আর্কাইভ  মঙ্গলবার ● ১৯ মার্চ ২০২৪ ● ৫ চৈত্র ১৪৩০
আর্কাইভ   মঙ্গলবার ● ১৯ মার্চ ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: রংপুরের আলু যাচ্ছে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে       গ্রাহকের ৫০ লাখ টাকা নিয়ে উধাও পোস্টমাস্টার!       চার ঘণ্টা পর উত্তরবঙ্গের সাথে ঢাকার ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক       ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন       রংপুরে মিস্টি ও সেমাই কারখানায় ৫০ হাজার টাকা জরিমানা      

 width=
 

‘জনদল’ থেকে যেভাবে আজকের জাতীয় পার্টি

শুক্রবার, ১৯ জুলাই ২০১৯, দুপুর ১২:২৪

সেন্ট্রাল ডেস্ক: সামরিক ও গোয়েন্দা শক্তিসহ রাষ্ট্রের সব ধরনের ক্ষমতা ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পায় জাতীয় পার্টি। বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতা দখলের পর ’৮০-এর দশকে দলটি প্রতিষ্ঠা করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। প্রতিষ্ঠালগ্নে তিনি আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ আরও কয়েকটি দলে ভাঙন ধরান। মন্ত্রিসভার সদস্য করাসহ নানা প্রলোভনে রাজনৈতিক দলের নেতাদের বাগিয়ে নেন তিনি। বিশ্লেষণে দেখা যায়— বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নিহত হওয়ার পরপরই এরশাদের ক্ষমতালিপ্সা ফুটে উঠে। জিয়াউর রহমানের পর বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের সময়ে সেনাবাহিনীকে রাষ্ট্রক্ষমতার অংশ দেয়ার দাবি করেন এরশাদ।  যার অংশ হিসেবে ১৯৮১ সালের নভেম্বরে সেনাপ্রধান হিসেবে এরশাদ সংবাদপত্রের সম্পাদকদের ডেকে রাষ্ট্রক্ষমতার অংশ দেয়ার দাবি তুলে ধরেন। পরবর্তীতে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক আইন জারি করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন।  বিনা রক্তপাতে নির্বাচিত সরকারকে নির্বাসিত করেন। রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর জিয়াউর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার অভিলাস প্রকাশ পায় এরশাদের।

১৯৮৪ সালে এরশাদ প্রথমে ‘জনদল’ নামে একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। আ.লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা কোরবান আলী ও বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা আবদুল হালিম চৌধুরীকে মন্ত্রিত্ব দিয়ে দলে ভেড়ান।  এছাড়া মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আ.লীগের একাংশ, কাজী জাফর আহমেদ ও সিরাজুল হোসেন খানের গণতন্ত্রী দল, আ.লীগের সাবেক চিফ হুইফ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, বিএনপির শামসুল হুদা চৌধুরী, ড. এম এ মতিন, জিয়াউদ্দিন আহমেদ, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী, আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর মতো রাজনীতিবিদদের পক্ষে আনেন এরশাদ।

এরপর ১৯৮৫ সালের শেষ দিকে এসব নেতাদের সমন্বয়ে গঠন করেন জাতীয় ফ্রন্ট। ১৯৮৬ সালে বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে উপ-রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পান।  এর আগে ১৯৮৬ সালের পয়লা জানুয়ারি জাতীয় ফ্রন্টের পাঁচটি শরিক দল একত্র হয়ে জাতীয় পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘটে। নবগঠিত পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হন এইচ এম এরশাদ এবং মহাসচিব নিযুক্ত হন এম এ মতিন।  তবে খুব বেশি দিন জাতীয় পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারেননি এরশাদ। ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ার পর থেকেই জাতীয় পার্টিতে অন্তকোন্দল দেখা দেয়। ১৯৯৬ সালে এসে ভাঙনের মুখে পড়ে জাতীয় পার্টি।

