আর্কাইভ  শুক্রবার ● ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ● ৬ বৈশাখ ১৪৩১
আর্কাইভ   শুক্রবার ● ১৯ এপ্রিল ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: পলাশবাড়ীতে আসামির ছুরিকাঘাতে বাদীর মৃত্যু, গ্রেফতার ১       মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সন্তান-স্বজনের ভোটে না দাঁড়ানোর নির্দেশ       ভোজ্যতেলের দাম বাড়ল, খোলা তেলে সুখবর       বিএনপি নেতা সোহেলের নিঃশর্ত মুক্তি দাবিতে রংপুরে  মানববন্ধন ও সমাবেশ        খরার ঝুঁকিতে রংপুর অঞ্চল      

 width=
 

একটি পরশ পাথরের সান্নিধ্যে

সোমবার, ১৭ মার্চ ২০১৪, সকাল ০৮:৪৫

তোফায়েল আহম্মেদ

আজ শুভদিন! জাতির জনকের ৯৫-তম জন্মদিন। বঙ্গবন্ধু সমগ্র জীবনব্যাপী একটিই সাধনা করেছেন— বাংলা ও বাঙালির মুক্তির জন্য নিজের জীবন উত্সর্গ করা। তাঁর এই সাধনার শুরু ১৯৪৮ থেকে। '৪৭-এ দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই তিনি উপলব্ধি করেন এই রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে বাঙালিরা নির্যাতিত-নিষ্পেষিত হবে। তাই '৪৮-এর জানুয়ারির ৪ তারিখে গঠন করেছিলেন ছাত্রলীগ এবং '৪৯-এর জুনের ২৩ তারিখে আওয়ামী লীগ। সেই থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের প্রতিটি আন্দোলনকে সুপরিকল্পিতভাবে নেতৃত্ব প্রদান করে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। আমরা আজ বিস্মৃত হয়েছি ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্ব '৪৮-এর মার্চের ১১ তারিখটি। '৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পূর্বে '৪৮-এর মার্চ মাসের ১১ তারিখটি 'ভাষা দিবস' হিসেবে পালিত হতো। এই পর্বের ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাল্যকাল ও কৈশোর জীবন থেকেই যে সংগ্রামের শুরু তা থেমে থাকেনি বরং কালক্রমে তা বিস্তৃত ও প্রসারিত হয়ে সমগ্র বাঙালির মুক্তি-সংগ্রামের এক মহত্ প্রচ্ছদপট্ এঁকে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন ইতিহাসের মহামানব। মনে পড়ে ১৯৭৩-এর ১৭ মার্চের কথা। সেদিন আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর ৫৪-তম জন্মদিবসে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জনাব জিল্লুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রবীণ নেতা মনি সিংহ তাঁর স্মৃতিচারণে বলেছিলেন, "বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫১ সালে কারাগারে থাকাকালেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরিকল্পনা করেছিলেন।" চিঠিপত্র আদান-প্রদানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর এই পরিকল্পনার কথা অবহিত হয়েছিলেন জানিয়ে তিনি আরো বলেছিলেন, "যদিও আমাদের মতপার্থক্য ছিল তথাপি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের কাছে এটা জানতে চেয়ে প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন যে, স্বাধীনতা সংগ্রামকে আমরা সমর্থন করবো কি-না।" এবং সেই সভায় তিনি অকপটে স্বীকার করেছিলেন যে, তিনি তখন ধারণাটির বিরোধিতা করেছিলেন এবং ভেবেছিলেন যে, স্বাধীনতার জন্য সমগ্র জনগণ মানসিকভাবে প্রস্তুত নয় এবং এ ধরনের উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত সফল হবে না। সেদিন