আর্কাইভ  শনিবার ● ২০ এপ্রিল ২০২৪ ● ৭ বৈশাখ ১৪৩১
আর্কাইভ   শনিবার ● ২০ এপ্রিল ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: নীলফামারীতে গোপন বৈঠক থেকে জামায়াতের ৩ নেতা গ্রেপ্তার       পলাশবাড়ীতে আসামির ছুরিকাঘাতে বাদীর মৃত্যু, গ্রেফতার ১       মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সন্তান-স্বজনের ভোটে না দাঁড়ানোর নির্দেশ       ভোজ্যতেলের দাম বাড়ল, খোলা তেলে সুখবর       বিএনপি নেতা সোহেলের নিঃশর্ত মুক্তি দাবিতে রংপুরে  মানববন্ধন ও সমাবেশ       

 width=
 

সোলাইমানি হত্যার কী প্রতিশোধ নেবে ইরান?

শনিবার, ৪ জানুয়ারী ২০২০, দুপুর ১২:১১

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণে জরুরি বৈঠক করেছে নিরাপত্তা কাউন্সিল। দেশটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নিরাপত্তা বৈঠকে যোগ দিয়েছেন সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি। সেখানেই সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা সোলাইমানি হত্যার কী ধরনের পদক্ষেপ নেবে ইরান।

এদিকে সোলাইমানি হত্যার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বিশ্বের তেলের বাজারে। চীন-রাশিয়াসহ বিশ্বনেতারাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মার্কিন এই হামলাকে অপরিণামদর্শী বলে বর্ণনা করেছে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও সমালোচনা হচ্ছে সোলাইমানি হত্যার। বিরোধী দল ডেমোক্রেটিকরা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, কংগ্রেসের অনুমতি না নিয়ে ট্রাম্পের একক সিদ্ধান্ত দেশকে আরও ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।

ডেমোক্রেটিক দলের সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ও সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এক টুইট বার্তায় লেখেন, ট্রাম্প ‘খড়কুটোর বাক্সে ডিনামাইট ছুড়ে ফেলেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে একটি বড় ধরনের সংঘাতের মুখোমুখি পড়তে পারি আমরা।’

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক পরিচালক জেমস ক্ল্যাপার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সোলাইমানি নিহতের ঘটনায় ওই অঞ্চলে বসবাসরত আমেরিকানদের জীবন হুমকির মুখে পড়বে। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রশাসনের সময় পূর্ব মধ্যপ্রাচ্য এবং উপসাগরের মধ্যে কো-অর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ফিলিপ গর্ডনের মতে, সোলাইমানির হত্যা এক অর্থে ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকার ‘যুদ্ধ ঘোষণা’।

দেশটির টেলিভিশনে প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সেইয়েদ মোহাম্মদ মারান্দি বলেন, প্রতিশোধের সময় আসন্ন এবং সব পশ্চিমা নাগরিককে, বিশেষ করে আমেরিকানদের অতিসত্বর মধ্যপ্রাচ্য ছাড়ার তাগিদ দেন তিনি।

সোলাইমানি নিহত হওয়ার ঘটনায় নিরাপত্তা সংকটের আশঙ্কায় যত দ্রুত সম্ভব ইরাকের বাগদাদ ছাড়ার জন্য সেখানকার মার্কিন নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে স্থানীয় মার্কিন দূতাবাস। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন মহলের আশঙ্কার পর এখন অপেক্ষা জেনারেল কাসেম সোলাইমানি হত্যার কী প্রতিশোধ নেই ইরান, তা দেখা।

ইরানের চিরবৈরী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে হামলা চালিয়ে ইরানের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা সোলাইমানিকে হত্যা করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন।

বৃহস্পতিবার রাতে ইরাকের বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সোলায়মানি ও ইরাকি মিলিশিয়া বাহিনীর গাড়ি লক্ষ্য করে একাধিক রকেট হামলা চালানো হয়। এ সময় জেনারেল কাসেম সোলায়মানি, ইরাকি মিলিশিয়া কমান্ডার আবু মাহদি আল মুহান্দিসসহ সাতজন নিহত হন।

