আর্কাইভ  শুক্রবার ● ২৯ মার্চ ২০২৪ ● ১৫ চৈত্র ১৪৩০
আর্কাইভ   শুক্রবার ● ২৯ মার্চ ২০২৪
 width=
 

 

কুড়িগ্রামের খাবারে বেজায় খুশি ভুটানের রাজা

কুড়িগ্রামের খাবারে বেজায় খুশি ভুটানের রাজা

কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করলেন ভুটানের রাজা

কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করলেন ভুটানের রাজা

রানিকে নিয়ে কুড়িগ্রামে পৌঁছেছেন ভুটানের রাজা

রানিকে নিয়ে কুড়িগ্রামে পৌঁছেছেন ভুটানের রাজা

কুড়িগ্রামে সমৃদ্ধির হাতছানি

কুড়িগ্রামে সমৃদ্ধির হাতছানি

 width=
 
শিরোনাম: স্বাস্থ্যের রংপুর বিভাগীয় পরিচালক ফজলুল হক কারাগারে       কুড়িগ্রামের খাবারে বেজায় খুশি ভুটানের রাজা       লালমনিরহাটে পুকুরে জাল ফেলতেই জালে উঠে এলো যুবকের মরদেহ       কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করলেন ভুটানের রাজা       রানিকে নিয়ে কুড়িগ্রামে পৌঁছেছেন ভুটানের রাজা      

 width=
 

গুমের রাজনীতি, গুম নিয়ে রাজনীতি

বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০১৪, দুপুর ০২:৫৮

মাসুদ কামাল

দুদিন আগে এই ছেলেটিই ফোন করেছিল দেশে অবস্থানরত তার বোনকে। কুশল বিনিময় আর নানা কথাবার্তা শেষে হঠাৎ করেই জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা দেশে নাকি কোনো এক স্ত্রীর স্বামীকে অপহরণ করা হয়েছে? আর এ নিয়ে অনেক হইচই হচ্ছে?’

‘স্ত্রীর স্বামী’ কথাটা শুনতে যেমনই লাগুক না কেন, জনাব আবু বকর সিদ্দিকের জন্য এই বিশেষণটা কাজ করেছে ধন্বন্তরি হিসেবে। আবু বকর সিদ্দিক কে, কি করেন তিনি এসব তথ্য দুদিন আগেও দেশের মানুষ জানত না। এই না জানা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথাও ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করেই অপহৃত হওয়ার মাধ্যমে বিখ্যাত হয়ে গেছেন তিনি দেশজুড়ে। তবে এই পরিচিতিটাও কিন্তু অপহরণ হওয়ার কারণে নয়, অপহৃত ব্যক্তিটি একজন বিখ্যাত নারীর স্বামী হওয়ার কারণে।

প্রশ্নটা আমি অনেকের মুখেই শুনেছি। জানতে চেয়েছেন তারা, আচ্ছা, আবু বকর সিদ্দিক যদি পরিবেশ আইনজীবী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী না হতেন, এত তাড়াতাড়ি কি মুক্তি পেতেন? গুম বলুন আর অপহরণ বলুন, এর একটা সংস্কৃতি এরই মধ্যে তৈরি হয়ে গেছে এই দেশে। কাউকে ধরে বা উঠিয়ে নিয়ে গেলে তার ফেরৎ আসার হার খুবই কম। আর যদি অপহৃত লোকটি মোটামুটি পরিচিত হন, তাহলে ফিরে আসার সম্ভাবনা নেমে যায় শূন্যের কাছাকাছি। যেমনটি হয়েছে বিএনপি নেতা সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলীর ক্ষেত্রে।

একটা পরিসংখ্যান দেখা যেতে পারে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, গত তিন মাসে দেশে ৩৯ জন গুম হয়ে গেছে। গত চার বছরে এরকম অপহৃত হয়েছে ২৬৮ জন। এদের মধ্যে থেকে পরবর্তীকালে ৪৩ জনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। মৃতদেহগুলোর বেশির ভাগই ভেসে উঠেছিল নদীতে পুকুরে বা ডোবায়। ১৮৭ জন এখনও পর্যন্ত গুম অবস্থায়ই আছে। তারা কোথায় কীভাবে আছে, অথবা আদৌ বেঁচেই আছে কিনা কেউ বলতে পারে না। ২৬৮-এর বাকি যারা থাকল তাদেরকে অপহৃত হওয়ার বেশ কিছুদিন পর পাওয়া গেছে পুলিশি হেফাজতে, দেখানো হয়েছে গ্রেফতার হিসেবে।

