আর্কাইভ  শুক্রবার ● ২৯ মার্চ ২০২৪ ● ১৫ চৈত্র ১৪৩০
আর্কাইভ   শুক্রবার ● ২৯ মার্চ ২০২৪
 width=
 

 

কুড়িগ্রামের খাবারে বেজায় খুশি ভুটানের রাজা

কুড়িগ্রামের খাবারে বেজায় খুশি ভুটানের রাজা

কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করলেন ভুটানের রাজা

কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করলেন ভুটানের রাজা

রানিকে নিয়ে কুড়িগ্রামে পৌঁছেছেন ভুটানের রাজা

রানিকে নিয়ে কুড়িগ্রামে পৌঁছেছেন ভুটানের রাজা

কুড়িগ্রামে সমৃদ্ধির হাতছানি

কুড়িগ্রামে সমৃদ্ধির হাতছানি

 width=
 
শিরোনাম: স্বাস্থ্যের রংপুর বিভাগীয় পরিচালক ফজলুল হক কারাগারে       কুড়িগ্রামের খাবারে বেজায় খুশি ভুটানের রাজা       লালমনিরহাটে পুকুরে জাল ফেলতেই জালে উঠে এলো যুবকের মরদেহ       কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করলেন ভুটানের রাজা       রানিকে নিয়ে কুড়িগ্রামে পৌঁছেছেন ভুটানের রাজা      

 width=
 

এক নিষ্ঠুর পাগলা রাজা এবং তার ডাইনি মায়ের ইতিকথা!

মঙ্গলবার, ১১ মার্চ ২০১৪, দুপুর ১০:২০

পাগলা রাজার মা যেনো তার সন্তানের চেয়েও অনেক বেশি খারাপ। তাকেও লোকজন গালা গালি করে অকথ্য ভাষায়- চরিত্রহীনা, ডাইনী, কুত্তী, বেশ্যা- আরো কতো কি! কিন্তু তারপরও মানুষের রাগ কমেনা। আপনি যদি ভূ-মধ্য সাগরের দু’পাড়ের রাজ্য গুলিতে যান তাহলে দেখতে পাবেন- সেখানকার লোকেরা গত দুই হাজার বছর ধরে পাগলা রাজার মায়ের নাম ধরে গালি গালাজ করছে এবং অভিশাপ দিয়েছে। আপনি হয়তো বলবেন-লোকজনের গালাগালিতে কি হয় ? আমি বলবো হয়-অনেক কিছুই হয়। পাগলা রাজা এবং তার মায়ের বংশের একজন লোকও পৃথিবীতে বেঁচে নেই-সম্পূর্ন ভাবে নির্বংশ হয়েছে পাগলা রাজার গোষ্ঠী। অথচ পৃথিবীর তাবৎ রাজ বংশের ২/৪ জন রক্তের ধারক-সব সময় বেঁচে থাকে প্রাকৃতিক নিয়মেই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।

এখন পাগলা রাজার যত্তোসব নষ্টামী, ভ্রষ্টতা এবং নিষ্ঠুরতার ইতিবৃত্ত বলবো। কিন্তু তার আগে বলে নেই তার ডাইনী মায়ের কাহিনী। তিনি ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী, বুদ্ধিমতি এবং প্রচন্ড রকম উচ্চাভিলাসী। তার বিকৃত যৌনাচার এবং সীমাহীন কামুকতার কাহিনী রাজ্যময় বিস্তৃত ছিলো- লোকজন সেই সব কাহিনী বলাবলি করতো আর ভদ্র জনেরা কানে আঙ্গুল দিতো অশ্লীল শব্দরাশি থেকে নিজেদেরকে বাঁচাবার জন্য। চার চারটি বিয়ে এবং চারজন স্বামীকেই তিনি বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছিলেন। সবশেষে তিনি লোভে পড়ে নিজের বয়োবৃদ্ধ চাচাকে বিয়ে করেছিলেন কেবলমাত্র রাজ ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য। তার প্রতিদ্বন্দ্বী কত নারী এবং পুরুষকে যে তিনি খুন করেছিলেন তা কেউ বলতে পারবেনা, হতে পারে কয়েক শ কিংবা কয়েক হাজার পর্যন্ত। তরুন ও যুবকদের প্রতি তার ছিলো ভারী ঝোঁক। ধরে ধরে পছন্দমতো যুবকদেরকে নিয়ে আসতেন আপন প্রাসাদে- তারপর ইচ্ছেমতো কামনা চরিতার্থ করতেন। সেই সব হতভাগ্যরা যাতে কারো কাছে রানী মাতার অভিসারের কথা বলে দিতে না পারে সেজন্য তাদেরকে গুম করে ফেলা হতো-কিভাবে গুম করা হতো তা আজও রহস্যাবৃত।

