ফজলুল বারী
লন্ডনে ইউরোপ প্রবাসী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের দেয়া একটি তথ্য নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা হচ্ছে! তথ্যটি হলো তারেক রহমান বাংলাদেশের পাসপোর্ট সারেন্ডার করেছেন। বাস্তব সত্য হচ্ছে এটি খুব পুরনো একটি তথ্য। যা এতদিন জেনেশুনে আওয়ামী লীগ চেপে গেছে! বিএনপিতো এটি আজ পর্যন্ত স্বীকারই করেনি!
১/১১ এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে আর কোনো দিন রাজনীতি না করার মুচলেকা দিয়ে চিকিৎসার জন্যে তারেক রহমান যখন লন্ডনে যান তখন তার কাছে বিলাতের মালটিপল ভিসা ছিল, যা বাংলাদেশের বেশিরভাগ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পাসপোর্টে মজুত থাকে। সাধারণত এসব মালটিপল ভিসা হয় পাঁচ বছর মেয়াদী। কিন্তু দশ বছরের বেশি সময় ধরে বিলাতে আছেন তারেক রহমান।
এরমধ্যে নিশ্চিত যে তার হাতে থাকা বাংলাদেশি পাসপোর্ট এবং ব্রিটিশ ভিসার মেয়াদ ফুরিয়েছে। প্রশ্ন হতে পারে তাহলে এরপর থেকে বিলাতে তার অবস্থানের আইনগত ভিত্তি কী? সোজা উত্তর রাজনৈতিক আশ্রয়। তারেক ও তার পরিবারের সদস্যরা এরমাঝে বিলাতে রাজনৈতিক আশ্রয় তথা প্রটেকশন ভিসা প্রাপ্ত। রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনের সময় যে কোনো ব্যক্তিকে তার হাতে থাকা পাসপোর্ট সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর অথবা সারেন্ডার করতে হয়।
আবেদনে নিজের দেশ সম্পর্কে যত খারাপ কথা হতে পারে তা উল্লেখ করে বলতে হয় যে, দেশে ফিরে গেলে তাকে মেরে ফেলা হতে পারে। সাধারণত কোনো ভিনদেশি ব্যক্তি কোনো দেশে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইলে সংশ্লিষ্ট দেশ আবেদন প্রার্থীর আবেদনে লেখা অভিযোগের সত্যতা নিজস্ব উদ্যোগে যাচাই-বাছাই করে। রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশে তারেকের বিলাতে করা রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনের যৌক্তিকতা আছে। সে কারণে সম্ভবত তার আবেদন গৃহীত হয়েছে। যৌক্তিক রাজনৈতিক কারণে আওয়ামী লীগ বিএনপি দেশে তথ্যটি চেপে যায়!
কারণ তথ্যটি স্বীকার করলে তারেককে দেশে ফিরিয়ে আনতে আওয়ামী লীগের দাবিটি দুর্বল হয়ে যায়। আর তারেক বাংলাদেশের পাসপোর্ট সারেন্ডার করে ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন এটা স্বীকার করলে দেশে দুর্বল হয় বিএনপির রাজনৈতিক ভিত্তি। কারণ তারেক এখন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন। আইনত ব্রিটেন রাজনৈতিক আশ্রয় প্রাপ্ত ব্যক্তির গোপনীয়তার সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সে কারণে ব্রিটেনও এটা অফিসিয়েল ঘোষণা দিয়ে বলবে না যে, তারেক তার দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রাপ্ত শরণার্থীর মর্যাদা নিয়ে বসবাস করছেন। এতে করে বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগ বিএনপির ধূম্রজাল সৃষ্টি করে রাখায় সুবিধাই হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে, আওয়ামী লীগ যে তারেককে ফিরিয়ে আনতে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার কথা বলছে এর ভিত্তি কী? আলোচনা হতেই পারে। কিন্তু তারেককে ফিরিয়ে আনতে বা ফিরিয়ে দিতে ব্রিটিশ আদালতের অনুমোদন লাগবে। এরমাঝে তারেককে আনবোই, এমন সরকারি উক্তি আদালতে তারেকের পক্ষে যেতে পারে। তারেকের আইনজীবীরা আদালতকে এসব উক্তি উল্লেখ করে বলতে পারেন, সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের তরফে এমন উক্তি প্রমাণ করে তারেক বাংলাদেশে গেলে আইনানুগ সুরক্ষা পাবেন না।
আর বিলাত যখন কাউকে শরণার্থীর মর্যাদা দেয় তার আইনানুগ সুরক্ষায় অঙ্গিকারবদ্ধ। কাজেই সাধারণ বিবেচনায় বলা চলে তারেককে বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেয়া সহজ হবে না। এটি তার বিলাতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আগে সম্ভব ছিল। তখন সম্ভবত আওয়ামী লীগ এই ঝামেলা দেশে নিতে চায়নি।
সঙ্গত আরেকটি প্রশ্ন আসতে পারে। তাহলো পাসপোর্ট সারেন্ডার করলে তারেক সৌদি আরব গেলেন কোন পাসপোর্টে? আমার ধারণা শরণার্থী হিসাবে তারেকের হাতে জাতিসংঘ উদ্বাস্তু হাইকমিশনের দেয়া ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট আছে।
কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোতে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রাপ্ত শরণার্থীদের পাসপোর্টের বিকল্প হিসাবে নীল রঙের এই ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট দেয়া হয়। অনেক দেশ এই ট্র্যাভেল ডকুমেন্টসে ভ্রমণ অনুমোদন করে, অনেক দেশ করে না। যেমন সৌদি আরবে যেতে তারেক ভিসা পেয়েছেন, কোকোর মৃত্যুর পর মালয়েশিয়ায় যেতে ভিসা পাননি।
তারেকের এতদিনে ব্রিটিশ পাসপোর্ট হয়ে যাবার কথা। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনীতিকরা দেশে নির্বাচনের স্বার্থে প্রকাশ্যে বিদেশি নাগরিকত্ব পাসপোর্ট নেন না। কোকোর স্ত্রী-সন্তানরা বাংলাদেশে যাতায়াত করেন। সম্ভবত তাদের বাংলাদেশি পাসপোর্টের মেয়াদ আছে অথবা তাদের হাতে মালয়েশিয়ার পাসপোর্ট আছে। নির্দিষ্ট বড় অংকের অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রভাবশালী অনেকের সেকেন্ড হোম মালয়েশিয়া।
ফজলুল বারী: পরিব্রাজক সাংবাদিক, বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী।
fazlulbari2014@gmail.com