূল্যায়নের এটাই উপযুক্ত সময়। জীবন সায়াহ্নে এসে এই ভাষা সৈনিক নিজেদের মূল্যায়নের জন্য সরকারি ভাতা দাবি করেন। তিনি বলেন, এ টাকা দিয়ে সংসার চালানো যাবে না। তবে এই টাকা আগামী প্রজন্মের কাছে সম্মানের স্মারক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

নগরীর মুন্সীপাড়ার নিজ বাসভবনে কথা হয় ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আফজাল(সাবেক পৌর চেয়ারম্যান, গণতন্ত্রী পার্টির উপদেষ্টা মণ্ডলীর সভাপতি)’র সাথে। জাতীয় আন্দোলনসহ রংপুরের সকল আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। চির সংগ্রামী, নির্লোভ এ কিংবদন্তী রাজনীতির কারণে সংসারী হননি। নিজ বাড়িতে সম্পূর্ণ একা। বার্ধক্যের কারণে শরীর ভেঙ্গে পড়েছে। ঠিকমত কথা বলতে পারেন না। চোখে কম দেখেন। কানেও ভাল শুনতে পান না। বাড়ির একটি অংশ ছাত্রদের মেস ভাড়া দিয়েছেন। স্ত্রী-সন্তান না থাকায় ২/১ জন নিকটাত্মীয় আর ওই ছাত্ররাই তার দেখাশুনা করে। রংপুর জেলা স্কুলের ছাত্রাবস্থায় ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন তিনি । বয়সে ছোট হলেও প্রতিটি মিটিং মিছিলে তাঁর ছিল উচ্চ কণ্ঠ। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণের এক পর্যায়ে আক্ষেপ করে বলেন, “পৃথিবীর বুকে একমাত্র বাঙ্গালী জাতিই ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে। অথচ রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে সেই ভাষার ব্যবহার এখনও নিশ্চিত করা যায়নি। এখনও উচ্চ আদালতে বাংলাভাষায় রায় লেখা হচ্ছে না।” বাংলাভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে এবং ভাষা শহীদদের আত্মার শান্তির জন্য সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের দাবি করেন তিনি।রংপুরে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণে প্রসঙ্গটি মো: আফজালের কথায় জানা যায়। তিনি জানান যে, ১৯৫৫ সালে বর্তমান পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে কাদা-মাটি দিয়ে রংপুরের প্রথম শহীদ মিনার আমরা তৈরি করি। এই শহীদ মিনার তৈরির সময় যারা ছিলেন তাঁরা হলেনÑসাংবাদিক আমিনুল ইসলাম, হেবিন চৌধুরী,শাহ তৈবুর রহমান, আশরাফ হোসেন বরদা, পীরগাছার রহুল কুদ্দুস, চিলাহাটির মোজফফর সহ আরও অনেকে ছিলেন।

ঢাকার আন্দোলনের সঙ্গে সারা দেশের মতো রংপুরেও তুমুল আন্দোলন শুরু হয়। ছাত্র ইউনিয়নের সুফী মোতাহার হোসেন ও মোহাম্মদ আফজালের নেতৃত্বে ২২শে ফেব্রুয়ারি জিলা স্কুলে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে জমায়েত হন। এ সময় রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ওই পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে এলে মিছিলটি জনসমুদ্রে পরিণত হয়। আহবান করা হয় পরদিন অর্থাৎ ২৩শে ফেব্রুয়ারি রংপুরে হরতাল। সেই সঙ্গে টানা এক মাস সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলিয়ে ধর্মঘট পালন করা হয়। এতে রংপুরে আন্দোলনকারীদের উপর ধরপাকড় শুরু হয়। পাকিস্তানি সরকারের জননিরাপত্তা আইনে মোহাম্মদ আফজালের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। ফলে তিনি দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকেন।

তিনি জানান, ১৯৫২ সালে রংপুরে ছাত্র-জনতার উদ্যোগে কাদামাটি দিয়ে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরীর মাঠে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হলেও সেটি পুলিশ দিয়ে ভেঙ্গে দেয়া হয়। ১৯৫৩ সালে নিউক্রস রোডের বাসিন্দা ডাঃ মোজাহার হোসেনের (মৃত.) বাড়ি থেকে ইট নিয়ে গিয়ে এবং পাবলিক লাইব্রেরী সংলগ্ন পুকুর থেকে কাদামাটি তুলে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। সেখানে অমর একুশের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে ওই স্থানে রংপুরের নেতৃস্থানীয় রাজনীতিকদের উদ্যোগে ইটের গাঁথুনি দিয়ে একটি শহীদ মিনার নির্মিত হয়। তিনি বলেন, “১৯৭৭-১৯৮২ সালে আমি রংপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে রংপুর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পূর্ণাঙ্গরূপে নির্মাণ করি।”

ভাষা আন্দোলনে কেমন করে জড়ালেন, এ প্রসঙ্গে ভাষা সৈনিক আশরাফ হোসেন বড়দা বললেন, জ্ঞান তাপস ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহর একটি আর্টিকেল পড়ে রাষ্ট্রভাষার প্রতি উদ্বুদ্ধ হই। প্রগতিশীল শিক্ষক স্যার সন্তোষ গুহ ও কবি শাহ আমানত আলীর কাছ থেকেই পেয়েছেন প্রাণের ভাষা বাংলার অনুপ্রেরণা। ১৯৫২ সালে তিনি লালমনিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র । ১৯৫২ সালে লালমনিরহাটের আবুল হোসেন, ছামছুল হক, আনিছুল হক, ষষ্টি সরকার, নাসির উদ্দিন, নাসিম আহমেদ, টুকু চৌধুরীসহ অনেকের সঙ্গে মিছিলে শরিক হতেন তিনি। ৫২ সালে যখন শুনলেন ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে সালাম, রফিক, বরকতসহ অনেকেই। তখন তিনি অন্যদের সাথে রাজপথে নামেন। সে সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। তখনকার মিছিলে স্লোগান ছিল, ‘নাজিম-নুরুল দুই ভাই, এক দড়িতে ফাঁসি চাই।’ ১৯৫১ সাল থেকেই রংপুরের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। ’৫৪ সালে আত্মগোপনে চলে যান আন্দোলনের কারণে। ১৯৫৫ সাল থেকে রংপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।

প্রথমে ন্যাপ-ভাসানী করলেও পরে ইউনাইটেড পিপলস পার্টি করেন। এরপর ৭ দলের হয়ে বিএনপিতে কিছুদিন থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি জানান, যে আকাঙ্ক্ষায় ভাষা আন্দোলন করেছিলাম তা আজো পাইনি। সুন্দর একটি সমাজ গড়তে পারলাম না। সত্যিকারের ভাষা যার স্বাধীনতা আনতে হলে বিভিন্ন মিডিয়ায় ভাষার আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক

মন্তব্য করুন


 

Link copied