আমি যার কথা বলছি- তার নাম ছিলো এগ্রোপিনা। ১৫ খ্রীষ্টাব্দের ৭ ই নভেম্বর তিনি জন্ম নিয়েছিলেন। আর মাত্র ৪৩ বছর বয়সে অর্থাৎ ৫৯ খ্রীষ্টাব্দের ২৩ মার্চ মারা গিয়েছিলেন। মারা গিয়েছিলেন - মানে মেরে ফেলা হয়েছিলো। বহু চেষ্টা তদ্বির করে তিনি তার বৃদ্ধ চাচা-যিনি ছিলেন সম্রাট তাকে বিয়ে করলেন। তারপর ছলে বলে কৌশলে সিংহাসনের সকল উত্তরাধীকারীগনকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিলেন। বৃদ্ধ সম্রাট কোন উপায় না দেখে এগ্রোপিনার পূর্বতম স্বামীর ঔরসজাত সন্তানকেই সিংহাসনের উত্তরাধীকারী মনোনীত করলেন। এরপর শুরু হলো অন্য অধ্যায়- একরাতে দেখা গেল বৃদ্ধ সম্রাট মরে গেছেন- আর পরেরদিন মহা সমারোহে পাগলা রাজা সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলেন। এর কিছুদিন পর পাগলা রাজা নিজ হাতে তার মাকে হত্যা করে ফেললেন- সে এক লম্বা কাহিনী !

পাগলা রাজার মায়ের কাহিনী এবং নাম শোনার পরও হয়তো অনেকে রাজার নামটি ধরতে পারেননি। কিন্তু আমি নিশ্চিত- আমি যদি পাগলা রাজার নাম বলি তবে এক কথায় সবাই তাকে চিনতে পারবেন। দুনিয়াতে তার মতো কুকর্ম কেউ করেনি। এমনকি ফেরাউনও নয়। ফেরাউনের বড় দোষ সে নিজেকে খোদা দাবী করেছিলো। পাগলা রাজাও নিজেকে খোদা দাবী করেছিলেন। পার্থক্য হলো কথিত ফেরাউন দ্বিতীয় রামসীস আদতে ছিলেন একজন মহাবীর, মহাজ্ঞানী এবং যুদ্ধজয়ী সুশাসক- মিশরবাসী এখনো তাকে মহান রামেসীস বা রামেসীস দ্যা গ্রেট বলে ডাকে। অন্যদিকে পাগলা রাজার অত্যাচারে রাজ্যময় লোক অতিষ্ট হয়ে উঠেছিলো। তার জুলুম আর পাগলামীতে আল্লার জমিনের মাশরেক থেকে মাগরীব পর্যন্ত তাবৎ ভূ-খন্ডের অধিবাসীরা অভিশাপ বর্ষন করতে থাকে। ফলে আসমান থেকে নেমে আসে একের পর এক বিপর্যয়। পাগলা রাজার স্বপ্নের প্রাসাদ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়- আল্লার গজবে তিনি মৃত্যু বরন করার জন্য চিৎকার করতে থাকেন। পাত্র মিত্র, চাকর বাকর সবার হাত পা ধরতে থাকেন এবং সবাইকে তলোয়ার দিয়ে তাকে হত্যা করার জন্য আকুতি জানাতে থাকেন। কেউ যখন তার অনুরোধে সাড়া দিলোনা তখনই তিনি পৃথিবীর-সেই বিখ্যাত উক্তিটি করেন- তবে কি আমার কোন বন্ধু নেই যে আমার অনুরোধে আমাকে জীবন যন্ত্রনা থেকে মুক্তি দেবার জন্য আমাকে মেরে ফেলতে পারে ; কিংবা আমার কি তাহলে কোন শত্র“ও নেই যে কিনা বিক্ষুব্দ হয়ে আমাকে মেরে ফেলতে পারে?