ওই সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সরকারি দল আ.লীগের সমর্থন ছেড়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে যোগ দেন এরশাদ। এরশাদের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে জাতীয় পার্টি- জেপি নামে নতুন দল গঠন করেন তৎকালীন যাগাযোগমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু।  ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে নাজিউর রহমান মঞ্জু জাতীয় পার্টি নামে আরেকটি দল গঠন করেন। বর্তমানে এই অংশের নেতৃত্বে আছেন আন্দালিব রহমান। জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব এম এ মতিনের নেতৃত্বে ওই অংশটি আলাদা হয়েছিল।এ অংশটি জাতীয় পার্টি কাঁঠাল প্রতীকে তাসমিনা মতিনের নামে নিবন্ধিত। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে কাজী জাফর এরশাদকে ছেড়ে আলাদা জাতীয় পার্টি গঠন করেন। এ অংশটি জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) নামে পরিচিত।

জাপা সূত্র মতে, ২০০১ সালে পরবর্তী সময়ে জাতীয় পার্টি ও এরশাদের ব্যক্তিগত জীবনে চরম অস্থিরতা শুরু হয়। এরশাদের দীর্ঘ রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত জীবনে উত্থান-পতনে সবসময় পাশে ছিলেন তার স্ত্রী রওশন এরশাদ।  ২০০১ সালে হঠাৎ বিদিশাকে বিয়ের খবরে ফাটল ধরে এরশাদ-রওশনের দাম্পত্য জীবনে। যদিও ২০০৬ সালে এরশাদ বিদিশার বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটে। মূলত ২০০১ সালের থেকেই এরশাদের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনের নানা নাটকীয়তা শুরু হয়।

রাজনৈতিক মাঠে এরশাদ হাস্যরসের পাত্রে পরিণত হন। সকালে এক কথা, তো বিকেলে আরেক কথা; বলে রাজনীতিবিদদের হাসির খোরাক হয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে খোদ এরশাদকেও কথা বলতে দেখা গেছে।  বিদিশার সঙ্গে বিয়ের পর এরশাদের বারিধারার বাসামুখো (প্রেসিডেন্ট পার্ক) হতেন না রওশন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এরশাদ বাসায় অবরুদ্ধ থাকার সময় কয়েকদিন সেখানে যান তিনি। রাজনৈতিক প্রয়োজনেই সে সময় সেখানে গিয়েছিলেন তিনি।

সূত্র মতে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে এরশাদের জাপা। এরশাদকে ছেড়ে আলাদা জাতীয় পার্টি গঠন করেন কাজী জাফর। এরপর ওই নির্বাচন ইস্যুতে জাপায় এরশাদ ও রওশনকে কেন্দ্র করে দলে দুটি বলয় তৈরি হয়।  এরপর থেকে জাতীয় পার্টি চলছে বলয় দুটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। ওই নির্বাচনের অংশ নেয়ার পক্ষে অবস্থান নেন রওশন ও তার অনুসারীরা। নির্বাচনের বিপক্ষে অবস্থান এরশাদ ও তার অনুসারীরা।

এসময় দলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে রওশনের সঙ্গে না পেরে এরশাদ কোণঠাসা হয়ে পড়েন। ওই নির্বাচনের পর বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচন নিয়ে এরশাদ-রওশন দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে রূপ নেয়। নির্বাচনের পর এক সঙ্গে বিরোধী দল ও সরকারে থাকা-না থাকা নিয়ে উভয় গ্রুপের মধ্যে কোন্দল দেখা দেয়।  কোন্দলের একপর্যায়ে ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি রংপুরের এক কর্মী সম্মেলনে ছোটভাই গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ঘোষণা দেন এরশাদ।  এসময় এরশাদের অবর্তমানে জিএম কাদের জাপার হাল ধরবেন বলেও নেতাকর্মীদের জানান তিনি। একই সঙ্গে জিএম কাদেরকে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক এবং রুহুল আমিন হাওলাদারকে সদস্য সচিব হিসেবে ঘোষণা দেন।

এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন রওশন এরশাদ ও তৎকালীন মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলুপন্থিরা। এর পরদিন ১৯ জানুয়ারি সংসদীয় বিরোধীদলীয় নেতা রওশনের বাসায় প্রেসিডিয়াম সদস্যের একাংশ বৈঠকে বসেন।  বৈঠক শেষে জিয়াউদ্দিন বাবলু রওশন এরশাদকে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দেন। এ সময় তিনি বলেন, গঠনতন্ত্রে কো-চেয়ারম্যান বলে কোনো পদ নেই।

