এই পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীরা আরব বিশ্বের ঘটনাগুলোকে ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গীর বাইরে অন্য কোন দৃষ্টিতেই দেখতে রাজি নন। কিন্তু এদের কণ্ঠেই সাম্য, মৈত্রী আর ভ্রাতৃত্বের শ্লোগান ধরার ইতিহাস বেশি দিন আগের কথা নয়। কে, কতটুকু সম্পদ ভোগ করবে? এই প্রশ্নটি নিয়েই পশ্চিমাদের ব্যতিব্যস্ত থাকার গল্প এখনও সতেজ। কিন্তু এই বুদ্ধিজীবীরাই, আরব বিশ্বের ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করার সময় সমাজের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে এড়িয়ে গিয়ে নজর দেন ধর্মের দিকে। একারণেই, আরবের মানুষদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে পশ্চিমাদের কাছে ধর্মের ও সংস্কৃতির সংঘাত বলে মনে হয়।
আরববিশ্বে ধর্মের প্রাধান্য লাভের অন্যতম কারণ হচ্ছে সৌদি আরব। দেশটি কেবল টাকার জোরে আরবের দেশগুলোর নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা ও বামপন্থী দর্শনের উন্নয়ন ঘটাতে দেয়নি। শুরুতেই মার্ক্সবাদী চিন্তা-ভাবনা আরব বিশ্বে বেশ প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল। কিন্তু গেল শতকের ষাটের দশক থেকে সৌদি আরবের অর্থের বন্যায় মার্ক্সবাদী চিন্তা-ভাবনা আর মাথা তুলে দাড়াতে পারেনি।
আরববিশ্বের এই সংঘাতগুলোকে ধর্মের বা সংস্কৃতির সংঘাত বলে চিহ্নিত করে পশ্চিমারা আদতে তাদের দায় এড়াবার চেষ্টা করে। কেননা, আরব বিশ্বের মানুষে মানুষে বৈষম্য সৃষ্টিতে পশ্চিমা ক্রীড়ানকের ভূমিকা পালন করেছে। একারণেই, পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীরা বৈষম্যের ব্যাপারটিকে আড়াল করে ধর্মকেই প্রধান করে দেখার চেষ্টা করবে এইতো স্বাভাবিক।
আনোয়ার সাদাত, হুসনে মুবারক, বেন আলির মতো আরববিশ্বের শাসকরা প্রগতিশীল শাসকের নামে গণতন্ত্রকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে। এই শাসকরা সুশাসন ও জনগণের অধিকার বলতে যত কিছু ছিল তার সমস্ত কিছুকেই ঝেটিয়ে বিদায় করেছিল। এইভাবে গণতন্ত্রের যে মূল্যবোধ তা পুরোপুরি বিদায় নেয়। এমনকি গণতন্ত্র শেষ পর্যন্ত শোষণ ও নিপীড়নের হাতিয়ারে পরিণত হয়। আরববিশ্বে গণতন্ত্রের হত্যাকারী আনোয়ার সাদাত, হুসনে মুবারক, বেন আলির মতো শাসকদের এক সময় সহায়তা করেছিল পশ্চিমারা। আর এখন যখন মানুষ তার অধিকার ও আইনের শাসনের জন্য লড়ছে তখন তাকে ধর্মীয় সংঘাত বলে চিহ্নিত করে নিজেদের দায়মুক্তি করছে তারা।
কিন্তু আরব বিশ্বের মানুষের মুক্তির আন্দোলনকে ধর্ম কিংবা সংস্কৃতির সংঘাতের বলে চিহ্নিত করলে আসলে আন্দোলনরত মানুষগুলোকে চরম অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। কেননা, এক সংস্কৃতির সাথে অন্য সংস্কৃতির সমঝোতার একটি অবাস্তব ভাবনা। আর একারণেই কোন আন্দোলনকে সংস্কৃতির লড়াই বলে চালিয়ে কোন কালেই এর কোন সমাধান হবে না।
[লেখাটি লেবাননের গবেষক জর্জ ক্রোমের (তিনি নব্বইয়ের দশকে লেবাননের অর্থমন্ত্রী ছিলেন) সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বইয়ের পর্যালোচনা ‘ফরগেট রিলিজিয়ন’ নামের একটি প্রবন্ধ লেখেন কারস্টেন নিপ। প্রবন্ধটি জার্মানভিত্তিক ম্যাগাজিন কোয়েন্টেরাতে প্রকাশিত হয়।]