এবার আমি পাগলা রাজার নামটি বলে মূল কাহিনীটি শুরু করি। তার নাম নীরো। পুরো নাম নিরো ক্লডিয়াস সিজার। ’রোম যখন পুড়ছিলো, নীরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলো- ঐতিহাসিক সেই উপকথাটির নায়ক তিনি। রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট পদে অভিষিক্ত হয়েছিলেন ১৩ ই অক্টোবর ৫৪ খ্রীষ্টাব্দে- যখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। রাজত্ব করেছিলেন মোট ১৪ বছর। ৩০ বছর বয়সে অর্থাৎ ৬৮ সালের ৯ ই জুন রাতে নিজ হাতে নিজের গলায় ছুরি চালিয়ে আত্মহত্যা করার মাধ্যমে একদিকে যেমন নিজের জীবনের সমাপ্তি ঘটান অন্যদিকে মহান পূর্ব পুরুষ জুলিয়াস সিজার প্রতিষ্ঠিত রাজ বংশ এবং ক্লডিয়াস সিজার অগাস্টাস সাম্রাজ্যের প্রায় একশ বছরের পুরানো শাসনামলেরও পরিসমাপ্তি ঘটে। তাঁর কুকর্মের অভিশাপে দুনিয়ার কোথাও মহান জুলিয়াস সিজারের রক্তের কোন ধারক খুঁজে পাওয়া যাবে না- এযেনো প্রকৃতির এক দুরন্ত প্রতিশোধ যা শিক্ষনীয় হয়ে থাকে যুগ যুগান্তরের অত্যাচারী শাসকদের জন্য যদি তারা আসলেই কিছু শিখতে চায়।

নীরোর চরিত্রের বদ জিনিসগুলো মূলত তার মায়ের চরিত্র থেকে সংক্রমিত হতে থাকে। শিশু নীরো দেখতো তার মা দিবা নিশি তার বাবাকে অত্যাচার করছে। প্রাসাদের মধ্যেই একের পর এক অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে। বিশেষ করে মায়ের যৌনাচারের বিকৃত অভিব্যক্তি নীরোকে শৈশবকাল থেকে নিজ জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। তার শরীরে যৌবনের ছোঁয়া লাগা মাত্রই সে নিজেকে নিয়ে মেতে উঠে ভ্রষ্টাচারে! রক্ত সম্পর্কে তার দাদা এবং মায়ের বিয়ের কারনে হঠাৎ দাদা থেকে বাবা হয়ে যাওয়া সম্রাট ক্লডিয়াসও ছিলেন বিকৃত রুচির মানুষ। ফলে নীরোর পক্ষে কোন অপকর্ম করতে নীতি নৈতিকতার কোন বাধা ছিলোনা প্রাসাদের ভেতরে কিংবা বাইরে।