মহান মুক্তি-সংগ্রামের অন্যতম নেতা মনি সিংহ আরো বলেছিলেন, "আমি বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘজীবন কামনা করি। কোন জনতা তাদের নেতা নির্বাচনে ভুল করে না। বাংলাদেশের জনগণও তাঁর পশ্চাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এবং তাঁকে মুক্তিদাতা হিসেবে গ্রহণ করেছে।" প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত সকলেই একবাক্যে একথার সাথে একমত পোষণ করবেন। কেননা বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের প্রতিটি ধাপেই বাঙালির সার্বিক মুক্তির জয়গান গেয়েছেন। তিনি তো সব সময় বলতেন, এমনকি দু'দুবার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তিনি বলেছেন, "ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলবো, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।" যে বাংলার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, যে বাংলার জন্য তিনি যৌবনের অধিকাংশ সময় কারাগারে কাটিয়েছেন, ফাঁসির মঞ্চে গেয়েছেন বাঙালির জয়গান, সেই বাংলা ও বাঙালির জন্য তাঁর ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। সমুদ্র বা মহাসমুদ্রের গভীরতা পরিমাপ করা সম্ভব; কিন্তু বাংলা ও বাঙালির জন্য বঙ্গবন্ধুর হূদয়ের যে দরদ যে ভালোবাসা তার গভীরতা অপরিমেয়। বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে কত কথা কত স্মৃতি আজ মনের চারপাশে ভীড় করে আসে। এমন মহামানবের সান্নিধ্য কেঁদেও আর পাবো না কোনদিন এমনটা ভাবলেই চোখ ভিজে যায়। মনে পড়ে '৭১-এর রক্তঝরা ১৭ মার্চের কথা। সেদিন ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫২-তম জন্মদিন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা শেষে দুপুরে ধানমণ্ডির বাসভবনে বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনাকালে একজন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, "আপনার ৫২-তম জন্মদিনে আপনার সবচাইতে বড় ও পবিত্র কামনা কী? উত্তরে বঞ্চিত বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা স্বভাবসিদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, "জনগণের সার্বিক মুক্তি।" এরপর সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জ্ঞাপনকালে তিনি ব্যথাভারাতুর কণ্ঠে বেদনার্ত স্বরে বলেছিলেন, "আমি জন্মদিন পালন করি না-আমার জন্মদিনে মোমের বাতি জ্বালি না, কেকও কাটি না। এদেশে মানুষের নিরাপত্তা নাই। আপনারা আমাদের জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যেকোন মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে। আমি জনগণেরই একজন, আমার জন্মদিনই কি, আর মৃত্যুদিনই কি? আমার জনগণের জন্য আমার জীবন ও মৃত্যু।" বিশাল হূদয়ের মহত্ মনের মানুষ ছিলেন তিনি। নিজের সবকিছুই জনগণের জন্য উত্সর্গ করেছিলেন। অতি সাধারণ জীবন ছিল তাঁর। রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়েও সরকারি বাসভবনে থাকতেন না। নিরাভরণ, ছিমছাম আর আটপৌরে ৩২ নম্বরের বাড়িটিতেই আমৃত্যু থেকেছেন। ধানমণ্ডিতে যখন প্লট বরাদ্দ দেয়া হয় তখন ভালো একটি প্লট নেয়ার জন্য সবার শত অনুরোধ সত্ত্বেও বলেছিলেন, "আগে সবাইকে দাও, তারপর যদি থাকে তখন দেখা যাবে।" নিজের জন্য কিছুই চাইতেন না। অপরের