ইরান-ইরাকের প্রতিক্রিয়া

সুইস রাষ্ট্রদূতকে রাজধানী তেহরানে ডেকে পাঠানো হয়েছে। ইরানে আমেরিকান স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করছে সুইস দূতাবাস। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামিক বিপ্লবের পর দেশটিতে দূতাবাস বন্ধ করে যুক্তরাষ্ট্র। তখন থেকেই সেখানে সুইস দূতাবাসই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করছে।

কুদস কমান্ডারের হত্যার বদলা নিতে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি। আর তাতে যেকোনো সময় মার্কিন স্বার্থের ওপর ইরানের হামলার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

গত সপ্তাহে বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসে হামলা-ভাঙচুর চালায় শতাধিক ইরাকি নাগরিক। এ ঘটনায় ইরানকে দায়ী করে ‘চরম পরিণতি’ ভোগ করতে হবে বলে হুমকি দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তারপরই সোলাইমানির ওপর বিমান হামলা করে তাকে হত্যা করা হয়।

এখন প্রতিশোধের আগুনে উত্তপ্ত হচ্ছে ইরান। দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লা খামেনি বলেছেন, যেসব অপরাধী তাদের নোংরা হাত দিয়ে গতরাতে জেনারেল সোলাইমানির রক্ত ঝরিয়েছে তাদের জন্য কঠোর প্রতিশোধ অপেক্ষা করছে।

সোলাইমানি নিহতের পর গতকাল এক শোকবার্তায় ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ইরানে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেন। তাকে শহীদ হিসেবে আখ্যায়িত করে খামেনি বলেন, ‘এই প্রিয় আত্মোৎর্গকারী শহীদের অনুপস্থিতি আমাদের জন্য কষ্টকর হলেও তার রেখে যাওয়া আন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয় তার হত্যাকারী ও অপরাধীদের জন্য হবে আরও বেশি তিক্ত।’

কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র ভয়ংকর কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ করেছে বলে মন্তব্য করেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাওয়াদ জারিফ। তিনি বলেন, জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঝাণ্ডাবাহী কমান্ডার জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে হত্যা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মাধ্যমে ওয়াশিংটন একটি ভয়ংকর, কাণ্ডজ্ঞানহীন ও উত্তেজনা সৃষ্টিকারী পদক্ষেপ নিয়েছে।

সোলাইমানির সঙ্গে নিহত হয়েছেন ইরাকি মিলিশিয়া কমান্ডার আবু মাহদি আল মুহান্দিস। ইরাকের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী আদেল আবদেল মাহদি যুক্তরাষ্ট্রের চালানো ওই হামলাকে আগ্রাসন বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি সতর্ক করেছেন, জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যার ঘটনা ভয়াবহ যুদ্ধের দিকে ধাবিত করবে। আর ইরাকি সামরিক কমান্ডার মুহান্দিসকে গুপ্তহত্যা ইরাক এবং এর জনগণ ও সরকারের বিরুদ্ধে আগ্রাসন।

এক প্রতিক্রিয়ায় ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডসের মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রামেজান শরিফ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল কুদস ফোর্সের কমান্ডারকে হত্যার ‘কঠোর প্রতিক্রিয়া’ ভোগ করবে।

ইরানের নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠক

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা জানায়, সোলাইমানি নিহতের পর দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণে জরুরি বৈঠক করেছে। দেশটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি নিরাপত্তা বৈঠকে যোগ দিয়েছেন।

রেভল্যুশনারি গার্ডসের সাবেক কমান্ডার মোহসেন রেজায়েই বলেছেন, ‘ইরান আমেরিকার বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিশোধ নেবে।’

জেনারেল সোলাইমানির প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে ইরানের অনেকগুলো টিভি চ্যানেল তাদের স্ক্রিনের ওপরের বাম পাশে কালো ব্যান্ডের শোকের চিহ্ন প্রদর্শন করেছে। দেশে হাস্যরসাত্মক চলচ্চিত্র ও সব ধরনের গানের কনসার্ট বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