কিশোর নিরো সাঙ্গ পাঙ্গ সহ রোম নগরীতে ঘুরে বেড়াতো এবং ইচ্ছে মতো যার তার ঘরে ঢুকে পড়তো। পছন্দ মতো কোন মেয়ে পেলেতো কথাই নেই, নিজের ভ্রষ্টতার স্বাক্ষর রেখে আসতো সেই সব পরিবারের চাপা কান্নার উপযুক্ত জবাব হিসেবে। সারা রোমে তার বিরুদ্ধে ছিঃ ছিঃ রব উঠলো। তার মা এগ্রোপিনা ছেলের কুকর্ম কমানোর জন্য অল্প বয়সে তার বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হলো। তার কামনা বাসনা দিনকে দিন বাড়তে থাকলো। প্রথম স্ত্রী ক্লডিয়া অক্টাভিয়া ছিলেন সম্রাট ক্লডিয়াসের মেয়ে রীতিমতো রোমান রাজরক্তের ধারক। সম্পর্কে নীরোর সৎ বোন। কিন্তু দুশ্চরিত্র নীরো প্রথমে এক ক্রীতদাসীর প্রেমে পড়ে যার নাম ক্লডিয়া এসিটি। তারপর পপ্পিয়া সাবিনা নামের এক বিবাহিত মহিলার প্রেমে পড়েন এবং এক সময় তাকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে বিয়েও করেন। শুধু কি তাই- মেসালিনা ও স্পারস নামের অন্য দুই মহিলাকেও বিয়ে করেন। ফলে অতি অল্প বয়সেই তার বউয়ের সংখ্যা দাঁড়ালো চার এ। তবে অবাক করা বিষয় হলো তার চার নম্বর বউ- স্পারস কিন্তু মেয়ে ছিলো না। সে ছিলো অনিন্দ সুন্দর এক বালক ক্রীতদাস। ৬৭ খ্রীঃ সম্রাট নীরো তাকে বিয়ে করেন সমকামীতার জন্য।

৫৪ খ্রীষ্টাব্দে নিরো সুবিশাল রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট হন। আজকের দুনিয়ার বলতে গেলে সমগ্র ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং ভূ-মধ্য সাগরের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ নিয়ে তার সুবিশাল সাম্রাজ্য ছিলো- ধনে, জ্ঞানে এবং খ্যাতিতে দুনিয়ার শীর্ষস্থানে। এই রাজ্য পরিচালনার জন্য পাত্র মিত্র, উজির নাজির এবং সেনাপতি ছাড়াও ছিলো শক্তিশালী সিনেট বা সংসদ। নিরোর বয়স যদিও মাত্র ১৭ বছর ছিলো তথাপি তিনি ছিলেন অনেক দিক থেকেই দক্ষ এবং অতিমাত্রায় আত্ম মর্যাদাশীল। সিনেটের একজন প্রভাবশালী সদস্য ছাড়াও তার দুইজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা ছিলো লুসিয়াস এবং বুররাস নামে। অন্যদিকে তার মা এগ্রোপিনার প্রভাবতো ছিলোই।

সম্রাট নিরো কারো পরামর্শ বা কর্তৃত্ব মেনে নিতে নারাজ। বিশেষ করে তার মায়ের সঙ্গে সম্পর্কের চরম অবনতি হলো। তার মা যখন ছেলের দাম্পত্য জীবনে নাক গলাতে আরম্ভ করলেন তখনই পরিস্থিতি চলে গেলো আয়ত্বের বাইরে। নীরোর প্রথম স্ত্রী অক্টাভিয়া ছিলেন রাজক’মারী। ফলে তিনি নতুন সম্রাটের ভ্রষ্টতা মেনে নিতে পারেননি। সম্রাট তাকে রাজ্য থেকে বের করে একটি নির্জন দ্বীপে নির্বাসনে পাঠান। এনিয়ে রাজ পরিবার এবং অভিজাত মহলে দারুন প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সম্রাট কয়েকজন অভিজাত নাগরিককে হত্যা করেন এবং এক সময় নিজের মাকেও মেরে ফেলেন। ক্ষমতা লাভের পাঁচ বছরের মাথায় সম্রাট নিরো অনেকটা অর্ধ উম্মাদের মতো হয়ে যান। বিরোধী মতামত একদম সৈহ্য করতে পারতেন না। যাকে ইচ্ছা তাকে শাস্তি দিতেন- আবার যাকে ইচ্ছা তাকে মেরেও ফেলতেন। সাম্রাজ্যের অভিযাতবর্গকে রাতের আধারে ধরে এনে গুম করে ফেলতেন। হঠাৎ করেই তিনি আবিস্কার করলেন সিনেটে সম্ভবত তাকে নিয়ে চক্রান্ত হচ্ছে। তিনি বিরোধী দলীয় সিনেটরদেরকে ধরে আনলেন এবং নিজে দাড়িয়ে থেকে প্রায় একশ প্রভাবশালী, বয়োজেষ্ঠ এবং রোমান সাম্রাজ্যের কীর্তিমান রাজনীতিবীদদেরকে হত্যা করালেন। এরপর সাম্রাজ্য বিরোধীমুক্ত হয়েছে বলে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে লাগলেন।

