ওয়াদুদ আলী
আফিফা বললো- ‘‘বাবা মারা গেছে, আর পড়বো না। তার কথা শুনে আমি বাকরুদ্ধ হওয়ার উপক্রম! দ্রæত নিজেকে সামলে নিলাম। বললাম, কেন মা পড়বা না। সে একই উত্তর- বাবা মারা গেছে, আর পড়বো না।’’ আফিফার পুরো নাম আফিয়া ইয়াসমিন আফিফা। বয়স মাত্র ৮ বছর। মাহিগঞ্জ বেজ এডুকেয়ারে ১ম শ্রেণীতে পড়ে। এ ঘটনা ঘটে গতকাল বৃহস্পতিবার বাদ যোহর মাহিগঞ্জ দেওয়ানটুলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে।
দৈনিক সমকালের স্টাফ রিপোর্টার ও রংপুর অফিস প্রধান, দীপ্ত টিভির প্রতিনিধি, মাহিগঞ্জ প্রেসক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক, রংপুরের সাংবাদিক মহলসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের প্রিয় মুখ, নিরহংকার, সৎ চরিত্রের অধিকারী, সততা ও নিষ্ঠার প্রতীক, বিশিষ্ট সাংবাদিক মরহুম ইকবাল হোসেনের জানাযা দেওয়ানটুলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। জানাযা শেষে আমি মাঠে দাঁড়িয়ে থাকার সময় ভিডিও জার্নালিষ্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি দক্ষ ক্যামেরাপার্সন শাহ নেওয়াজ জনি আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবকের কোলে একটি শিশুকে দেখিয়ে বললো মামা, ওই শিশুটি সাংবাদিক ইকবাল ভাইয়ের মেয়ে। ফুটফুটে শিশুটিকে দেখে আমি কোলে নিলাম। শিশুটির দু’হাতে ফুল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, মা তোমার নাম কি। সে বললো, ‘‘আমার নাম আফিয়া ইয়াসমিন আফিফা।’’ কোন ক্লাসে পড়- ‘‘ক্লাস ওয়ানে পড়ি।’’ এ সময় আমি তাকে বললাম, ‘‘মা তোমাকে ভালোভাবে পড়াশুনা করতে হবে।’’ সে জানালো, ‘‘বাবা মারা গেছে, আর পড়বো না।’’ এ কথা শুনে আমার বাকরুদ্ধ হওয়ার উপক্রম! আমি মস্তিস্কে ও হৃদয়ে রক্তক্ষরণের অনুভূতি অনুভব করলাম। চোখে জল এসে গেলো। দ্রæত নিজেকে সামলে নিয়ে তাকে বললাম, মা তোমাকে পড়াশুনা করতে হবে। আমরা তোমার পাশে আছি। আফিফা শিশু বলেই হাসতে হাসতেই উত্তর দিচ্ছিল। কারণ, তার বাবা মারা যাওয়ার বিষয়টি জানা থাকলেও মাত্র ৮ বছর বয়সের কারণে এই শিশু জানে না তার জীবনে কত বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে গেছে। সে হারিয়েছে তার পিতা ও অভিভাবককে। যে তাকে প্রতিদিন আদর করত। তার পছন্দের নানা খাবার ও খেলনা নিয়ে বাড়ি ফিরত তার বাবা। আফিফার মাঝে লক্ষ্য করলাম না যে, জানাযা শুরু হওয়ার আনুমানিক ১৮ ঘন্টা আগেই তার বাবা বিশিষ্ট সাংবাদিক ইকবাল হোসেন মারা গেছেন। এ সময় বিবেকের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হলো। সাংবাদিক ইকবাল হোসেনের জানাযা শুরু হওয়ার আগে সমবেত মুসল্লির উদ্দেশ্যে রংপুর বিভাগ উন্নয়ন আন্দোলন পরিষদের আহŸায়ক, রংপুর প্রেসক্লাবের একাধিকবার নির্বাচিত সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বিশিষ্ট সাংবাদিক ওয়াদুদ আলী আমার নাম ও পরিচয় তুলে ধরে আমাকে প্রথমে বক্তব্য রাখার সুযোগ দেয়া হয়। আমি আমার বক্তব্যের শুরুতে উল্লেখ করি, ‘‘ইকবাল তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও’’ আমি তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থী। কারণ, আমার ইচ্ছা, আন্তরিকতা ও স্বদিচ্ছা থাকা সত্তে¡ও