১৬ ডিসেম্বর খুব ভোরে শহিদ মিনারে যাবার সময় আচমকা চোখ আটকে যায় রংপুর রেলস্টেশনের গাছের নিচে। কেও বা বস্তা জড়িয়ে কেও বা প্লাস্টিকের কাগজ গায়ে জড়িয়ে জরোসরো হয়ে শুয়ে আছে। পায়ের কাছে প্লাস্টিক ইট দিয়ে ভাড়া দেওয়া আছে যাতে বাতাসে উড়ে না যায়। প্লাস্টিকের উপর পানির মত কুয়াশা জমেছে। ক্যামেরার ফ্লাসের আলোয় এক বৃদ্ধ মাথা থেকে প্লাস্টিক সরিয়ে কাপতে কাপতে বললো “আমারে একটা কম্বল দাও না বাবা।” আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আপনি কি জানেন আজ আমাদের বিজয় দিবস ?” লোকটা আমার প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়েই চোখ মুখে বিরক্তির রেখা একে প্লাস্টিক মুরি দিয়ে পূর্বের মত শুয়ে পরলো। নিজের অজান্তেই আমার বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো।
শুধু রংপুরে নয়, বাংলাদেশের আনাচে কানাচে অসংখ্য অবহেলিত, দারিদ্র, বঞ্চিত মানুষ আছে যারা স্বাধীনতা - পরাধীনতার পার্থক্য বুঝে না। তারা প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাচ্ছে। তাদের যুদ্ধ দু’ মুঠো খাবারের জন্য, সম্ভ্রম ঢাকার একটুকরা কাপড়ের জন্য।
দিন আসে দিন যায়। সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে ভাগ্য বদলায় রাজনৈতিক নেতাদের। কিন্তু ছিন্নমূল অসহায় মানুষের ভাগ্য কোন দিন বদলায় না। এদের আর্তনাত ইট আর টাইলস এর দেয়াল ভেদ করে ধনাঢ্যদের স্বর্গ-পুড়িতে কোন দিন পৌঁছাবে না। এই সব বস্ত্রহীন মানুষের কাঁপুনি স্বর্ণের চামচ মুখে দিয়ে জন্মানো মানুষদের কাছে পৌঁছানোর আগেই রুম হিটারের তাপে জ্বলিয় বাষ্প হয়ে উড়ে যাবে অজানায়। যারা হাজার হাজার টাকার ফুলের পাপড়ি পদদলিত করে নিজেদের ধন্য মনে করে সাধারণ মানুষের কষ্ট বোঝার ক্ষমতা তাদের নেই।
কয়েক দিনের প্রবল শৈত্য প্রবাহে বিপর্যস্ত উত্তরবঙ্গবাসী। বিশেষ করে নিম্ন বিত্ত, দুস্থ, ছিন্নমূল আর বাস্তুহারা মানুষের জন্য কষ্টের কোন শেষ নেই। তারা সাধ্যের সবটুকো ব্যয় করে যে শীতবস্ত্র জোগাড় করেছে তা দিয়ে ৯-১০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা জয় করার ক্ষমতা নেই।
উত্তরবঙ্গের মানুষ দিন দিন মঙ্গাকে জয় করলেও দুস্থ আর ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যা এখানে এখনও আশংকাজনক। অভাবী এই মানুষদের দু’বেলা খাবার যোগাতে যেখানে হিমশিম খেতে হয় সেখানে শীতবস্ত্র কেনার সামর্থ্য তারা কোথায় পাবে। রংপুর রেলওয়ে ষ্টেশন, বাসস্টান্ড, এবং বিভিন্ন পরিত্যক্ত স্থাপনায় রাতে সে সব মানুষ আশ্রয় নেয় তাদের করুণ দুর্ভোগ দেখলেই বোঝা যায় শীতের কাছে তারা কতটা অসহায়।
সরকারী,বেসরকারী এবং বিভিন্ন এনজিও প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই শীতবস্ত্র বিতরণ শুরু করলেও তা নিতান্তই অপ্রতুল।
আসুন আমরা সবাই শীতার্ত মানুষের কষ্টের কথা চিন্তা করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেই। যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের পাশে দাঁড়াই। হয়তো ভাবছেন আপনার সেই আর্থিক সামর্থ্য নেই। একটু কষ্ট করে আপনার ওয়ার্ডপ কিংবা আলনা খুঁজে দেখলেই হয়তো পেয়ে যাবেন পুরোনো কোন কাপড়, আগত্য সেটা দিয়েই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। শুধু একটি কথা মনে রাখবেন, ওরা আমাদের মতই রক্ত মাংসের মানুষ। ওদের ও অনুভূতি আছে, কষ্ট আছে।