রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ সরোয়ারুল আলম জানান, এ বছর রংপুরে এক হাজার ৮শ’ হেক্টর জমিতে হাঁড়িভাঙা আম হয়েছে। আম্পানের সামান্য ক্ষতি হলেও প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে বেশি। হাঁড়িভাঙা আম চাষে কোনও ক্ষতিকর কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না। রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার পদাগঞ্জ এলাকায় হাঁড়িভাঙা আম প্রথম উৎপাদন করেন কৃষক সালাম। আঁশমুক্ত ও সুস্বাদু হওয়ায় এ আমের চাহিদা এখন সারা দেশে। এখন বদরগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের গোপালপুর , পদাগঞ্জ কুতুবপুর ইউনিয়নের নাগেরহাট সর্দারপাড়া, সদর উপজেলার সদ্যপুস্করণী ইউনিয়নের কাঁটাবাড়ি, পার্শ্ববর্তী মিঠাপুকুর উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হাঁড়িভাঙা আমের বাগান গড়ে উঠেছে। মূলত লাল মাটিতে এ আমের চাষ ভালো হয়। গত বছর আমের দাম ভালো পাওয়ায় আরও নতুন নতুন আম বাগান গড়ে তুলেছেন এ এলাকার সাধারণ মানুষ। এবার হাঁড়িভাঙা আমের ফলনও হয়েছে বাম্পার। বদরগঞ্জ ও মিঠাপুকুর উপজেলার ৭০টি গ্রামের মানুষ এই আম চাষ করে তারা এখন স্বাবলম্বী।
তবে ক্ষুদ্রচাষিদের অভিযোগ, তারা আমের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। আম সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে তারা আরও বেশি লাভবান হতেন। বড় ব্যবসায়ীরা আগাম টাকা দিয়ে আমের বাগান কিনে নিয়ে লাভবান হচ্ছেন বেশি। তারা আম সংরক্ষণের ব্যবস্থা করার দাবি জানান।
সরেজমিন বদরগঞ্জ উপজেলার পদাগঞ্জ এলাকায় সারি সারি আমের বাগান দেখা গেছে। প্রতিটি বাড়িতে ১০ থেকে ১৫টি, কোনও বাড়িতে তার চেয়ে বেশি হাড়িভাঙ্গা আমের গাছ রয়েছে। আর ১৫-২০ দিনের মধ্যে সবগুলো গাছের আম পাকবে বলে আমচাষিরা জানালেন। ওই এলাকার কৃষক মমতাজ উদ্দিন, আয়েন উদ্দিন, মোসলেমা বেগমসহ অনেকেই জানালেন আট-দশ বছর আগেও এসব এলাকার মানুষের ছিল চরম অভাব। তিন বেলা তো দূরের কথা, এক বেলাও খাবার জুটতো না। এলাকাটির মাটি লাল হওয়ায় এখানে বছরে একবার ধান উৎপাদন হতো। বাকি আট মাস পতিত পড়ে থাকতো জমি। কিন্তু হাঁড়িভাঙা আম তাদের ভাগ্যের চাকা বদলে দিয়েছে। এখন ওই জমিতে আমের বাগান গড়ে তুলেছেন তারা। আম বিক্রি করে তাদের সংসারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে। যাদের জমি নেই সেইসব পরিবারগুলো বাস্তুভিটাতেই হাঁড়িভাঙা আম গাছ লাগিয়ে ভালোভাবেই জীবন যাপন করছেন।
এলাকাবাসী জানালেন, পদাগঞ্জ হাট এখন দেশে অতি পরিচিত। কারণ, এখানে আমের মৌসুমে হাঁড়িভাঙা আমসহ বিভিন্ন ধরনের আমের পাইকারি বাজার বসে। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এসে এখান থেকে আম কিনে নিয়ে যায়।
হোসনে আরা নামে এক নারী জানান, পাঁচ বছর আগে তার স্বামী মারা গেছেন। পাঁচ সন্তান নিয়ে আনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটতো তার। স্বামীর রেখে যাওয়া চার বিঘা জমিতে আমের বাগান করে প্রতি বছর আম বিক্রি করেই তিন-চার লাখ টাকা আয় হয় তাদের। এখন তিনি সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করাচ্ছেন।
এ বছর এই আম সুষ্ঠুভাবে বাজারজাত করার বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তা, রংপুরের বদরগঞ্জ ও মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের নিয়ে পদাগঞ্জ এলাকায় জেলা প্রশাসক আসিব আহসান এক মত বিনিময় সভা করেছেন। সভায় রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের যাতে ব্যবসায়ীরা যাতে হাঁড়িভাঙা আম কিনে নিয়ে যেতে পারেন সেজন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসক বলেন, ‘হাঁড়িভাঙা আম যাতে নিরাপদে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাইকাররা নিয়ে যেতে পারেন সে জন্য গাড়িতে বিশেষ স্টিকার দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়াও পথে যাতে ব্যবসায়ীরা হয়রানির শিকার না হন সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়াও কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে যাতে মানুষ আম নিয়ে যেতে পারে সেজন্য নগরীর কয়েকটি স্থানে ভ্রাম্যমাণ কুরিয়ার সার্ভিসের শাখা খোলারও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’