সাংবাদিকদের ওই সংগঠনের সাধারণ সদস্য পদ দিতে পারিনি। আমার প্রচেষ্টায় অনেকেই সাধারণ সদস্য পদসহ বহিস্কৃত সদস্যরা সদস্য পদ ফিরে পেলেও ইকবালের মত একজন পেশাদার, নির্ভীক, সৎ-সাহসী, দক্ষ সাংবাদিককে আমি সাধারণ সদস্য পদ দিতে পারিনি। আমি বিশ্বাস করি, ইকবাল হোসেনকে আল্লাহ-তায়ালা জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করবেন। ইকবালের শিশু কন্যা মা আফিফা তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও তোমার যোগ্য পিতাকে আমি সদস্য করতে পারিনি। আমরা সাংবাদিক সমাজ মরণব্যাধি থেকে ইকবালকে রক্ষা করতে পারিনি। তবে কথা দিচ্ছি, তোমার পাশে থাকবো মা।
আমি আমার বক্তব্যে মরহুম সাংবাদিক ইকবাল হোসেনের সততা, স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা, দায়িত্বশীলতা, আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একজন সংবাদকর্মী, মানবতাকর্মী, দল নিরপেক্ষ, গণমাধ্যমের প্রতিনিধি হিসেবে তার সংক্ষিপ্ত কর্মকান্ড তুলে ধরে উলেখ করি- আমি যখন ২৬ বছর আগে রংপুর থেকে প্রকাশিত দৈনিক পরিবেশের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলাম সে সময় ওই পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করতো। তখন থেকেই তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত-পেশাগত-হৃদয়িক-আদর্শিক-নীতিগত গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়। মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত সুস্থ থাকা অবস্থায় সে যখন দৈনিক সমকাল ও দীপ্ত টিভি স্টাফ রিপোর্টার ছিল তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক আরও গভীর হয়। প্রেসক্লাবের ২য় তলায় আমার দৈনিক ইত্তেফাকের অফিস ছিল। আমার অফিসের পাশের কক্ষেই ইকবাল হোসেনের দৈনিক সমকাল পত্রিকার অফিস ছিল। প্রায় প্রতিদিন আমি আমার স্বভাবসুলভ খোঁজ-খবর নেয়ার অংশ হিসেবে তাকে জিজ্ঞাসা করতাম, আজ কি খবর আছে? অমায়িক ব্যবহারের অধিকারী ইকবাল প্রাণ খুলে হাস্যোজ্বল মুখে আমাকে রংপুরের দিনে ঘটে যাওয়া সকল সংবাদের (ডে ইভেন্ট) কথা জানাতো। এর মধ্যে যেগুলো খবর আমার জানা থাকতো না সেগুলো আমাকে দিতো। কোন কারপন্য করতো না। প্রথম আলো’র রংপুর অফিসের স্টাফ রিপোর্টার আরিফুল হক রুজুসহ বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে তার এই সম্পর্ক ছিল। বিশেষ করে রংপুর তথা উত্তরাঞ্চলের গর্ব প্রবীন সাংবাদিক আব্দুস সাহেদ মন্টু, এ অঞ্চলের একমাত্র সাহসী ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার জনপ্রিয় মুখ চ্যানেল আইয়ের স্টাফ রিপোর্টার মেরিনা লাভলীর সঙ্গে সারাদিনই সে নিউজের কাজে ব্যস্ত থাকতো। এক পর্যায়ে আমি আমার বক্তব্যে উল্লেখ করি, রংপুরের একটি সাংবাদিক সংগঠনের পর পর ২ বারসহ ৩ বারের নির্বাহী ও পর পর ৩ বারসহ ৫ বারের গুরুত্বপর্ণ পদের দায়িত্বে থাকাকালে ইকবাল হোসেনের মত একজন সৎ, নির্ভীক, সাহসী সাংবাদিককে ওই সংগঠনের সাধারণ সদস্য করতে পারিনি। এজন্য আমি অনুতপ্ত, দুঃখিত এবং ক্ষমা প্রার্থী। আমি আমার বক্তব্যে উল্লেখ করি, অনেকবার চেষ্টা করেও ইকবালকে আমার সেই প্রিয় সংগঠনের সাধারণ সদস্য করতে পারিনি। যেখানে আমার প্রায় ৩ যুগ ধরে মেধা, শ্রম, অর্থ বিনিয়োগ করে