মেজর জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যার ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তিধর দেশ রাশিয়া ও চীন। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা ‘সোলাইমানিকে হত্যার উদ্দেশ্যে মার্কিন অভিযানকে অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ’ হিসেবে মনে করে।

এক বিবৃতিতে রাশিয়া জানায়, ‘সোলাইমানি ইরানের জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় বিশ্বস্তভাবে সেবা করে গেছেন। ইরানের মানুষের কাছে আন্তরিকভাবে দু:খপ্রকাশ করছি আমরা।’ অন্যদিকে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গেং শুয়াং একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সব সময়ই জোরজবরদস্তির বিরোধী চীন।’

‘‘এই ঘটনার সাথে জড়িত পক্ষদের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রকে, শান্ত থাকতে ও সংযম অনুশীলন করতে অনুরোধ করবো আমরা, যাতে অস্থিরতা বৃদ্ধি না পায়।’’

যুক্তরাষ্ট্র-ইরানের সংঘাতের পরিণতি

বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হচ্ছে, ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্ভাবনায় থাকতে পারেন। কারণ মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মতো শক্তিশালী ঘনিষ্ঠ সামরিক বন্ধু থাকায় আপাতত ট্রাম্পের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।

যদি সোলাইমানিকে নিহতের ঘটনায় ইরান তৎক্ষণাৎ কোনো প্রতিক্রিয়া থেকে বিরত থাকলেও তারা বিনা প্রতিশোধে সবকিছু হজম করবে তাও অচিন্তনীয়। এর ফলে উপসাগরীয় অঞ্চলে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতে পারে।

ইতোমধ্যে মার্কিন-ইরান উত্তেজনার প্রভাব তেলের বাজারে পড়তে শুরু করেছে। সোলাইমানি নিহতের ঘটনা প্রচারের মধ্যে মুহূর্তেই তেলের দাম শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, তেলের মূল্য আর বাড়তে পারে।

বর্তমানে ইরাকে ৫ হাজার মার্কিন সৈন্য রয়েছে। প্রাথমিকভাবে তারা সম্ভাব্য হামলার লক্ষ্যবস্তু হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে প্রাথমিক ধাক্কা শুরু হবে তেলকে ঘিরে।

সোলাইমানির সঙ্গে আমেরিকার শত্রুতা দীর্ঘদিনের হলেও কেন চলমান ক্রান্তিলগ্নে তাকে হত্যা করতে নির্দেশ দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন তা বোঝাও গুরুত্বপূর্ণ।

সম্প্রতি মার্কিন এক ঠিকাদারকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে ইরানের আধাসামরিক বাহিনী হাশদ আশ-শাবির অন্তত পাঁচটি ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালায় মার্কিন সৈন্যরা। হামলায় অন্তত ২৫ জন নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, এ ঘাঁটিগুলো ইরান সমর্থিত সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর ঘনিষ্ঠ ছিল।

তারপরই পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে ইরাক থেকে আমেরিকার সৈন্য প্রত্যাহারের দাবিতে বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসে হামলা-ভাঙচুর চালায় শতাধিক বিক্ষোভকারী। এই হামলা-ভাঙচুরের পিছনে জেনারেল সোলাইমানির পরোক্ষ ইন্ধন রয়েছে বলে দাবি যুক্তরাষ্ট্রের। এছাড়া সোলাইমানি বাগদাদসহ মধ্যপ্রাচ্যে জুড়ে মার্কিন কূটনীতিকদের ওপর হামলার জন্য ছক কষছিলেন বলেও অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের।

কিন্তু বাস্তবে সোলাইমানি নিহতের ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যে জুড়ে চলমান সংকট আরো বেশি সংঘাতপূর্ণ হবে, যা ট্রাম্প প্রশাসনের দাবির সম্পূর্ণ বিপরীত।

মন্তব্য করুন


 

Link copied