দুঃখ-কষ্টের প্রতি অপরিসীম দরদ তাঁকে সর্বদাই আবেগাপ্লুত করতো। একবার এক জনসভায় তিনি বলেছিলেন, "একজন মানুষ আর কী চাইতে পারে- আমি যখন ভাবি দূরে এক জনশূন্য পথের ধারে আধো আলো-ছায়ায় এক লোক লণ্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে আছে শুধু আমাকে একনজর দেখবে বলে, তখন মনে হয়, একজন মানুষের পক্ষে আর কী চাওয়া-পাওয়ার থাকতে পারে।" নিরন্ন-হতদরিদ্র-মেহনতী মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল প্রগাঢ় ভালোবাসা। তা প্রতিফলিত হয়েছে, তাঁর প্রতিটি কর্মে এবং চিন্তায়। '৭৩-এর ৯ সেপ্টেম্বর, আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, "বিশ্ব আজ দু'ভাগে বিভক্ত শোষক আর শোষিত; আমি শোষিতের পক্ষে।" মনে পড়ে '৭০-এ বরিশাল-পটুয়াখালী-ভোলা অঞ্চলে নির্বাচনী সফরের কথা। ২৪ ফেব্রুয়ারি ছিল ভোলায় নির্বাচনী জনসভা। এদিন ভোলার ইতিহাসে সর্ববৃহত্ গণসমাবেশে বঙ্গবন্ধু আমি যা তার চেয়ে অনেক বড় করে তুলে ধরে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু নেতা-কর্মীদের এভাবেই সম্বোধন করতেন। যখন যে এলাকায় যেতেন তখন সে এলাকার সংগঠক বা নেতাকর্মীকে মহিমান্বিত করে বক্তব্য রাখতেন। নিজে কর্মী থেকে সংগঠক, সংগঠক থেকে নেতা, নেতা থেকে জাতীয় নেতা এবং পরিশেষে জাতীয় নেতা থেকে জাতির জনক হয়েছেন। আর এটি সম্ভবপর হয়েছে অসংখ্য কর্মীকে তিনি নেতা বানিয়েছেন; অসংখ্য নেতাকে স্থানীয় পর্যায় থেকে টেনে তুলে উন্নীত করেছেন জাতীয় নেতায়। ফলে সারা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে আজো বঙ্গবন্ধুর চেতনা ধারণ করেই টিকে আছে। '৭১-এর ৩ জানুয়ারির কথা। ঐতিহাসিক রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে ৭০-এর নির্বাচনে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। শপথ বাক্য পাঠ করাবেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। সেদিন তিনি বক্তৃতায় বলেছিলেন, "৬ দফা ও ১১ দফা আজ আমার নয়, আমার দলেরও নয়। এ-আজ বাংলার জনগণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। কেউ যদি এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে বাংলার মানুষ তাকে জ্যান্ত সমাধিস্থ করবে। এমনকি আমি যদি করি আমাকেও।" জনগণের জন্যই ছিল তাঁর রাজনীতি ও কর্মসূচি। তিনি তাঁর বক্তৃতায় সেদিন আরো বলেছিলেন, "আমাকে মোনেম খান কাবু করতে পারেনি, এমনকি আইয়ুব খানও পারেনি-কিন্তু আমাকে দুর্বল করে দিয়েছে আপনাদের এই অকুণ্ঠ ভালোবাসা। আপনারা দোয়া করবেন যেন আপনাদের এই ভালোবাসার মর্যাদা দিতে পারি।" বাংলার মানুষের প্রতি ভালোবাসার মর্যাদা তিনি রক্ত দিয়ে পরিশোধ করে গেছেন। কবিগুরুর ভাষায়, "আমৃত্যু দুঃখের তপস্যা এ জীবন, সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে, মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে।" বঙ্গবন্ধুর কথা এবং বক্তৃতায় প্রায় সময়ই উদ্ধৃত হতো রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত-জীবনানন্দের কবিতার চরণ। এতো সাবলীল আর প্রাসঙ্গিকতায় তিনি কবিতা আবৃত্তি করতেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে হতো। মনে পড়ে '৭১-এর রক্তঝরা মধ্য মার্চের কথা। যখন ইয়াহিয়ার সাথে আলোচনা চলছে তখন