আর একটা হিসাব দিলেন আমার এক সাংবাদিক সহকর্মী। তিনি জানালেন, গত কয়েক মাস ধরে রাজধানী ঢাকা থেকেই কমপক্ষে ২২ জন রাজনৈতিক নেতাকর্মী গুম হয়ে গেছেন। এরা উধাও হয়ে গেছেন প্রধানত ২০১৩ সালের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু করে ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে। সহকর্মী বললেন, এদের প্রায় সকলকেই আমরা মাঠ পর্যায়ের সাংবাদিকরা ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম। রাজপথে বিরোধীদলের আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন এরা। এদের অধিকাংশকেই পুলিশ বা র‌্যাবের পরিচয় দিয়ে বাসা থেকে বা বাইরে থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। পুলিশ বা র‌্যাবও এদের ধরে নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেনি। রাতারাতি উধাও হয়ে গেছেন এরা।

এই দুটি পরিসংখ্যানের আলোকে ভাবলে এই দেশে গুম হওয়াটা এখন আর কোনো তোলপাড় করার বিষয় নয়। এটা আকসারই হচ্ছে। যার যাচ্ছে, সে বুঝছে। পুরো একটা পরিবারে নেমে আসছে নিকষ কালো অন্ধকার। দুঃখ বেদনা হতাশা ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে ক্ষোভ আর ক্রোধে। এখান থেকে যে প্রতিহিংসার জন্ম হবে না, ক্ষমতার পালাবদলের পর যে সেই প্রতিহিংসা আরও বিপুল গুম খুনের জন্ম দেবে না, কেউই বলতে পারে না। কিন্তু সেসব তো ভবিষ্যতের কথা।

তবে গুম হয়ে যাওয়া নিয়ে বর্তমানের এই যে গা-সওয়া প্রতিক্রিয়া, সেই গড্ডলিকা প্রবাহে আবু বকর সিদ্দিকের বিষয়টা যেন ব্যতিক্রম কিছু। অপহরণ হওয়া মাত্র যে হইচই শুরু হলো, এমনটা দেখেছিলাম এর আগে কেবলমাত্র ইলিয়াস আলীর ক্ষেত্রেই। ইলিয়াস আলীকে কিন্তু ফিরে পাওয়া যায়নি। তাই সিদ্দিকের বেলায় শুরুতে হইচইয়ের মাত্রা দেখে আশাবাদী না হয়ে একটু ভয়ই পেয়েছিলাম। এর ৩৫ ঘন্টা পর যখন তিনি মুক্ত হয়ে ফিরে এলেন, খুশি হয়েছেন যত মানুষ, বিস্মিতের সংখ্যাও তার চেয়ে খুব একটা কম নয়।

আসলে এই বিস্ময়টা নিয়েই প্রশ্ন। একজন মানুষকে প্রকাশ্য দিবালোকে অপহরণ করা হয়েছে। বিস্ময় তো থাকার কথা ছিল এখানে। কিন্তু তা না হয়ে তার ফিরে আসা দেখে মানুষ কেন বিস্মিত হচ্ছে? অবাক কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে, কীভাবে তিনি ফিরে এলেন? কেন তাকে অপহরণকারীরা কিছু বলল না, কেন তাকে শারীরিকভাবে প্রহার করল না, অথবা কেন তাকে একেবারে মেরেই ফেলল না? সুস্থভাবে ফিরে আসতে পারাটাই যেন ভদ্রলোকের জন্য অপরাধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর যেহেতু তিনি একজন বিখ্যাত নারীর স্বামী, তাই যথারীতি সেই বিস্ময়ের ধাক্কা গিয়ে আঘাত করল স্বামীর স্ত্রীকেও। অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হলো তাকেও। এমনও বলা হলো, তাহলে কি কারও সঙ্গে আপস করেই রিজওয়ানা হাসান তার স্বামীকে ফিরিয়ে আনলেন? কি অবিশ্বাস্য নির্মম সন্দেহ!

