আর্কাইভ  শনিবার ● ২০ এপ্রিল ২০২৪ ● ৭ বৈশাখ ১৪৩১
আর্কাইভ   শনিবার ● ২০ এপ্রিল ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: নীলফামারীতে গোপন বৈঠক থেকে জামায়াতের ৩ নেতা গ্রেপ্তার       পলাশবাড়ীতে আসামির ছুরিকাঘাতে বাদীর মৃত্যু, গ্রেফতার ১       মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সন্তান-স্বজনের ভোটে না দাঁড়ানোর নির্দেশ       ভোজ্যতেলের দাম বাড়ল, খোলা তেলে সুখবর       বিএনপি নেতা সোহেলের নিঃশর্ত মুক্তি দাবিতে রংপুরে  মানববন্ধন ও সমাবেশ       

 width=
 

উপজেলা নির্বাচন: বিএনপির জন্য নতুন ফাঁদ

বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০১৪, বিকাল ০৭:৫৫

মেজর(অব.) আখতারুজ্জামান: 

বর্তমান সরকারের সামনে এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, সরকারের গ্রহণযোগ্যতা এবং তার মেয়াদের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা। এমনিতেই জনগণ এ সরকারকে ভোট দিতে এগিয়ে আসেনি। তার পরও সরকার গঠনকে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেনি। বর্তমান সরকারের অবস্থান জনগণের কাছে নেতিবাচক কিন্তু তার পরও দেশের শান্তি ও উন্নয়নের স্বার্থে সর্বোপরি নিকট অতীতের চলমান বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য মন্দের ভালো হিসেবে বর্তমান সরকারকে ইচ্ছার বিরুদ্ধেও মেনে নিয়েছে। এ বিষয়টিতে সরকার বিশেষ করে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও খুবই সচেতন। তাই সরকারের বর্তমান অবস্থায় তার মূল কার্যক্রম হলো জনগণের কাছে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা ফিরিয়ে নিয়ে আনা যাতে তার স্থায়িত্ব নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা না হয়।

বর্তমান সরকার খুবই তড়িঘড়ি করে উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই বিএনপি কোনো নীতিনির্ধারণী বৈঠক এমনকি স্থায়ী কমিটির কোনো বৈঠকে আলোচনা না করেই কিছু মুখচেনা নেতাদের দ্বারা উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত সংবাদমাধ্যমে বক্তব্যে জানিয়ে দিয়ে দলের মধ্যে আবারও ধূ¤্র্রজাল সৃষ্টি করেছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় ব্যানারে অংশগ্রহণ করা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত সিদ্ধান্ত। অথচ কোনো আলাপ-আলোচনা বা নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো রকম প্রস্তুতি না নিয়েই যেভাবে উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত ও মনোনয়ন দেওয়ার জন্য বিভিন্ন নেতাদের তথাকথিত দায়িত্ব দিয়ে সংবাদমাধ্যমে সরাসরি বিবৃতি দিয়ে এ অবস্থাটাকে আরো জটিল করে তোলা হয়েছে। অত্যন্ত সঠিকভাবে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব উপজেলা নির্বাচনের ব্যাপারে বক্তব্য দিতে অস্বীকার করে উপজেলা নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়টি আরো বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করে দিয়েছে।

