আর্কাইভ  শুক্রবার ● ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ● ৬ বৈশাখ ১৪৩১
আর্কাইভ   শুক্রবার ● ১৯ এপ্রিল ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: পলাশবাড়ীতে আসামির ছুরিকাঘাতে বাদীর মৃত্যু, গ্রেফতার ১       মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সন্তান-স্বজনের ভোটে না দাঁড়ানোর নির্দেশ       ভোজ্যতেলের দাম বাড়ল, খোলা তেলে সুখবর       বিএনপি নেতা সোহেলের নিঃশর্ত মুক্তি দাবিতে রংপুরে  মানববন্ধন ও সমাবেশ        খরার ঝুঁকিতে রংপুর অঞ্চল      

 width=
 

উদ্বাস্তু।। শাশ্বত ভট্টাচার্য

মঙ্গলবার, ৭ জুলাই ২০২০, রাত ১০:৫৯

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতীতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ বিভাজন জনিত কারণে রাতারাতি ভিটেমাটি ছাড়তে হয়েছে মানুষকে। এই বাস্তু থেকে উৎখাত হওয়া মানুষরাই চিহ্নিত হয়ে গেছে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় উদ্বাস্তু বলে। রাতারাতি সর্বসান্ত হয়ে গেছে মানুষ। কী ভীষণ নির্মমতা, কী ভীষণ ব না! নিজের ঘর, নিজের দেশ, নিজের মাটি, নিজের আকাশ, নিজের বাতাস, নিজের নদী, নিজের গাছ সব ফেলে রাতের অন্ধকারে ভূগোলের এক সীমানা থেকে চলে যাচ্ছে মানুষ আরেক সীমানায়। আর তার গায়ে সিল লেগে যাচ্ছে ‘উদ্বাস্তু’।

ইতিহাসের এই প্রেক্ষাপটকে ঘিরেই অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখেছেন উদ্বাস্তু। কল্লোলযুগের এই আলোড়ন সৃষ্টিকারী কবি, উপন্যাসিক ১৯০৩ সালে অবিভক্ত বাংলার নোয়খালীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মৃত্যুবরণ করেছেন ১৯৭৬ -এ কলকাতায়। দেশভাগের সময়, ১৯৪৭-এ তিনি অনেকটাই বড়। সুতরাং দেশভঙ্গের অভিঘাত জনিত সামাজিক, রাষ্ট্রিক, পারিবারিক, মনোজাগতিক, অর্থনৈতিক সবকিছুই তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন খুবই গভীর ভাবে। কুড়ি শতক আর একুশ শতক পৃথিবীর ইতিহাসে বিশ^যুদ্ধ, দেশভাগ এবং মানুষের উদ্বাস্তু হবার কাল। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাজন জনিত কারণে উদ্বাস্তু হয় আনুমানিক এক কোটি পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ।