৬০ সালের পর সম্রাটের বোধ হয় মস্তিস্ক বিকৃতি ঘটলো। তিনি রাত বিরেতে ঘর থেকে বের হন। প্রকাশ্য রাজপথে দাড়িয়ে দাড়িয়ে প্রশ্রাব করা, গান করা কিংবা চিৎকার করে ভিক্ষা করার মতো নিম্নমানের কাজকর্ম করতে থাকেন। এ সময় তিনি নিজেকে খোদা বলে দাবী করেন। শুধু তাই নয়- তিনি বলতে থাকেন- ”এই পৃথিবীতে খোদা বলে যদি কেউ থেকে থাকে তবে সেই খোদার দরকার আছে তার সাহায্য গ্রহনের; কিন্তু তার কোন দরকার নেই কোন খোদার সাহায্য।” তিনি রাস্তা ঘাটে চলতে ফিরতে গিয়ে হঠাৎ করে দাড়িয়ে যেতেন-তারপর কোন পথচারীকে ধরে বলতেন- এই তুমি গান করছো কেনো? আমাকে নিয়ে ব্যাঙ্গ করে গান গাওয়া হচ্ছে ? দাড়াও দেখাচ্ছি মজা! -একথা বলেই তিনি তার সঙ্গে থাকা প্রহরীদেরকে নির্দেশ দিতেন ঐ পথচারীর শিরচ্ছেদ করার জন্য। পথচারীর মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যখন রাজপথের ধুলায় লুটিয়ে পড়তো তখন সম্রাট নিরো অদ্ভূত এক পৈশাচিক অট্রহাসিতে ফেটে পড়তেন।

তিনি রাজ প্রাসাদে প্রায়ই শাহী ভোজে রোমের অভিজাত বর্গকে পিঠে পায়েস সহ নানা রকম রাজ ভোগ খাওয়ানোর জন্য দাওয়াত করতেন। লোকজন এলে তিনি নিজে গান গাইতেন এবং নাচতেন। রাজ্যের সম্মানীত বয়স্ক লোকদেরকেও গান গাইতে এবং নাচতে নির্দেশ দিতেন। তারা যখন সম্রাটের হুকুম পালন করতো তখন তিনি বুড়োদের বেসুরো গান এবং ধ্যাতাং ধ্যাতাং নাচ দেখে খিলখিলিয়ে এবং পিক পিকিয়ে হাসতেন। এর কয়দিন পর তিনি রাজ প্রাসাদ ত্যাগ করে টাইবার নদীর তীরবর্তী একটি রাজকীয় ফুলের বাগানে গিয়ে উঠলেন। সেখানে তাবু টানিয়ে তিনি প্রিয় স্ত্রী সাবিনাকে নিয়ে থাকতেন। সাবিনার প্রতি নির্দেশ ছিলো- সর্ম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে পালঙ্কের ওপর শুয়ে থাকা। সম্রাট উলঙ্গ স্ত্রীর শরীরের ওপর হালকা একটি চাদর দিয়ে আচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতেন। চাদরটি ছিলো অতিশয় পাতলা এবং মসৃন যার ফাঁক দিয়ে সম্রাজ্ঞীর শরীর দেখা যেতো। এরপর তিনি সেই তাবুর মধ্যে সাক্ষাৎ প্রার্থীদেরকে ডাকতেন। কেউ যদি ভুলক্রমে সম্রাজ্ঞীর উলঙ্গ শরীরের দিকে তাকাতো তাহলে আর রক্ষা ছিলোনা- নির্ঘাত মরতে হতো।