বিদেশি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে নজরুলের কবিতার ইংরেজি তরজমা করে বলতেন, "আই ক্যান স্মাইল ইভেন ইন হেল।" কবিগুরুর কবিতা থেকে বলতেন, "চারিদিকে নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস, শান্তির ললিত বাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।" সেসময় অগ্নিঝরা মার্চে একদিকে চলছে আলোচনার নামে ইয়াহিয়ার প্রহসন, অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির যুদ্ধ প্রস্তুতি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমরা প্রতিদিন ঐক্যবদ্ধ হচ্ছি। সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার কাজ পূর্ণোদ্যমে এগিয়ে চলেছে। এমতাবস্থায়, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ছিল নেতার অভয় মন্ত্র। এই মার্চেই টঙ্গীতে পাক-সেনাবাহিনীর গুলিতে বহু শ্রমিক হতাহত হয়। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের এক বিশাল মিছিল ভয়াল গর্জনে সমবেত হয় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে। উত্তেজিত শ্রমিক শ্রেণীর উদ্দেশ্যে বক্তৃতাদান শেষে বিদ্রোহী কবিকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, "বিদ্রোহী রণক্লান্ত, আমি সেইদিন হবো শান্ত, যবে উত্পীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না...।" প্রবল আবেগে অনন্য সাধারণ গভীর দেশপ্রেম থেকে আশ্চর্য রকম অবলীলায় এইসব কাব্যাংশ পরিস্থিতি-পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত করে মৃত্যুঞ্জয়ী শক্তি নিয়ে তিনি উচ্চারণ করে যেতেন। '৭৫-এর ১১ জানুয়ারির কথা আমার স্মৃতির মণিকোঠায় এখনো জ্বলজ্বল করে। হূদয়ের গভীর থেকে উঠে আসে দীর্ঘশ্বাস। এদিন বাংলাদেশ সামরিক একাডেমীতে প্রথম শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠানে বিদায়ী ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে এক মর্মস্পর্শী বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, "...আমি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে একথা বলছি না, তোমাদের জাতির পিতা হিসাবে আদেশ দিচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী অনেক হবেন, অনেক আসবেন। প্রেসিডেন্টও অনেক হবেন, অনেক আসবেন। কিন্তু জাতির পিতা একবারই হন, দু'বার হন না। জাতির পিতা হিসাবেই যে আমি তোমাদের ভালোবাসি, তা তোমরা জানো। আমি তোমাদের আবার বলছি, তোমরা সত্ পথে থাকবে, মাতৃভূমিকে ভালোবাসবে। মনে রেখো তোমাদের মধ্যে যেন পাকিস্তানী মনোভাব না আসে। তোমরা পাকিস্তানের সৈনিক নও, বাংলাদেশের সৈনিক। তোমরা হবে আমাদের জনগণের বাহিনী।" দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্বৈরতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে জাতির জনক যে শিক্ষা অর্জন করেছিলেন সেই চেতনায় স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে তিনি "জনগণের বাহিনী" বলে উল্লেখ করেছিলেন। বক্তৃতায় তিনি বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর অভিপ্রায় ব্যক্ত করে, সেনা সদস্যদের আদর্শবান হওয়ার, সত্ পথে থাকার অঙ্গীকার করে দৃঢ়তার সঙ্গে স্নেহার্দ্র কণ্ঠে কবি জীবনানন্দ দাশের জননী কবি কুসুমকুমারী দাশের কবিতা থেকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, "মুখে