সেই রাতে আমি ঘুম থেকে হঠাৎ খুব ভয় পেয়ে জেগে উঠি। আমার মনে হয় আমার পায়ের কাছে অন্ধকারে বাপ্পি বসে আছে। অনেকে হয়তো ভাবছেন আমি কোনও ভূতের গল্প লিখছি। না, বাপ্পিকে আমি ভূত হিসেবে দেখিনি। ও চুপটি করে বসে ছিল, যেন আমার কাছে জানতে চাচ্ছিল ওর সাথে ন্যায়বিচার হবে কিনা, ওকে এভাবে মরতে হল কেন। উত্তর না শুনে যেন ও যাবে না। উত্তর না দিতে পেরে আমি রাত জেগে ওই অন্ধকারের দিকে চেয়ে বসে থাকতাম। প্রতি রাতেই আমার ঘুম এভাবে ভেঙে যেতো, আর আসতো না। আমি কাঁদতাম, খুব কাঁদতাম। আমার মা আমাকে মনরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গেলেন। আমি ওই লোকটাকে একটা কথাও বললাম না। একদিকে তাকিয়ে বসে রইলাম।
আমার মা অসহায়ের মতো আমাকে কিছুক্ষণ কথা বলতে বললেন, এরপর যখন বুঝলেন আমি কিছুই বলব না, চুপ হয়ে গেলেন। ডক্টর আঙ্কেল আমাকে ঘুমের ওষুধ দিলেন আর কিছু তথাকথিত উপদেশ দিলেন। আমি মনে মনে ভাবছিলাম, বাপ্পিকে কোন উপদেশটা দিলে সে আর আমাকে বিরক্ত করবে না। আমার নিউজপেপার পড়া বন্ধ হয়ে গেলো। আমি আর কখনোই একটা সাধারণ মেয়ে ছিলাম না।আমি এখনও বাস্তবতাকে গ্রহণ করতে শিখতে পারিনি। এখনো রসুর মতো একাধিক ধর্ষণের আসামীদের কাহিনী পড়লে আমার ভেতর থেকে আত্মা কেঁপে ওঠে। আমি স্বপ্নে সেই সব অসহায় মেয়েদের দেখি। নিউজপেপারের প্রথম পাতা আমার সামনে খোলা থাকলেও আমি আর সেখানে বসে থাকতে পারিনা, পাতা উল্টে দেই। একজন মানুষ আরেকজনকে কষ্ট দিচ্ছে, নির্যাতন করছে, মেরে ফেলছে, এমন খবরে আমার গা গুলিয়ে ওঠে, নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে আসতে চায়। আমি স্বাভাবিক থাকতে পারিনা। আমি আর সাধারণ মেয়ে থাকতে পারিনি। মানুষের নিকৃষ্টতা আমাকে থাকতে দেয়নি।
রাজনীতিবিদদের বলছি : একের পর এক আপনারা হরতাল-অবরোধ দিয়ে যাচ্ছেন, মানুষ পুড়ছে, অঙ্গ হারাচ্ছে, চিকিৎসাও পাচ্ছে না সবাই, মারা পরছে অনেকে, আপনারা রাতে ঘুমান কেমন করে? আপনাদের কাঁধে তো সমাজের সকলের দায়িত্ব। সিক্সে পড়ুয়া একটা মেয়ের ঘাড়ে তার সমবয়সী অচেনা একটা ছেলের নৃশংস মৃত্যুর দায়ভার আসে না। তাও তো আমি ঘুমাতে পারতাম না। আমি আর কখনোই স্বাভাবিক হতে পারিনি। আপনারা এত মানুষের আহাজারির জন্য দায়ী হয়েও ঘুমাচ্ছেন কেমন করে? কেমন করে সকালে উঠে ব্রেকফাস্ট করছেন? আপনাদের গা কেন আমার মতো গুলিয়ে ওঠে না? কেন আপনারা কেঁদে কেঁদে রাত পার করছেন না? আপনারা কি কিছুই বোধ করতে পারেন না? আচ্ছা আপনারা কি মানুষ না???
(বিঃদ্রঃ আমি নাম মনে রাখতে পারিনা, অনেক কিছুই মনে রাখতে পারিনা। কোনও তথ্যে গরমিল থেকে থাকলে আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী)
তাহমিদা হোসেন শিমু, শিক্ষার্থী, মিলিটারি ইনিস্টিটিউট অব সায়েন্স টেকনোলজি, ঢাকা।