আর্কাইভ  বৃহস্পতিবার ● ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ● ৫ বৈশাখ ১৪৩১
আর্কাইভ   বৃহস্পতিবার ● ১৮ এপ্রিল ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: পলাশবাড়ীতে আসামির ছুরিকাঘাতে বাদীর মৃত্যু, গ্রেফতার ১       মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সন্তান-স্বজনের ভোটে না দাঁড়ানোর নির্দেশ       ভোজ্যতেলের দাম বাড়ল, খোলা তেলে সুখবর       বিএনপি নেতা সোহেলের নিঃশর্ত মুক্তি দাবিতে রংপুরে  মানববন্ধন ও সমাবেশ        খরার ঝুঁকিতে রংপুর অঞ্চল      

 width=
 

বাংলাদেশের দাস!

বৃহস্পতিবার, ১ মে ২০১৪, দুপুর ১২:১৬

মাহমুদ উল্লাহ

না। এই একুশ শতকেও এই প্রথা রয়ে গেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আর বিভিন্ন নামে। দাসপ্রথা এই নামটি শুধু নেই। অন্য নামের আড়ালে এই প্রথা এখনও চলছে। এশিয়ার বিভিন্ন দেশে জোড় করে পতিতাবৃত্তি করানো, আরব দেশগুলোতে এশিয়ান গৃহকর্মীদেরকে নির্যাতন, আইভরি কোষ্টের শিশু কোকোচাষী ইত্যাদী বিশ্বের বর্তমান দাসপ্রথারই উদাহরণ। সকালে উঠে এক কাপ চা না হলে আমাদের চলেই না। কিন্তু এই চায়ের পিছনেও রয়েছে দাসপ্রথার গল্প। আমরা ঘুরতে যাই সিলেটের চা বাগানগুলোতে। ভাল লাগে চা শ্রমিকদের ব্যবহার। থাকি চা বাগানের সুন্দর সুযোগসুবিধা সম্বলিত নয়নোভিরাম বাংলোগুলোতে । কিন্তু তার পিছনের অন্ধকার দিকটির খবর আমরা কখনো জানার চেষ্টাও করি না। পাহাড়ি জঙ্গল পরিস্কার, রাস্তাঘাট নির্মাণ, গৃহ নির্মাণ ও বর্ধণশীল আগাছা নিয়মিত পরিস্কার করে চা আবাদের জন্য দরকার হয় প্রচুর শ্রমিকের। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও ভারতে প্রথম চা আবাদের সময় শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছিলো না।  লোভী এজেন্টরা স্থানীয় কিছু ধুর্ত আড়কাঠি বাছাই করে তাদের কাজ দিতেন শ্রমিক সংগ্রহ করার জন্য। আর তখন কুলি ব্যবসা ছিল খুব  জমজমাট। কোনমতে কোন শ্রমিককে ভুলিয়ে-ভালিয়ে জাহাজঘাট পর্যন্ত এনে দিতে পারলেই মিলতো টাকা।  শ্রমিকদের এনে চা বাগানের কাজে লাগানো হলো। তারা দিনরাত অমানুষিক পরিশ্রম করতে লাগলো। কিন্তু দুঃখের বিষয় এত পরিশ্রম করার পরও তারা খুব সামান্যই মজুরী পেত। তা দিয়ে কোনভাবে একবেলাও খাবার জুটতো না তাদের। একদিকে বাগান মালিকদের অত্যাচার আর অন্যদিকে অনাহারে জীবন ধারন করে ধীরে ধীরে তারা হয়ে পড়ে নিস্তেজ । তখন তাদেরকে বিনোদন ও চাঙ্গা করার জন্য দেওয়া হত মদ। এই মদের আড়ালেও রয়েছে ধূর্ত ব্রিটিশদের কলোনিয়ালিজমের কালো অধ্যায়। এই কুলি মজুররা যেন কোনভাবেই মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। কোন বিদ্রোহ যাতে দানা বাধতে না পারে এবং তারা যাতে এই মাদকের মধ্যেই বিভোর থাকে এই জন্যই এই বিষবাষ্প ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তাদের মাথায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও তাদের উপর চালানো হয় নির্যাতন । শত শত নারী শ্রমিক পাক হানাদার বাহীনি দ্বারা তাদের সম্ভ্রম হারান। তারাও এই দেশকে স্বাধীন  করার জন্য  মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিল। প্রায় ১০০০ শ্রমিক যুদ্ধে নিহত হন। বাগানে চা গাছ বছরের পর বছর যত্ন করে কুড়ি থেকে বড় করে তোলেন চা শ্রমিকেরা। পাতা ছেড়া থেকে শুরু করে পরিশোধিত চা দেশ-বিদেশে রপ্তানীর সিংহভাগ কৃতিত্ব তাদের। অথচ যাদের রক্তে, ঘামে আর নরম হাতের স্পর্শে এদেশের চা বিশ্বব্যাপি হয়েছে সমাদ্বৃত, সেই শোধনকৃত চা পানের আর্থিক সংগতিই তাদের নেই। দেশের মোট ১৬৩ টি চা বাগানে প্রায় ৮ লক্ষ লোক বসবাস করেন। এর মধ্যে প্রায় দেড় লক্ষ্য শ্রমিক বাগানগুলোতে চাকরিরত আছেন। শ্রমিকদের বেশিরভাগই নারী। তাদের কাজ শুরু হয় সকাল ৮ টায় আর শেষ হয় বিকাল ৫ টায়। দুপুরের খাবারের সময় বাদ দিয়ে কাজ করে মোট ৮ ঘন্টা। প্রতি কেজি পাতা তোলার জন্য পান ২ টাকা। একজন শ্রমিক প্রতিদিন গড়ে ২৫ থেকে ৩০ কেজি পাতা আহরন করতে পারেন। আবার বর্ষাকালে তাও সম্ভব হয় না। এ থেকে তাদের আয় হয় গড়ে ৬০ থেকে ৭০ টাকা। যেখানে অন্যান্য সেক্টরের শ্রমিকরা কাজ করে পান ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা। বর্তমানে চা বাগানের শ্রমিকদের মজুরি ৭০ টাকা, অথচ যেখানে চালের দর প্রতি কেজি ৪০ টাকারও বেশি। শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় ৩০,০০০ কিশোরী শ্রমিকও বাগানগুলোতে কাজ করে। তারা একজন পূর্ণ শ্রমিকের সমান কাজ করলেও পান অর্ধেক মজুরি। অর্থাৎ এখানেও তারা মজুরি বৈশম্যেও শিকার। চা বাগানগুলোর প্রায় ৯০ শতাংশ লোকই  ভুগছে অপুষ্টিহীনতায়। প্রতিটি শ্রমিকই বাগানে কাজ করে নিজের থাকার জন্য পান একটি করে ঘর। ৮ ফিট বাই ১২ ফিটের ছোট ছেটে সেই ঘরের মধ্যেই গরু ভেড়া নিয়ে একত্রে বসবাস করছে তারা। আর কোন কারনে যদি তিনি চাকরিটি হারান তবে ঘরটিকেও তাকে ছেড়ে দিতে হয়। এসব চা বাগানগুলোতে নেই কোন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। মালিকদের তৈরী কিছু বিদ্যালয় থাকলেও তাতে নেই পর্যাপ্ত কোন উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষক। এখানে অল্প বয়সে সন্তান নেওয়ার ফলে কিশোরী মায়েদের স্বাস্থ ভেঙ্গে যায় খুব তাড়াতাড়ি। ঠিকমতো খেতে না পেরে পুষ্টিহীনতার কবলে পড়ে তারা। শ্রমিকদের মনোরঞ্জনের জন্য মদের বৈধ লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি চা বাগানেই একটি করে সরকারী মদের দোকান ও একটি করে স্থানীয় চোলাই মদের পাট্টা রয়েছে। উত্তরাধিকার সূত্রে চা শ্রমিকরা কোন সহায় সম্পত্তি না পেলেও পান মদ্য পানের অভ্যাস। এছাড়া উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাবে শ্রমিক পরিবারের বাকি সদস্যরা বেকার জীবন যাপন করছেন।  যার ফলে দিন দিন বাগানগুলোতে বেড়েই চলছে অপরাধ প্রবনতা। তাদের কর্মসংস্থানের কোন উদ্যোগই কর্তৃপক্ষের নেই। জীবন যেন থমকে রয়েছে তাদের। অনেক কষ্ট আর ত্যাগ তিতিক্ষ্যার মধ্য দিয়ে অসহায় জীবন যাপন করছেন তারা। যুগ যুগ ধরে তারা শিকার অবহেলা আর লাঞ্চনার । এদেরকে এভাবে অবহেলার ফলে সেদিন খুব বেশী দুরে নয়। মাদকাসক্ত এই বিপুল জনশক্তি নিস্তেজ হয়ে পড়বে। তখন এই শক্তি আর কোন কাজেই আসবে না।

মন্তব্য করুন


 

Link copied