আমি কি কোনো অন্যায় করেছি, মানুষ খুন করেছি, চুরি-ডাকাতি করেছি? কারও কিছু লুট করেছি, কাউকে সর্বস্বান্ত করেছি? না, তা করিনি। রাজনীতি করেছি, নিজের সুবিধা চেয়েছি, লোক ঠকিয়েছি? না, তাও নয়। তবে কী করেছি, যার শাস্তি চিরকালের নির্বাসন? কী করেছি যে হাসিনা খালেদা তত্ত্বাবধায়ক সব সরকারের বেলায় আমাকে আমার নিজের দেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না, এই একই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।কোনো একটি বিষয়ে, সব রাজনীতিবিদের কোনো সিদ্ধান্তে কি এমন চমৎকার মিল পাওয়া যায়? কোনো একটি মানুষের বিরুদ্ধে চরম অন্যায় করে কি কোনো সরকার এমন পার পেয়ে যায়? কোনো একটি মানুষের ওপর নির্যাতন হচ্ছে দেখেও দেশের সব মানুষ কি এমন মুখ বুজে থাকে, বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ? এমন অদ্ভুত কাণ্ড সম্ভবত ইতিহাসে নেই।
আমার জনপ্রিয় বইগুলোই সরকার নিষিদ্ধ করেছে। এক সরকারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে অন্য সরকারও বই নিষিদ্ধ করেছে। নিষেধাজ্ঞা ব্যাপারটি বড্ড সংক্রামক। একবার নিষিদ্ধ করে যদি দেখা যায় কোনো প্রতিবাদ হচ্ছে না, তখন নিষিদ্ধ করাটা নেশার মতো হয়ে দাঁড়ায়। আমার বইগুলো যেন সরকারের খেলনার মতো। খেলনা নিয়ে যা খুশি করেছে, ভেঙেছে, ছুড়েছে, মাস্তি করেছে। খালেদা সরকার ‘লজ্জা’ নিষিদ্ধ করেছে, লজ্জা ছিল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে একটি মানবিক দলিল। ‘আমার মেয়েবেলা’ নামের বইটি, যেটি শেখ হাসিনা সরকার নিষিদ্ধ করেছে, সেটি বাংলা সাহিত্যের বড় পুরস্কার ‘আনন্দ পুরস্কার’ ছাড়াও বেশ কিছু বিদেশি পুরস্কার এবং বিস্তর প্রশংসা পেয়েছে। তারপর একে একে আমার আত্দজীবনীর বিভিন্ন খণ্ড ‘উতল হাওয়া’, ‘ক’, ‘সেইসব অন্ধকার’ নিষিদ্ধ হয়েছে। কেউ আপত্তি করেনি বই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে।
পাকিস্তানের মেয়ে মালালা ইউসুফজাই সেদিন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় মানবাধিকার পুরস্কার (সাখারভ) পেল। মালালা অসাধারণ সাহসী এবং বুদ্ধিমতী একটি মেয়ে। ওর পুরস্কার পাওয়ায় আমি বেশ খুশি। বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমও মালালার পুরস্কার পাওয়ায় বেজায় খুশি। মালালা যে সাখারভ পুরস্কারটি এ বছর পেয়েছে, সেই পুরস্কারটিই আমি পেয়েছিলাম ১৯৯৪ সালে। গত কুড়ি বছরে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম কিন্তু একটি অক্ষরও খরচ করেনি নিজের দেশের মেয়ের পুরস্কার নিয়ে। ফরাসি সরকারের দেওয়া মানবাধিকার পুরস্কার বা সিমোন দ্য বুভোয়ার পুরস্কার, ইউনেস্কো পুরস্কার, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট- আমার কোনো সম্মান বা পুরস্কার পাওয়ার দিকে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম ফিরেও তাকায়নি। সবচেয়ে হাস্যকর ঘটনা ঘটায় বাংলাদেশ দূতাবাসগুলো। আমন্ত্রিত হওয়া সত্ত্বেও আজ অবধি কোনো রাষ্ট্রদূত উপস্থিত থাকেননি আমাকে সম্মানিত করার কোনো অনুষ্ঠানে।