বিএনপির বর্তমান সাংগঠনিক অবস্থা কোনো অবস্থাতেই সরকারের সঙ্গে লড়াই করার মতো সংগঠিত নয়। বর্তমান সরকারের সঙ্গে একটি স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদি যেকোনো সংগ্রামই হোক না কেন, সেখানে ইতিবাচক ফলাফল অর্জন করতে হলে বিএনপিকে সর্বাগ্রে সংগঠিত হতে হবে। এবং সঠিকভাবে দল সংগঠিত হতে হলে অন্ততপক্ষে ছয় মাস সময় প্রয়োজন। সরকার যদি এই সময়ে বিএনপিকে উপজেলা নির্বাচনে ব্যস্ত রাখে তাহলে আগামী জুন-জুলাইয়ের পরে বর্ষাকালে এমনিতেই আন্দোলনের মৌসুম থাকবে না, যার ফলে সরকার হেসেখেলেই আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত কাটিয়ে দিতে পারবে। সরকার যদি ছলচাতুরি করে আগামী এক বছর বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়ে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করতে পারে এবং বিভিন্ন হালুয়া-রুটি বিতরণ করে এরশাদের মূল জাতীয় পার্টির মতো বিএনপিতে বিভিন্ন সময়ে যোগদানকৃত এরশাদের সাঙ্গপাঙ্গদের তাদের পুরনো অভ্যাসের মতো আবারও ডিগবাজি খাওয়াতে পারে তাহলে সরকারের যে পোয়াবারো তাতে কারো কোনো সন্দেহ নেই। বিএনপির একশ্রেণীর নেতারা চারিত্রিকভাবেই সুবিধাবাদী ও সুযোগসন্ধানী। তাদের বেশির ভাগই কখনোই এক দলে বা জোটে স্থায়ীভাবে থাকেননি। স্বাধীনতার পর থেকেই এসব নেতা যখন যেখানে সুবিধা পেয়েছেন সেখানেই তারা ধাবিত হয়েছেন। বিএনপির একমাত্র  বেগম খালেদা জিয়া ও আশির দশকের নেতৃবৃন্দ ছাড়া কারোরই জন্মগত একমাত্র দল বিএনপি নয়। পঁচাত্তর-পূর্বে অনেকে আওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগ, ন্যাপসহ বিভিন্ন বাম, ডান ও ধর্মভিত্তিক দল করতেন, যাদের অনেকেই দলছুট হয়ে পঁচাত্তর-উত্তর রাজনীতিতে বিএনপির পতাকাতলে আশ্রয় লাভ করেছেন। তাদের মূল লক্ষ্যই হলো ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা অর্জন ও ভোগ করা। তাই বর্তমান সরকার যদি আগামী ৫ বছর ক্ষমতায় থাকে তাহলে ওই নেতাদের পক্ষে তাদের ভোগ-বিলাসের রাজনীতি করার সুযোগ যেমন নেই তেমনি তাদের চারিত্রিক দুর্বলতার কারণেই আন্দোলন বা সংগ্রাম করে বর্তমান সরকারের স্থায়িত্ব কমিয়ে আনারও ক্ষমতাও তাদের নেই। বিএনপির এসব সুবিধাবাদীরা খুব ভালো করেই জানেন যেহেতু তারা আন্দোলন-সংগ্রাম করতে পারবেন না এবং বিএনপিতে তাদের বাদ দিয়ে অন্য কারো আন্দোলন-সংগ্রামে জয়ী হলে তাদের অবস্থান ঝুঁকিতে পড়বে। তাই তারা জ্ঞাতসারে বিএনপির অন্য কোনো নেতাদের আন্দোলন করার সুযোগও দেবে না। তাদের নিজেদের রাজনীতির লক্ষ্য অর্জনের জন্য ভবিষ্যতে একটি পথই খোলা থাকবে, হয় গোপনে সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা ও অর্থের বিনিময়ে বিএনপিকে ধ্বংস করার সব চেষ্টা অব্যাহত রাখা অথবা দল ছেড়ে আওয়ামী লীগের নৌকায় উঠে পড়া। এর কোনোটাই করতে বিএনপির এসব কায়েমি সুবিধাবাদী নেতাদের পক্ষে কঠিন নয়। এবং অতীতেও তারা বহুবার এ ধরনের কার্যক্রম করে তাদের পারঙ্গমতা জাতির সামনে প্রমাণ করেছেন যার সর্বশেষ বাস্তব প্রমাণ হলেন কাজী জাফর আহমদ।

সরকারের গ্রহণযোগ্যতা ও স্থায়িত্ব ছাড়াও আগামী ৬ মাসের মধ্যে সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে একটি সুষম ও জনমুখী বাজেট তৈরি করা। ইতিমধ্যেই রপ্তানি আয় কমেছে, বিদেশ থেকে অর্থ আসাও কমে গেছে এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণও লক্ষণীয়ভাবে অর্জিত হয়নি। তাছাড়া বিশ্বব্যাংক, জাইকাসহ জাপান, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এমনকি ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তহবিল থেকেও ঋণ বা সহায়তা পাওয়া অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে আছে। তাই আগামী বাজেটে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণে অনেক বেশি চাপ সৃষ্টি হবে, যার ফলে সরকার জনগণ-বৈরী একটি বাজেট তৈরি করতে বাধ্য হতে পারে। তাই আগামী বাজেট প্রণয়নে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বর্তমান সরকারের ভঙ্গুর গ্রহণযোগ্যতা ও অনিশ্চিত স্থায়িত্ব, যা সরকারকে আরো বেশি হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে হয়তো কঠিন চাপের মুখোমুখি দাঁড় করাবে। তাই সরকার খুবই পরিকল্পিতভাবে রাজনৈতিক শক্তিকে উপজেলা নির্বাচনে নামিয়ে দিয়ে বাজেট-উত্তর সম্ভাব্য আন্দোলনের পটভূমিকা নির্বাচনোত্তর আন্দোলনে রূপান্তরিত করে তাদের গ্রহণযোগ্যতা ও স্থায়িত্বের প্রশ্নটিকে আড়াল করার চেষ্টা করবে।