এটা গঠনতন্ত্রের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। পার্টির গঠনতন্ত্রের ৩৯ ধারা বলে কো-চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি (এরশাদ) কাউকে ঘোষণা দিতে পারেন না। তার এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে আজকের বৈঠকে উপস্থিত সব সদস্যের সম্মতিক্রমে রওশন এরশাদকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

এখন থেকে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ চেয়ারম্যান ও জিএম কাদের কো-চেয়ারম্যান হিসেবে অবৈধ। জিয়াউদ্দিন বাবলুর ঘোষণার কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে ওই দিনই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেন, যারা অবৈধভাবে প্রেসিডিয়াম সদস্যের সভা ডেকেছে তারা দলে থাকবে না।

আমি দলের চেয়ারম্যান, আমি ছাড়া প্রেসিডিয়াম সভা আহ্বান করার কারো অধিকার নেই। এটা গঠনতন্ত্রের ৩৯ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে। আমি জীবিত থাকা অবস্থায় কেউ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হতে পারবে না।  রওশনকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা সম্পূর্ণ অবৈধ। এরপর জিয়াউদ্দিন বাবলুর পরিবর্তে প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকে ফের মহাসচিব ঘোষণা দেন এরশাদ। এরপর এরশাদের জীবদ্দশায় ওই দুটি বলয় এক হয়নি।

এরপর জাপার নেতৃত্ব নিয়ে ফের প্রকাশ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় গত বছরের শেষ দিকে। গত ৩ ডিসেম্বর মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে প্রেসিডিয়াম সদস্য মশিউর রহমান রাঙ্গাকে নতুন মহাসচিব নিয়োগ দেন এরশাদ। এরপর ১৭ জানুয়ারি রংপুরে জিএম কাদেরকে পার্টির কো-চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন এরশাদ। এ ঘটনায় আবারো ক্ষুব্ধ হন রওশনপন্থিরা।

একই সঙ্গে জিএম কাদেরকে সরিয়ে রওশন এরশাদে পার্টির কো-চেয়ারম্যান ঘোষণা করতে এরশাদকে চাপ প্রয়োগ করেন তারা। সে যাত্রায় সফলতাও আসে। পরবর্তী দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে ২২ মার্চ কো-চেয়ারম্যান পদ থেকে জিএম কাদেরকে অব্যাহতিতে নিজ স্বাক্ষরিত এক সাংগঠনিক নির্দেশনা জারি করেন এরশাদ।

এরপরই রওশন শিবিরে স্বস্তি ফিরলেও তা বেশি দিন টেকেনি। অব্যাহতি দেয়ার মাত্র ১২ দিনের মাথায় চলতি মাসের ৪ এপ্রিল সহোদর জিএম কাদেরকে পুনরায় পার্টির ভবিষ্যৎ চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন। জিএম কাদেরকে আবার জাতীয় পার্টির (জাপা) কো-চেয়ারম্যান পুনর্বহাল করেন জাপা চেয়ারম্যান এরশাদ।

তার অবর্তমানে জিএম কাদের পার্টির সার্বিক দায়িত্ব পালন করবেন বলেও ঘোষণা দেন এরশাদ। এরপর আবারো সক্রিয় হয়ে উঠেছেন জিএম কাদের বিরোধীরা। এ ঘটনার রওশন এরশাদ, গত সরকারের দুই মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, সাবেক মহাসচিবসহ অনুসারীরা ক্ষুব্ধ হন।  দ্বন্দ্ব বা বিভেদ থাকলেও এরশাদের উপরই আস্থা রেখেছেন দলটির নেতাকর্মীরা। সময়ে সময়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেও এরশাদের সিদ্ধান্তেই ঐক্যবদ্ধ থেকেছেন কর্মীরা। অর্থাৎ, এরশাদ যেদিকে ছিলেন, সে বলয়টি ছিলো শক্তিশালী।

গত দুই দশক ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে এরশাদের জাতীয় পার্টি। বড় দুটি দলের মধ্যে এরশাদ যেদিকে সমর্থন বা যোগ দিয়েছেন— সে দলই রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে।  যার কারণে এরশাদবিহীন জাতীয় পার্টির ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। বড় ধরনের বিভেদের মুখে পড়তে পারে দলটি। নেতৃত্ব নিয়ে ভাঙন হতে পারে দলটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে।

মন্তব্য করুন


 

Link copied