মমিনুল ইসলাম রিপন, রংপুর: রংপুর-বগুড়া মহাসড়কের দমদমা ব্রিজ। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই ব্রিজের পাশে কারমাইকেল কলেজের কয়েকজন শিক্ষককে সহ অনেক মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। ব্রিজ সংলগ্ন সেই স্মৃতিবিজড়িত দমদমা বধ্যভূমি এখন পড়ে আছে অযতœ-অবহেলায়। অরক্ষিত থাকায় বধ্যভূমিটির দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। দমদমার মতো একই চিত্র রংপুরের শতাধিক বধ্যভূমির।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পেরিয়েছে ৪৮ বছর। অথচ মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতিবিদ্বেষী গণহত্যার প্রমাণবাহী বধ্যভূমিগুলোর বেশির ভাগই পড়ে আছে অরক্ষিত অবস্থায়। বধ্যভূমিতে অবাধে চরানো হচ্ছে গবাদি পশু। আবার কিছু বধ্যভূমি নদীর কোল ঘেষে হওয়ায় সেখান থেকে তোলা হচ্ছে গাড়ি গাড়ি বালু। নেই কোনো সীমানাপ্রাচীর। কোথাও কোথাও বধ্যভূমি দখলে নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে দোকান ঘরও। যেন অস্তিত্ব সংকটে বধ্যভূমি।
যাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। সেই শহীদদের রক্তে ভেজা বধ্যভূমির সংরক্ষণে অবহেলা ও নজরদারির অভাবে ক্ষুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা ও বিশিষ্টজনরা। তাদের দাবি, মুক্তিযুদ্ধের শোক ও গৌরবের স্বাক্ষী বধ্যভূমিগুলো নতুন প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণের পাশাপাশি রাজাকার-আল বদরদের তালিকা প্রকাশ করা হোক।
একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এ দেশীয় দোসরদের সহায়তায় রংপুরের মুক্তিপাগল মানুষকে ধরে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এর মধ্যে কিছু জায়গা বধ্যভূমি হিসেবে চিহ্নিত করে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হলেও অনেক জায়গা এখনো চিহ্নিতই করা হয়নি।
রংপুরে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ণ করতে নিসবেতগঞ্জ, জাফরগঞ্জ, দখিগঞ্জ, বালারখাল, নব্দীগঞ্জ, সাহেবগঞ্জ, লাহিড়ীর হাট, ঝড়ুয়ার বিল, শংকরদহ, বল্লভবিষু, টাউন হলসহ বেশ কিছু বধ্যভূমিতে পরিকল্পিতভাবে হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি সেনারা।
রংপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সূত্রে জানা গেছে, এই জেলার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের ঝড়ুয়ার বিল। ১৯৭১ সালে ঝাড়–য়াল বিলে একসঙ্গে প্রায় দেড় হাজার মানুষকে পাকিস্তানি হানাদাররা গুলি করে হত্যা করে। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৫ বছর পর ২০১৬ সালে সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে।
রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কের হাজিরহাট এলাকায় জাফরগঞ্জ ব্রিজের পাশে রংপুর শহরের ব্যবসায়ী অশ্বিনী ঘোষসহ ১৯ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেখানে আজও কোনো স্মৃতিফলক নির্মিত হয়নি।
রংপুর টাউন হল ছিল পাকিস্তানি হায়েনাদের ফুর্তিমহল। এটাকে টর্চার সেল বানানো হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করা হতো টাউন হল এলাকায়।
এছাড়াও রংপুরের গঙ্গাচড়ার তিস্তা তীরবর্তি শংকরদহ গ্রামে ১৯৭১ সালে ঘটেছিল এক নারকীয় হত্যাকান্ড। পাকিস্তানি বাহিনীর বুলেট কেড়ে নেয় ১৭ জনের প্রাণ। এর মধ্যে মসজিদে নামাজ আদায়রত অবস্থায় পাকিস্তানি সেনারা ব্রাশফায়ারে ছয়জনকে হত্যা করে। স্বাধীনতার এত বছর পরও সরকারিভাবে শংকরদহ বধ্যভূমিতে কোনো স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়নি।
মুক্তিকামী মানুষের ওপর পাকিস্তানিদের অবর্ণনীয় বর্বরতার অনেক চিহ্নই আজ মুছে গেছে। জানা অজানা অনেক ইতিহাস রয়েছে বধ্যভূমিকে ঘিরে। একেকটি বধ্যভূমি যেন একটি করে গোরস্থান। এসব বধ্যভূমি সংরক্ষণের পাশাপাশি পাকিস্তানিদের দোসর রাজাকার আলবদরদের চিহ্নিত করে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা জরুরি বলে মনে করছেন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত হোসেন।
তিনি বলেন, ‘যাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, সেই শহীদদের অনেক বধ্যভূমি আজও অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানোর লক্ষ্যে বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা জরুরি।’ এসময় তিনি বলেন, ২০১৫ সালে রংপুর বিভাগের ৫ জেলার ৫ হাজার ৬শ’ ৬৬ জন রাজাকারের তালিকা করা হয়েছিল। কিন্তু তা প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। এখন সময় এসেছে এ তালিকা প্রকাশ করার।
প্রজন্ম একাত্তর রংপুর জেলা কমিটির সভাপতি দেবদাস ঘোষ দেবু বলেন, ‘আমার বাবাসহ অনেক মুক্তিকামী মানুষকে পাকিস্তানি সেনারা জাফরগঞ্জ ব্রিজে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। সেখানে আজও কোনো নামফলক বা স্মৃতিস্তম্ভ নেই। এমন আরো অনেক জায়গা রয়েছে, যা আজও সংরক্ষণ করা হয়নি।’