এভাবেই সম্রাট নিরোর পাগলামী চলছিলো। সম্রাটের পাগলামীর শিকার হয়ে পুরো রোমবাসী পাগল হবার উপক্রম হলো। তার ক্ষমতা লাভের দশ বছরের মাথায় তিনি ঘটিয়ে ফেললেন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দানবীয় ঘটনা। ৬৪ সালের ১৮ ই জুলাই তিনি রোম নগরীতে আগুন ধরিয়ে দিলেন। নগরীর সবচেয়ে বড় বিপনী বিতান সার্কাস মাক্সিমাসে আগুনের সূত্রপাত হলো। ১৯ জুলাই রাত পর্যন্ত মোট ৪৮ ঘন্টা ধরে রোম নগরী পুড়ে ছারখার হয়ে গেলো। কেউ বলে তিনি বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। আবার কেউ বলে ভায়োলিন।

রোম নগরীর সেই আগুন নিয়ে বহু কথা-বহু উপকথা প্রচলিত। কেউ বলেন- রোমের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে লোকজন যখন রোমিউলাসের নাম উচ্চারন করতো তখন সম্রাট নিরোর শরীরে হিংসের আগুন জ্বলে উঠতো। তিনি চাইতেন নতুন একটি শহর নির্মান করে ইতিহাসের মাইল ফলক হিসেবে চিহ্নিত হতে। আবার অন্যরা বলেন- রোম নগরীর পুরোনো বাড়ীঘর এবং অলিগলি তার একদম পছন্দ হতো না। তাইতো তিনি পুরানো নগরী জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়ে নতুন একটি শহর গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন নিজের নাম ও যশকে কৃতিময় করার জন্য।

আগুনে ভস্মীভূত হবার ২/১ মাসের মধ্যেই নীরো নতুন নগরী নির্মানের কাজে হাত দিলেন। প্রায় দশ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে তৈরী হতে থাকলো নতুন এবং আধুনিক শহর। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থান থেকে রাতারাতি সংগ্রহ করা হলো কোটি কোটি টন মার্বেল, গ্রানাইড সহ অন্যান্য মূল্যবান পাথর। জড়ো করা হলো লক্ষ লক্ষ ক্রীতদাসকে। চলতে থাকলো নতুন শহর নির্মাণের কাজ। দিন রাতের ২৪ ঘন্টা কাজ চলে- আর পাগলা সম্রাট একটি ঘোড়ায় চড়ে সেই দৃশ্য দেখেন এবং বায়োলিন বাজিয়ে গান করেন। এই কাজ করতে করতে তার রাজকোষের সকল অর্থ ভান্ডার শেষ হয়ে গেলো। সেনাবাহিনীর বেতন ভাতা আটকে পড়ার উপক্রম হলো। কিন্তু তখনো বাকী ছিলো সম্রাটের দৃষ্টিতে নতুন দুটি স্থাপনার নির্মাণ। একটি হলো তার নিজের জন্য বিলাস বহুল প্রাসাদ আর অন্যটি হলো ত্রিশ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট তার নিজের একটি ভাস্কর্য।