প্রায় সকল সদস্যের মন জয় করেছিলাম। ফলে তারা আমাকে ৩ বার নির্বাহী, ৫ বার গুরুত্বপূর্ণ ও ১ বার নির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত করেছিলেন। আমি ক্ষোভ ও দুঃখের সঙ্গে জানাই, ইকবালের মৃত্যুর পর যারা সংঘবদ্ধ হয়ে ওই সংগঠনে ইকবালকে সাধারণ সদস্য হতে বাঁধা প্রদান এবং ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার চালিয়েছিল তাদের আজ মায়াকান্না দেখে মনে হচ্ছে, ‘‘মাছের মায়ের পুত্র শোক’’। এই লেখা যখন লিখছি তখন ফেসবুক ও গণমাধ্যমে দেখছি ‘‘ইকবাল হোসেনের মৃত্যুর পর এখন অনেকেই শোকের সাগরে ভাঁসছেন। তারা কেউ কেউ ইকবালের রঙিন ছবিকে সাদাকালো করে লিখেছেন ‘‘ইকবাল তুমি আমাকে ক্ষমা করো’’ আবার কেউ লিখেছেন ‘‘ইকবাল আমাদেরকে ক্ষমা করো’’ ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে গণমাধ্যম কর্মীসহ মানুষের সহানুভুতি আদায়ের অপচেষ্টাও করছেন। এরা হচ্ছে, রংপুরের ভাষায় ‘‘মিচকে শয়তান।’’ তারা কথা বলেন, ‘‘ফেরেশতার মত, কাজ করেন শয়তানের মত।’’ ‘‘তারা বক ধার্মিক, বিড়াল তপস্বী।’’ এদের অনেকেই সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে অথবা সংগঠনের নির্বাচনের সময় পলিসি মেকারের (নীতি নির্ধারনী) দায়িত্ব পালন করেন। ‘‘সংগঠনকে কুক্ষিগত করে সকল সুযোগ-সুবিধা নিজেরা ভোগ করবেন’’ এই হীনমানসে ওই সংগঠনের কয়েকজন সদস্যের যৌথ প্রযোজনার কয়েক দফা বলি হয়েছে ইকবাল। ওই সংগঠনের প্রায় সকল সদস্য তাকে কথা দিয়েছিল, তুমি ভালো ছেলে, ভালো সাংবাদিক, তাই তোমাকে আমরা সদস্য করবো। কিন্তু পরে তারা অধিকাংশ সদস্যই তার সঙ্গে বেঈমানী ও বিশ্বাস ঘাতকতা করেন। জানাযা শেষে উপস্থিত মুসল্লিদের মধ্যে মাহিগঞ্জের বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ ইকবাল হোসেনকে নিয়ে আমার সত্য বক্তব্যের কারণে আমাকে জড়িয়ে ধরে সহমর্মিতা জানান।
প্রয়াত সাংবাদিক ইকবাল হোসেনের জানাযা’য় আরও বক্তব্য রাখেন, রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ও রংপুর চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রির সাবেক প্রেসিডেন্ট আবুল কাশেম, রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি সাফিয়ার রহমান সফি, ইকবাল হোসেনের চাচা পাউবো কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দিন, দৈনিক যুগের আলোর মহানগর প্রতিনিধি ও মাহিগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হাশেম আলী, মাহিগঞ্জ তরকারী বাজার জামে মসজিদের সাবেক খতিব শহিদুল ইসলাম প্রমুখ।
উল্লেখ্য, দৈনিক সমকালের স্টাফ রিপোর্টার ও দীপ্ত টিভির রংপুর প্রতিনিধি ইকবাল হোসেন বুধবার রাত ৮:১৫ মিনিটে রংপুর মহানগরীর মাহিগঞ্জ দেওয়ান টুলি নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাহি রাজেউন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৪৪ বছর। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, এক কন্যা সন্তান, মাসহ অসংখ্য গুনগ্রাহী রেখে গেছেন। ইকবাল হোসেনের মৃত্যুতে আমি গভীর শোকাহত ও মর্মাহত। তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। তার পরিবার পরিজনদের জানাচ্ছি গভীর সমবেদনা।
লেখক:আহবায়ক, রংপুর বিভাগ উন্নয়ন আন্দোলন পরিষদ