হাসি বুকে বল তেজে ভরা মন, মানুষ হইতে হবে মানুষ যখন।" অতুলনীয় সংগঠক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রত্যেককে দেখতেন নিজ পরিবারের সদস্যের মতো। প্রতিটি নেতা-কর্মীর বিপদ-আপদে তিনি তাদের পাশে দাঁড়াতেন পরম হিতৈষীর মতো। মমতা মাখানো সাংগঠনিক প্রয়াস নিয়ে কর্মীদের হূদয় জয় করে নেয়ার ব্যতিক্রমী এক ক্ষমতা ছিল তাঁর। ১৯৭২-এর ১৪ এপ্রিল, আমি তখন গ্যাস্ট্রিক-আলসারে আক্রান্ত হয়ে হলিফ্যামিলিতে চিকিত্সাধীন। আমার পাকস্থলীতে নালী-ঘায়ের অপারেশন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু আমাকে দেখতে এসেছেন। সস্নেহে আমার হাত ধরে, পরম মমতায় কপালে হাত বুলিয়ে আদর করে আমার খোঁজ-খবর নিয়েছিলেন। আমার একমাত্র কন্যা মুন্নী যখন ২য় শ্রেণীতে পড়ে তখন টিভিতে ওর অনুষ্ঠান দেখে ওকে স্নেহাশীষ জানিয়েছিলেন। অপরিসীম ভালেবাসা ছিল শিশুদের প্রতি। ছবি তুলতে ভালোবাসতেন। ফটোগ্রাফার অনেকেই প্রশ্ন করতেন, "লীডার আপনি এতো ছবি তোলেন কেন?" বলতেন, "ভবিষ্যতের মানুষ যারা, ওরা বড় হয়ে দেখবে কেমন ছিল ওদের নেতা।" বঙ্গবন্ধু যখন গণভবনে যেতেন, সামনে পেছনে দু'টি গাড়ি থাকতো। রাস্তায় ট্রাফিক সিগন্যাল পড়লে আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়তো। তখন এরকম স্বয়ংক্রিয় সিগনাল বাতি ছিল না। একদিনের কথা খুব মনে পড়ে। একবার আমাদের গাড়ি সিগনালে দাঁড়ানো। হঠাত্ একটি শিশু কত বয়স হবে সাত কি আট, গাড়ির কাছে এসে বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বলছে, "স্লামুআলাইকুম, মুজিব সাহেব!" তত্ক্ষণাত্ বঙ্গবন্ধু শিশুটির হাত ধরে আদর করলেন, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আমি পাশে বসে দেখছি একজন রাষ্ট্রনায়কের, জাতির জনকের শিশুদের প্রতি কী অপার ভালোবাসা, কী অপূর্ব মমত্ববোধ। আজ মনে হয়, "এখন সেসব স্বপ্নকথা দূরের শোনা গল্প; তখন সত্যি মানুষ ছিলাম, এখন আছি অল্প।" বঙ্গবন্ধু ছিলেন পরশ পাথরের মতো। তাঁর পুণ্য হস্তের ছোঁয়ায় আমরা সকলেই— গোটা বাঙালি জাতি নিরস্ত্র থেকে সশস্ত্র হয়েছিলাম; অচেতন থেকে সচেতনতার এমন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলাম যে আমরা স্বপ্ন দেখতাম শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের। দীর্ঘ ৯ মাস ১৪ দিন কারাবাসের পর পাকিস্তানের জিন্দানখানা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে '৭২-এর ১০ জানুয়ারি রেসকোর্সে সর্বকালের সর্ববৃহত্ ঐতিহাসিক গণমহাসমুদ্রে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, "সাত কোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি।" অশ্রুসিক্ত নয়নে উচ্চকিত হয়েছিলেন এই বলে যে, "কবিগুরু, তুমি এসে দেখে যাও, তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে, তুমি ভুল প্রমাণিত হয়েছো। তোমার কথা আজ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে...।" বঙ্গবন্ধুর একান্ত সান্নিধ্যে থেকে দেখেছি তাঁর কৃতজ্ঞতাবোধ, বিনয়, মানুষের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা। আকাশের মতো উদার ছিল তাঁর হূদয়। জ্যোতির্ময় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। স্বদেশে কিংবা বিদেশে সমসাময়িক নেতা বা রাষ্ট্রনায়কদের তাঁর তেজোময় ব্যক্তিত্বের