সম্রাটের অর্থমন্ত্রী অনেক বোঝালেন অর্থ সংকটের কথা। কিন্তু পাগলা সম্রাটের জিদ- না করতেই হবে - ৩০০ একর জায়গার ওপর ’ডোমাস আউরিয়া’ নামের প্রাসাদ এবং ৩০ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট ভাস্কর্য্য নির্মাণে ব্যয় ধরা হলো ৩০০ কোটি স্বর্নমূদ্রা। টাকা কোথায় ? পাগলা রাজা হুকুম দিলেন- ট্যাক্স বাড়াও এবং রাজ্যের ধনীদের ধন লুট করো। হুকুম তামিল হলো এবং একদিনের মধ্যে অর্থ সংগ্রহ হয়ে গেলো। কিন্তু রাজ্যে দেখা দিলো ভয়াবহ অরাজকতা এবং বিদ্রোহ। সম্রাট কঠোর হস্তে বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা করলেন। ফলে রোম বিদ্রোহ মুক্ত হলো বটে কিন্তু প্রদেশ গুলোতে অশান্তি ছড়িয়ে পড়লো। এইভাবে চললো ৬৮ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত। ইতিমধ্যে সম্রাটের শহর, প্রাসাদ এবং ভাস্কর্য নির্মানের কাজ শেষ হলো। সম্রাট ৬৮ সালের ফেব্র“য়ারী মাসে মহা ধুমধামে নতুন প্রাসাদে উঠলেন।

মার্চ মাসে গাল্লিয়া প্রদেশের গভর্নর গাইয়াস জুলিয়াস সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন অতিরিক্ত কর আরোপের অভিযোগ তুলে। সম্রাট স্বয়ং যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হলেন। পরিস্থিতি তার প্রতিকুলে চলে যাওয়ায় তিনি রোমে পালিয়ে এলেন। তিনি দুপুরের দিকে তার প্রাসাদে ফিরে ঘুমিয়ে পড়লেন। মাঝ রাতে জেগে দেখেন প্রাসাদের সব রক্ষীরা পালিয়ে চলে গেছে। এরপর তিনি প্রাসাদের বিভিন্ন কক্ষে অবস্থানরত তার বন্ধু বান্ধবদেরকে খোঁজ করলেন। দেখলেন- কেউ নেই- সবাই তাকে ছেড়ে পালিয়েছে। এরপর তিনি চিৎকার করে বললেন- কেউ কি আছো যে আমাকে তার তলোয়ার দিয়ে হত্যা করতে পারে। প্রাসাদ বেদীতে তার আর্ত চিৎকার প্রতিধ্বনিত হলো- কিন্তু কেউ আসলোনা।

সম্রাট পাগলের মতো প্রাসাদ থেকে দৌড়ে বের হয়ে এলেন গভীর রাতে। তারই প্রতিষ্ঠিত শহরের অলিতে গলিতে চিৎকার পাড়লেন। কেউ তার জন্য দরজা খুললো না। ইতোমধ্যে তার চারজন বিশ্বস্ত চাকর এবং বালক স্ত্রী স্পারোস এগিয়ে এলো। সম্রাট তাদেরকে কবর খোড়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। এমন সময় সম্রাটের নিকট খবর এলো- রোমান সিনেট তাকে গণশত্র“ আখ্যা দিয়ে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছে। এই খবর শুনে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলেন না। নিজের চাকু দিয়ে নিজের গলার রগ কেটে আত্মহত্যা করলেন। মৃত্যুর সময় উচ্চারন করলেন সেই বিখ্যাত বানী-”কুয়ালিস আর্টিফেক্স পিরিও”- ইংরেজীতে যার অর্থ দাড়ায় ”ডযধঃ ধহ ধৎঃরংঃ ফরবং রহ সব”- তারিখটি আবার স্মরন করিয়ে দিচ্ছি-৬৮ সালের ৯ই জুন- সময় ভোর রাত। স্থানঃ রাজপথ।

মন্তব্য করুন


 

Link copied