ইনজামাম-উল-হক নির্ণয়,তিস্তা থেকে॥ নীলফামারীতে সর্বকালের রেকড ভঙ্গ করেছে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ। আজ সোমবার(১৩ জুলাই/২০২০) সকাল ছয়টায় ডালিয়ায় তিস্তা ব্যরাজ পয়েন্টে নদীর পানি বিপদসীমার(৫২ দশমিক ৬০) ৫২ সেন্টিমিটার(৫৩ দশমিক ১২) ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। গতকাল রবিবার(১২ জুলাই/২০২০) রাত ১২টায় সেখানে পানি প্রবাহ ছিল বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার(৫৩ দশমিক ১৫) ওপরে। এসময় তিস্তা ব্যারাজসহ আশপাশ এলাকায় রেড এলার্ট জারী করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এরপর পানি কমতে শুরু করলে আজ সোমবার সকাল নয়টায় ওই রেড এলার্ড প্রত্যাহার করা হয়।
তিস্তার এমন রুদ্রমূর্তিতে ওই রাতে ব্যরাজ এলাকায় ছুটে আসেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তরাঞ্চলীয় প্রধান প্রকৌশলী জ্যোতি প্রসাদ ঘোষ। প্রসস্তুতি নেন ঢলের পানি বাইপাস করারর। ঘুরে দেখেন ব্যারাজ এলাকা। কিন্তু রাত ১২টার পর আর পানি না বাড়ায় ফাড বাইপাস আর খুলতে হয়নি। এসময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রবিউল ইসলাম, নির্বাাহী প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) একেএম সামসুজোহা, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হাফিজুল হক।
উজানের ঢলে তিস্তার পানি বিপৎসীমার অতিক্রম করে গত শুক্রবার। সে থেকে বিপৎসীমার ওপরে চলছে পানি প্রবাহ। টানা চার দিনের ঢলে জেলার ডিমলা উপজেলার নদী বেষ্টিত পূর্বছাতনাই, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশাচাপানী, ঝুনাগাছচাপনী, পশ্চিমছাতনাই, গয়াবাড়ি ইউনিয়নের ১৫টি গ্রামের পাঁচ সহ¯্রাধিক পরিবার বন্যা কবলিত হয়ে পড়ে। এসব পরিবারের ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ করে চড়ম ভোগান্তিতে পড়ে অনেকে আশ্রয় নেয় বাধসহ বিভিন্ন স্থানে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্রমতে, ২০১৯ সালে তিস্তার সবোর্চ্চ পানি প্রবাহ ছিল ৫৩ দশমিক ১০ সেন্টিমিটার। এসময় বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপরে পানি প্রবাহ হয়। ২০০৭ সালে ছিল ৫৩ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার, ১৯৯৬ সালে ছিল ৫৩ দশমিক ৩ সেন্টিমিটার।
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্র মতে, উজানের ঢলে গতকাল রবিবার রাত ১২টায় ডালিয়ায় তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে নদীর পানি বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। আজ সোমবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ৫২ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার সমান(৫২ দশমিক ৬০) দিয়ে প্রবাহিত হয়।
তিস্তার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে গত শুক্রবার(১০ জুলাই) দুপুরে। সেদিন রাতে ওই পয়েন্টে নদীর পানি বিপদসীমার ৩৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। গত শনিবার(১১ জুলাই) সন্ধ্যা ৬টায় ৩৩ সেন্টিমিটার ও গতকাল রবিবার সন্ধ্যা ৬টায় ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
সূত্র মতে, চলতি বর্ষায় তিস্তার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে গত ২৬ জুন। সেদিন সকাল থেকে বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে অব্যাহত থাকে ২৮ জুন পর্যন্ত। ২৯ জুন থেকে ৩ জুলাই পর্যন্ত বিপদসীমার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। ৪ জুলাই দ্বিতীয় দফায় বিপদসীমা অতিক্রম করে ২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ৬ জুলাই থেকে ১০ জুলাই সকাল ৯টা পর্যন্ত পানি বিপদসীমার নিচে ছিল। সেদিন দুপুরে বিপদসীমার ওপরে উঠলে রাতে ৩৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
ডিমলা উপজেলার টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ময়নুল হক বলেন, আমার ইউনিয়নের এক হাজার ৭০০ পরিবার পানি বন্দী হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। গত চার দিনে নদী ভাঙনের শিকার হয়ে ঘর-বাড়ি হারিয়েছে ২৪ পরিবার। পূর্বখড়িবাড়ি টাবুর চর গ্রামের ঝুঁকিপূর্ণ স্থান থেকে শতাবিক পরিবারকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বন্যাকবলিত পরিবারগুলো রান্না করতে পারছেন না। এজন্য উপজেলা প্রশাসনের কাছে ২০০ প্যাকেট শুকনো খাবার প্যাকেট চেয়েছি।
ঝুনাগাছচাপনী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান বলেন, আমার ইউনিয়নের ভেন্ডাবাড়ি ও ছাতুনামা গ্রামে এক হাজার ৩০০ পরিবার বন্যা কবলিত। নদীভাঙনের শিকার হয়েছে ৬৫ পরিবার। বন্যা কবলিত পরিবারগুলো প্রশাসনের কাছে শুকনো খাবার চাওয়া হয়েছে।
পূর্বছাতনাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ খাঁন বলেন, তিস্তায় রবিবারের পানিপ্রবাহ অতীতের সকল রেকড ভঙ্গ করেছে। ঢলের পানিতে ইউনিয়নের ঝাড়শিংহেশ্বর ও পূর্বছাতনাই গ্রামের এক হাজার ৪০ পরিবার পানিবন্দী রয়েছে।
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ রবিউল ইসলাম বলেন, তিস্তা ব্যারাজ ও আশপাশ এলাকায় গতকাল রবিবার রাতের জারীকরা রেড এলার্ট সোমবার সকালে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এখন পানি কমতে শুরু করলেও ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে রেখে সতর্কাবস্থায় রয়েছি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তরাঞ্চলীয় প্রধান প্রকৌশলী জ্যোতি প্রসাদ ঘোষ বলেন, তিস্তা ব্যরাজের পানি অপসারণ ক্ষমতা সাড়ে চার লাখ কিউসেক। এর বেশী প্রবাহ হলে পানি অপসারণের জন্য ফাড বাইপাস খুলে দিতে হয়। গত রাতের পানি প্রবাহ ওই ফাড বাইপাস খুলে দেওয়ার কাছাকাছি পৌঁছে। রাত ১২টার পর থেকে পানি কমতে শুরু করলে সেটি আর প্রয়োজন হয়নি।
ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়শ্রী রাণী রায় বলেন, চলতি বন্যায় ত্রাণ বিতরণের জন্য ৬০ মেট্রিকটন চাল, এক লাখ টাকা ও ৫০০ প্যাকেট শুকনা খাবার বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। দ্রুত এসব বিতরণের কাজ শুরু হবে।