ছটায় সম্মোহিত করার, উদ্দীপ্ত করার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল বঙ্গবন্ধুর। বীরত্ব, সাহস ও তেজস্বতার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে তিনি ছিলেন ভাস্বর। তাঁর কাছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছিল ন্যায়সঙ্গত। বজ্রকণ্ঠের অধিকারী অতুলনীয় বাগ্মী বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য ছিল মার্জিত— কখনোই রাজনৈতিক বক্তব্যে ব্যক্তিগত বিষয়কে প্রাধান্য দিতেন না। বঙ্গবন্ধুর সময়ানুবর্তিতা, নিয়মানুবর্তিতা ছিল অসাধারণ। সময়ের এক চুল হেরফের হতো না, ঘড়ি ধরে অনুষ্ঠানাদিতে যেতেন। দলের নেতা-কর্মী সকলের প্রতি ছিল গভীর মমত্ববোধ। তাদের কাজের মর্যাদা দিতেন, ভালোবেসে বুকে টেনে নিতেন। প্রচণ্ড রেগে গেলেও পরমুহূর্তেই শান্ত হয়ে যেতেন। অফুরন্ত প্রাণশক্তির অধিকারী বঙ্গবন্ধুর সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল অপরিসীম। এক মুহূর্তে মানুষকে আপন করে নেয়ার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা ছিল তাঁর। নীতির প্রশ্নে ছিলেন অটল। মনে পড়ে '৭৪-এ দলের কাউন্সিলে দলীয় পদ ত্যাগ করে সভাপতির পদটি ছেড়ে দিয়েছিলেন। তদস্থলে আসীন হয়েছিলেন শ্রদ্ধাভাজন জননেতা শহীদ কামারুজ্জামান সাহেব। ঠিক '৫৭তে করেছিলেন বিপরীত কাজটি, অর্থাত্ মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দলীয় পদে বহাল করেছিলেন নিজেকে। সময়ের চাহিদা অনুযায়ী নিজস্ব অবস্থান কোথায় হওয়া উচিত সেটি যেমন বুঝতেন, তেমনিভাবে কে কোথায় যোগ্যতর আসনে অধিষ্ঠিত হবেন তাঁকে সে জায়গাটিতে বসিয়ে দিতে ভুল করতেন না মোটেই। রাজনৈতিক সচিব হিসেবে বঙ্গবন্ধুর একটি তহবিল থাকতো আমার কাছে। এই তহবিল থেকে তিনি বিভিন্ন জনকে সাহায্য-সহায়তা করতেন। এর মধ্যে দলীয় নেতা-কর্মী ছাড়াও বিরোধী দলের প্রতিপক্ষীয় লোকজনও ছিলেন। কিন্তু শর্ত ছিল যাদেরকে অর্থ সাহায্য দেয়া হচ্ছে তাঁদের নাম-ঠিকানা গোপন রাখতে হবে— প্রকাশ করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু কখনোই মানুষের মনে আঘাত দিয়ে কথা বলতেন না। যারা ভিন্ন মতাবলম্বী রাজনীতি করতেন বয়ঃক্রম অনুসারে তাদের যথাযোগ্য মর্যাদা-শ্রদ্ধা ও স্নেহ-ভালোবাসা এবং পরম মমতায় সম্বোধন করতেন। রাজনীতির এসব মহত্তর মূল্যবোধ কালক্রমে জাতীয় জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। জাতীয় রাজনীতিতে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে বঙ্গবন্ধুর চেতনার নিরন্তর অনুশীলনের কোন বিকল্প নেই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গুণবাচক বৈশিষ্ট্যের কথা বলে শেষ করা যাবে না। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা তাঁকে বাঁচাতে পারিনি। ষড়যন্ত্রকারী ঘাতকের দল এই মহান নেতাকে সপরিবারে হত্যা করেছে। আমরা হারিয়েছি সর্বস্ব। আজ তিনি বেঁচে থাকলে ৯৫ বছরে পদার্পণ করতেন। তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপদান করতেন। আমার পরম সৌভাগ্য হয়েছিল ইতিহাসের এই মহামানবের একান্ত সান্নিধ্যে আসার। আমার জীবন ধন্য। [লেখক: আওয়ামী লীগ নেতা, বাণিজ্যমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার tofailahmed69@gmail.com]

মন্তব্য করুন


 

Link copied