সরকার ভালো করেই জানে উপজেলা নির্বাচনে জামায়াত সর্বশক্তি দিয়ে অংশগ্রহণ করবে। দেশে ও বিদেশে জামায়াত শুভাকাক্সক্ষীদের সামনে জামায়াতের অবস্থান সুস্পষ্ট করার জন্য আগামী উপজেলা নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জামায়াত তিনটি বিষয় স্পষ্ট করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে। প্রথমত, উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামী তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব ও পরিচিতি টিকিয়ে রাখবে। দ্বিতীয়ত, উপজেলা নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের মাধ্যমে জামায়াত যে এখনো জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক দল, সেটি প্রমাণ করবে। এবং তৃতীয়ত, জামায়াত উপজেলা নির্বাচনের ছত্রচ্ছায়ায় বর্তমানে প্রায় বন্ধ তাদের সব সাংগঠনিক কার্যক্রম সারা দেশে আবারও জোরেশোরে ও প্রকাশ্যে চালিয়ে জামায়াতের সাংগঠনিক অবস্থা সুদৃঢ় ও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবে। উপজেলা নির্বাচনে জামায়াতের জয়লাভ করার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাশাপাশি উপজেলার সব আসনে প্রকাশ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তাদের অবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ জামায়াতে ইসলামী কোনো অবস্থাতেই হাতছাড়া করবে না। তাই সরকার মনে করে জামায়াতকে এ ধরনের সুযোগ দিয়ে বর্তমানে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুটিকে কিছুটা হলেও নমনীয় অবস্থায় নিয়ে এসে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা ও স্থায়িত্বের ইস্যুটিকে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে আবারও জামায়াতবিরোধী রাজনীতির নামে বিএনপিকে সুকৌশলে জামায়াত-শিবিরে ঠেলে দিয়ে প্রয়োজনে যুদ্ধাপরাধী ইস্যুটিকে কাজে লাগিয়ে বিএনপিকে আবারও ঘায়েল করতে পারবে।

উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করলে খুব স্বাভাবিক অবস্থায় তাকে নির্বাচনের মাঠে একই সঙ্গে জামায়াত ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। তখন খুবই সংগত কারণে আওয়ামী লীগ-বিএনপির পারস্পরবিরোধী দ্বিপক্ষীয় বিরোধিতার কারণে কৌশলগতভাবেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে স্থানীয়ভাবে জামায়াত-বিএনপি এক হয়ে যাবে, যার একশ ভাগ সুযোগ অবশ্যই আওয়ামী লীগ তথা সরকার নেবে। জাতীয় পর্যায়ে বিএনপি যেহেতু প্রকাশ্যে জামায়াতের পক্ষ অবলম্বন করবে না কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপি-জামায়াত উপজেলা নির্বাচনভিত্তিক সমঝোতা বিএনপির জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়াবে। একইভাবে আগামী উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করলে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা ও স্থায়িত্ব নিয়ে যেকোনো আন্দোলনে উপজেলা নির্বাচনে জয়ীদের সমর্থন হারাবে। বিগত আন্দোলনে বিভিন্ন বিজয়ী মেয়র ও কাউন্সিলদের তেমন লক্ষণীয় অবস্থান দেখা যায়নি। পক্ষান্তরে পরাজিত হলে পরাজিতদের নিয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে সরকারের সঙ্গে অরাজনৈতিক ইস্যু প্রাধান্য পাবে এবং জাতীয় ও রাজনৈতিক ইস্যু গুরুত্ব হারিয়ে ফেলবে। কাজেই উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করলে জয়-পরাজয় যা-ই হোক না কেন বিএনপি উভয় দিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই সরকারবিরোধী বৃহত্তর আন্দোলনের কোনো অবস্থাতেই উপজেলা নির্বাচনের জালে পা দেওয়া স্বার্থে বিএনপির বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। বরং এই সময়টাকে সরকারকে উপজেলা নির্বাচনের মাঠে ব্যস্ত রেখে বিএনপিকে দল গোছানোর কাজে লাগানো উচিত এবং ছয় মাসের মধ্যে দলকে পুনর্গঠিত করে আগামী জুনে একটি বৃহত্তর গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার পরিবেশ সৃষ্টি করার দিকে এগোনোই হবে বিএনপির সর্বোত্তম রাজনৈতিক পরিকল্পনা। অপেক্ষা শুধু সময়ের এবং সঠিক সিদ্ধান্তের।

মন্তব্য করুন


 

Link copied