উদ্ধারের পর স্বামী-স্ত্রী মিলে সংবাদ সম্মেলন করলেন। স্বামীকে অক্ষতভাবে ফিরে পাওয়ায় সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ নিয়েও প্রশ্ন। রিজওয়ানা হাসান কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ, জাতীয় পার্টি নেতা এরশাদ, সাংবাদিক সমাজ এবং দেশের জনগণের প্রতি। এনিয়ে নানাজন নানা কথা বললেন। এইসব রাজনৈতিক নেতার কাছে কৃতজ্ঞতা কেন? এরা কি তার স্বামীকে মুক্ত করেছেন? অথবা প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকার কারণেই কি মুক্ত হয়েছেন জনাব সিদ্দিক? কি ভূমিকা ছিল ওনার? প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনেই অপহরণকারীরা সিদ্দিক সাহেবকে ছেড়ে দিলেন? তাহলে ইলিয়াস আলীর অপহরণকারীরা কেন শুনলেন না প্রধানমন্ত্রীর কথা? ওই অপহরণকারীরা কি প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও ক্ষমতাবান ছিলেন? একজন আবার বললেন, কৃতজ্ঞতা তো আসলে প্রকাশ করা উচিত ছিল অপহরণকারীদের নেতার কাছে। কারণ, ওই নেতাই তাকে নিজ ইচ্ছাতে ছেড়ে দিয়েছে। কেবল ছেড়েই দেয়নি, ঠিক মতো বাসায় ফিরতে রাহা খরচও দিয়েছে।

তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি ঠিক বুঝতে পারিনি, কৃতজ্ঞতার তালিকায় এরশাদ-রওশন দম্পতির নাম দেখে। অপহরণ-পরবর্তী ৩৫ ঘন্টায় বৃদ্ধ এই দম্পতির কোথাও কোনো বিবৃতি বা কর্মকা- চোখে পড়েছে বলে তো মনে পড়ে না। আর রওশন এরশাদ সরকারি অনুদানে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী হয়েছেন বটে, তবে জাতি তার অমৃতবচন থেকে একেবারেই বঞ্চিত। এ ধরনের ‘মূক ও বধির’ নেত্রী আবার কোথায় কি বললেন আবু বকর সিদ্দিকের মুক্তির জন্য? তাহলে কি ওনারা নেপথ্যে থেকে কোন ভূমিকা রেখেছেন?

সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ভূমিকা অবশ্য দৃশ্যমান ছিল। তিনি এবং তার অনুগত নেতারা এই অপহরণের জন্য সরকারকে সরাসরি দায়ী করলেন। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তো বলেই বসলেন, রিজওয়ানার স্বামীকে যারা অপহরণ করেছিল তারাই ইলিয়াস আলীকে গুম করেছে। কেউ কেউ তো আবার এমনও বললেন, এই অপহরণ ঘটনার মধ্যে দিয়ে সরকার পতনের আন্দোলনের সূচনা হবে। এই হুংকারের পর ২৪ ঘন্টা না পেরুতেই সিদ্দিক সাহেব ফিরে আসাতে মনে হলো বিএনপি নেতারা বড়ই বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন। সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করতে একটা যুৎসই ইস্যু এভাবে হাতছাড়া হয়ে গেলে মন খারাপ হতেই পারে। নেত্রী খালেদা জিয়া অবশ্য বললেন, অপহৃত আবু বকর সিদ্দিককে ছেড়ে না দেওয়া হলে এখান থেকেই সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হতো, কেউ সেই আন্দোলন ঠেকাতে পারত না।

সত্যি কথা বলতে কি, এই দলটির জন্য ইদানীং কিছুটা মায়াই হয়। ৫ জানুয়ারির মতো একটা অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরও এই দলটি কার্যকর আন্দোলনের কোনো ইস্যুই খুঁজে পাচ্ছে না। আবু বকর সিদ্দিকের মতো লোকের অপহরণ নিয়ে ‘সরকার পতন’-এর আন্দোলনের কথা ভাবতে হচ্ছে।

রাজনীতির জন্য যে গুম খুন অথবা গুম নিয়ে যে রাজনীতি, এটা যেন আমাদের এই দেশে এখন এক রকম নিয়তিতে পরিণত হয়ে গেছে। masud-kamalরাজনীতির অঙ্গন ছাড়িয়ে এর নেতিবাচক প্রভাব এখন দেখা যাচ্ছে সাধারণ মানুষের মধ্যেও। পত্রপত্রিকায় দেখা যাচ্ছে, আবু বকর সিদ্দিকের উদ্ধারের ঘটনার সঙ্গে তার স্ত্রী সৈয়দা রিজওয়ানা সিদ্দিকের পিতৃপরিচয় নিয়ে টানাটানি করতে। তার পিতা কত বড় একজন রাজাকার ছিলেন, সেই আলোচনাই যেন এখন জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে!
কি অদ্ভুত মানসিকতা আমাদের!

লেখক: সিনিয়র নিউজ এডিটর, বাংলা ভিশন টেলিভিশন

msdkml@journalist.com

মন্তব্য করুন


 

Link copied