বাংলার গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধে, কবিতায় বারবার উঠে এসেছে এই দেশ বিভাজন এবং তার কারণে উদ্বাস্তু হয়ে পড়া মানুষের নির্মম ইতহাস। জীবনানন্দ দাশের যে কবিতাকে আমরা দেশপ্রেমের বা প্রকৃতি প্রেমের কবিতা বলে এক আপাত সিল মেরে দেই, সেই বিখ্যাত কবিতা ‘আবার আসিব ফিরে’ তারও অতলে রয়ে গেছে উদ্বাস্তু হবার এক করুণ সুর।  অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘উদ্বাস্তু’ কবিতাটিতে ভূষণ পালের পরিবারের কথা বলা হয়েছে। যারা দেশ ত্যাগ করছে। কিন্তু মানুষ তো একটি জড়পি- নয়। তাকে বেঁচে থাকতে হয় তার পরিবেশ-প্রতিবেশ নিয়ে। গাছ-নদী-আকাশ-বাতাস এদের সাথে এক নিবিড় সখ্য গড়ে তুলে। তাই ভূষণ পাল গোটা পরিবারটাকে ঝড়ের মতো নাড়া দিয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যাচ্ছে তখন হিজল গাছের ফুল বলছে যাবে কোথায়? ছলছলাৎ পাগলী নদীর ঢেউও বলছে Ñ আমাদের ফেলে কোথায় যাবে? আমরা কি তোমার গত জন্মের বন্ধু এ জন্মেও কেউ নই? স্বজন নই? এরকম অনেকেই বলছে লক্ষীবিলাস ধান থেকে শুরু করে সান বাঁধানোঘাট সাবাই, সবাই। এই তো, এভাবেই তো মানুষের জড়িয়ে থাকা, এট্ইা তো প্রেম, দেশপ্রেম। দেশপ্রেম তো কোন বিমূর্ত ধারনা নয়। এর ভীষণরকম বস্তুগত আকার রয়েছে। এইসব কিছুকেই ছেড়ে মানুষ উৎখাত হয়ে যায়, উদ্বাস্তু হয়ে যায়। পুরোটাই রাজনীতির খেলা। এই কবিতাতেই সেই নির্মম রাজনীতি, অট্টহাস্যের রাজনীতি, সুবিধাবাদের রাজনীতি, দখল করার রাজনীতি, লুটেখাবার রাজনীতির এক উলঙ্গচিত্র রয়েছে- ওরা কারা চলেছে আমাদের আগে? ওরা কারা? ওরাও উদ্বাস্তু। কত ওরা জেল খেটেছে, তকলী কেটেছে, হত্যে দিয়েছে সত্যের দুয়ারে কত ওরা মারের পাহাড় ডিঙিয়ে গিয়েছে পেরিয়ে গিয়েছে কত কষ্ট-ক্লেশের সমুদ্র... কিন্তু তারাও আজ উদ্বাস্তু হয়ে গেছে। যারা ট্রেনের থার্ডক্লাসে চড়েছে,‘ তারাই এখন চলেছে রকমারি তকমার চোকদার সাজানো দশ ঘোড়ার গাড়ি হাঁকিয়ে’। এও তো বিচ্যুত হওয়া, এও তো উৎখাত হওয়া, এরাই তো সত্যিকারের উদ্বাস্তু,‘কেউ উৎখাত ভিটেমাটি থেকে কেউ উৎখাত আদর্শ থেকে’।

এখনও বাস্তু থেকে উৎখাত হয়ে উদ্বাস্তু হচ্ছে পৃথিবীর অনেক মানুষ। এই তো সেদিনই মিয়ানমার থেকে উৎখাত করা হলো লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাকে। তারা আজ বাংলাদেশে উদ্বাস্তু। কিন্তু আদর্শ থেকে উৎখাত হওয়া মানুষের সংখ্য যে দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই উদ্বাস্তুর সংখ্যা কোনো জনমিতিতে নির্ণয় করা হয় না। এদের ভূখণ্ড ছাড়তে হয় না। নিজ ভূখণ্ডের ভিতরে থেকেই এরা উদ্বাস্তু হয়ে যায়। আদর্শচ্যুতিরও তো নানান মাত্রা রয়েছে। আদর্শও তো কোনো বায়বীয় বিষয় নয়, নয় বুলী সর্বস্বতা। তাকেও আকার দিতে হয় তার দেশপ্রেম, মানব প্রেম, পরিবারপ্রেম ইত্যাদির মধ্যদিয়ে। কিন্তু আমরা চলেছি কোথায়? কী আছে পথের শেষে? আমরা চলেছি? আমরা কারা? মানুষ?. কোন মানুষ? রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে বন্দী মানুষ? বন্দী কী কখনো চলতে পারে? না কি তাকে চালানো হয়? যদি রাষ্ট্রযন্ত্রই আদর্শ থেকে উদ্বাস্তু হয় তো সেই মানুষকে তো সেই যন্ত্র উদ্বাস্তু করবেই। ভিটেমাটি থেকে না হোক আদর্শ থেকে তো করবেই।

শুরু করেছিলাম জীবনের শুরুর দিকে একটি কবিতার প্রভাব বিষয়ে, জীবনের প্রায় উপান্তে এসে সে কথাই ভাবি, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত যা লিখেছিলেন তিরিশের দশকে,‘কেউ উৎখাত ভিটেমাটি থেকে কেউ উৎখাত আদর্শ থেকে’ সেই উৎখাত হয়ে যাওয়া দিনদিন বেড়েই চলেছে।

০৭.০৭.২০২০

লেখক: কলেজ শিক্ষক, সাংস্কৃতিক সংগঠক, সম্পাদক: উত্তরবাংলা ডটকম

মন্তব্য করুন


 

Link copied