লালমনিরহাট প্রতিনিধি।। কাম কাজ করবার (করতে) না পাইলে হামরা ছাওয়া পোয়া (আমরা ছেলে মেয়ে) মনে হয় সবায় (সকলে) না খেয়া (খেয়ে) মরমো বাহে। বাবা আর কয়দিন এইদন (এমন) করি সউগ (সব) কিছু বন্দ (বন্ধ) থাকবে কবার (বলতে) পান তোমরা বাহে? এভাবেই কথা গুলো বলছিলেন লালমনিরহাট জেলা শহরের পঞ্চাশোর্ধ রিক্সা চালক আবুল হোসেন (৫৫)।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সারাদেশেই রাস্তাঘাটে অচলাবস্থা।
অতিপ্রয়োজন ছাড়া কেউ রাস্তায় বেরুচ্ছেন না। এমতাবস্থায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন দিনমজুর, খেটে খাওয়া মানুষ ও রাস্তায় ছোট ছোট যানচালকরা।
রবিবার (২৯ মার্চ) সকালে লালমনিরহাট জেলা শহরের প্রানকেন্দ্র মিশনমোড়ে এ প্রতিনিধির সাথে কথা হয় রিক্সা চালক আবুল হোসেনের সাথে।
এ সময় আবুল হোসেন বলেন, ‘একদিন রিক্সার চাকা না ঘোরাইলে প্যাটোত খাবার জোটেনা, সংসার চালাইতেও খুব কষ্ট হয়। আর এই অবস্থায় রিক্সা নিয়ে বের হলেও মানুষের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। আর্মি পুলিশের (ডাংয়ের) মারের ভয়ে মানুষ গুলাও রাস্তাত বের হয় না। রাস্তাত যদি মানুষই না থাকে তাইলে রিক্সা বের করি হামার (আমার) কি লাভ। খালি খালি শরীরটাক কষ্ট দেওয়া ছাড়া আর কিছু না। কিন্তু কি করমো (করবো) কন (বলেন) এই রিক্সা ছাড়া আর কোন উপায়ও নাই। মাইনসের (মানুষের) বাড়িত কাজ করমো সেইটাও এলা (এখন) বন্দ (বন্ধ)।
আসপাইনছে দিন গুলা (সামনের দিন গুলো) কেমন করি সংসারের খরচ চালাইম (চালাবো) সেই চিন্তায় দিন কাটিবার নাগছে (লাগছে)।
জেলা শহরের মিশন মোড়ে কথা হয় জিয়া কলোনীর আরেকজন অটো চালক হায়দার আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ৬ সদস্যের পরিবার চালাতে প্রতিদিনই দরকার ৪০০ টাকা দরকার। মানুষশূন্য শহরে অটোগাড়িতে উঠবে কে? কেমনে যে দিন চলবে- বলেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন তিনি। এভাবে আর ২/৩ দিন চললে পরিবার পরিজন নিয়ে হয়তো মরা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না।
রবিবার দুপুর পর্যন্ত সরেজমিন লালমনিরহাট জেলা শহরের কয়েকটি এলাকা ঘুরে কয়েকজন দিনমজুরদের সঙ্গে কথা বললে সবার চোখে মুখেই দুশ্চিন্তার চিত্র দেখতে পাওয়া যায়।
মহেন্দ্রনগর বাজারের ভ্যানচালক সহিদার রহমান (৪৪) বলেন, ‘৫জনের সংসারে একদিন ভ্যান না চালালে চুলায় হাড়ি উঠে না পরিবারের সবাইকে না খেয়ে থাকতে হয়। আর গত ৪দিন থাকি ভ্যান চালাতে না পেরে কি যে কষ্ট তা বুঝাতে পারব না। আজ দুইদিন থেকে এক বেলা করে খেয়ে দিন পার করছি। সরকার থেকে বলা হলেও কোন জন প্রতিনিধি তাকে কোন সহযোগিতা করেন নাই। এই ৪ দিনে ১ হাজার টাকা ধার-দেনা করে সংসার চালাচ্ছেন বলে জানান তিনি।
সকাল সাড়ে ১১টার দিকে সাপ্টিবাড়ি বাজারে আরেক দিনমজুর ফয়জার রহমান (৫৪) এর সঙ্গে দেখা হলে তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, ‘জীবন যে আর চলে না বাহে! কামকাজ সবই বন্ধ। কিন্তু পেট তো আর বন্ধ থাকে না, কোন কিছু বন্ধ মানে না। পেট চালাতে গেলে কাজ লাগে। এই অবস্থায় কেউ তো কাজেও ডাকে না। সবাই বাড়ির ভিতরে ভিতরে থাকে তাই কাম কাজও বন্ধ।
এমন অবস্থায় এই কথদিনেই লালমনিরহাটের খেটে খাওয়া মানুষগুলোর নাভিশ্বাস উঠেছে চরমে। দিনমজুর মানুষগুলোর দাবি প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত কেজিতে ১০ টাকা দরে ওএমএসের মাধ্যমে চাল বিক্রির। লালমনিরহাট জেলা প্রশাসনের ত্রান শাখা পক্ষ থেকে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত জেলায় ১৫ মেট্রিক চাল ও ৫ লাখ টাকা অসহায় মানুষদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া আর্ও ৮৫ মেট্রিক টন চালের বরাদ্দ পাওয়া গেছে। সেগুলোও বিতরণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
লালমনিরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার উত্তম কুমার বলেন, ৩শ প্যাকেট খাবারেরর প্যাকেজ প্যাকেট ইতিমধ্যেই বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া ১৩ মেট্রিক চাল আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। যা বিতরণের জন্য প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের মাধ্যমে তালিকা প্রস্তুতের কাজ চলছে। খুব দ্রুতই তা বিতরণ করা হবে বলেও জানান তিনি।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবু জাফর বলেন, গোটা জেলায় ইতিমধ্যেই ১৫ মেট্রিক টন চাল ও নগদ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। আরও ৮৫ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যা বিতরণের জন্য প্রতিটি উপজেলার উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা কাজ করে যাচ্ছে।
সেই সাথে তিনি প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাহিরে না বাহির হয়ে বাড়িতেই থাকার পরামর্শ দেন।