আর্কাইভ  শুক্রবার ● ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ● ৬ বৈশাখ ১৪৩১
আর্কাইভ   শুক্রবার ● ১৯ এপ্রিল ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: পলাশবাড়ীতে আসামির ছুরিকাঘাতে বাদীর মৃত্যু, গ্রেফতার ১       মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সন্তান-স্বজনের ভোটে না দাঁড়ানোর নির্দেশ       ভোজ্যতেলের দাম বাড়ল, খোলা তেলে সুখবর       বিএনপি নেতা সোহেলের নিঃশর্ত মুক্তি দাবিতে রংপুরে  মানববন্ধন ও সমাবেশ        খরার ঝুঁকিতে রংপুর অঞ্চল      

 width=
 

তিস্তা বাঁধ-বাংলাদেশের মরন ফাঁদ এবং ইমাম বুখারী প্রসঙ্গ

মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০১৪, দুপুর ১১:৪১

গোলাম মওলা রনি

[caption id="attachment_17656" align="alignleft" width="300"] লেখক: সাবেক সাংসদ[/caption]

সত্যি বলতে কি বিষয়টি সম্পর্কে আগে আমার তেমন জানা ছিলোনা। কিন্তু জানার পর থেকে খুবই খারাপ লাগছে। ভন্ড দেশ প্রেমিকরা হয়তো বলবেন- আমি ভং ধরেছি বা তাদের মতো ছং সেজে ভং করছি। কিন্তু ঘটনা কিন্তু তা নয়। আমি যা বলছি এবং যা লিখছি তা একান্ত ব্যক্তিগত আবেগ এবং অনুভূতি থেকেই করছি। আর এ ব্যাপারে একমাত্র যিনি মনের খবর রাখেন তার নিকট পানাহ চাওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় দেখছি না। সম্মানীত পাঠকগন হয়তো প্রশ্ন করবেন- কেনো আপনার খারাপ লাগছে। আর কি ই বা এমন বিষয় যা আপনি আগে জানতেন না- এবং হঠাৎ করেই জানলেন- আর ওমনি আপনার খারাপ লাগা শুরু করলো।

আমার কাহিনীটি শুরু করার জন্য ছোট্র একটু ভূমিকা দেয়া দরকার। তা না হলে আমার কলম হয়তো মাহরুম হয়ে পড়বে আসল ঘটনা ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে। গত একবছর ধরে আমি গবেষনাধর্মী একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখছি মোগল হেরেমের দুনিয়া কাঁপানো প্রেম নামে। অতি সম্প্রতি শুরু করেছি একই ধরনের আরো একটি উপন্যাস-নাম-আরব্য রজনীর মহানায়ক। দুটো বইয়ের জন্যই আমাকে প্রতিদিন নিয়মিত পড়তে হয় অনেক কিছু। মোঘল হেরেমের ২৭ তম পর্বের জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে আমাকে বাংলাদেশের নদ নদী নিয়ে অনেক কিছু পড়তে হলো- আমি একথা জেনে খুবই অবাক হলাম যে-দুনিয়ার সব মহান শাসকগন খুব ভালোভাবে জানতেন প্রধান প্রধান নদীর গতিপথ, নদী বিধৌত সমভূমির উর্বরতা এবং নদী পাড়ের সভ্যতা সম্পর্কে। নদীর সঙ্গে মানুষের চিরন্তন সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে মানব চরিত্র যেভাবে বিকশিত হয় তারই একটি গানিতিক এবং জ্যামিতিক রুপ রেখা দাঁড় করিয়ে শাসকগন কোন দেশ আক্রমনের জন্য কর্মপন্থা অবলম্বন করতেন।

দিল্লীর শাসকগন বহু বহু শতাব্দী ধরে চেষ্টা করে আসছিলেন বাংলার উপর স্থায়ী আধিপত্য স্থাপন করার জন্য। কিন্তু কেউ পারেননি কেবলমাত্র মোগল সম্রাট নুর উদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর ছাড়া। সুবেদার ইসলাম খানের মাধ্যমে বাংলা জয়ের পূর্বে সম্রাট প্রথমে বাংলা সম্পর্কে বিস্তারিত জানলেন তার বিদুষী স্ত্রী নুরজাহানের নিকট থেকে। নুরজাহান পরামর্শ দিলেন-বাংলার নদ নদী এবং বর্ষাকাল সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য। সম্রাট সেই কাজটি ভালভাবে করলেন এবং শেষমেষ বাংলা জয়ের রাজ তিলকের মালিক হলেন। ইংরেজরাও একই কাজ করেছিলেন। ১৭৬৪ সালে অর্থাৎ পলাশীর যুদ্ধেও মাত্র ৮ বছর পর ইংরেজরা বাংলার নদনদী গুলো সার্ভে করার জন্য জেমস রেনেল নামক বিখ্যাত সার্ভেয়ারকে নিয়োগ দিলেন। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নদ নদীর জরীপ সম্পন্ন করার জন্য মিঃ রেনেল তার সদর দপ্তর স্থাপন করলেন ঢাকায়। ১৭৭৬ সালে তিনিই প্রথম এই অঞ্চলের নদনদীর ম্যাপ তৈরী করলেন। গত প্রায় দুইশত বছরের ইতিহাসে এতো নির্ভূল ম্যাপ আজ অবধি কেউ তৈরী করতে পারেনি। এজন্য তাকে বলা হয় ভারত বর্ষের ভূগোলের জনক।

বাংলাদেশের নদ নদী নিয়ে অতীতের সেই সব ইতিহাস এবং ম্যাপ ঘাটাঘাটি করতে গিয়েই পদ্মা এবং তিস্তা নদী সম্পর্কে আমি প্রথম বিস্তারিত তথ্য ও উপাত্ত সম্পর্কে ধারনা লাভ করলাম। সারা জীবন শুনে এসেছি পদ্মা নদীর উজানে ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মান করে বাংলাদেশের সর্বনাশ করেছে-কিন্তু কি সর্বনাশ করেছে কিংবা কিভাবে সর্বনাশ করেছে এসব ব্যাপারে বিস্তারিত না জানা এবং না বুঝার কারনে আমার মানসপটে কোন কষ্ট বা বেদনার ছাপ পড়েনি। অন্যদিকে ভারত তিস্তা নদীর উজানে বাঁধ নির্মান করেছে-পানি প্রত্যাহার কওে নিচ্ছে এবং বাংলাদেশকে পানি দিচ্ছে না এসব বিষয় নিয়ে আমাদেও দেশের পরিবেশবাদীগন বহুদিন ধওে আন্দোলন সংগ্রাম কওে যাচ্ছেন। আমি না জানার কিংবা না বুঝার কারনে দেশের অন্যসব নাদান প্রকৃতির মানুষের মতো নিরন্তর নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছি- আর কেবল নিজের স্বার্থে যতটুকু দরকার ততটুকু কর্ম করে ধীরে ধীরে কবরের দিকে এগুচ্ছি অনেকটা নাসির উদ্দিন হোজ্জার দূর্বল গাধাটির মতো।

এই দেশের নদ- নদী সম্পর্কে আমার অজ্ঞতা যখন গর্ব করার বিষয়ে পরিনত হতে যাচ্ছিলো ঠিক তখনই তিস্তা নদীর গতিপথ, পানি প্রবাহ এবং এর উজান থেকে পানি প্রত্যাহার হলে সম্ভাব্য কিকি ক্ষতি হতে পারে তার একটি পরিস্কার দৃশ্য আমি আমার মানসপটে আঁকতে পারলাম। এ কারনে পারলাম যে- ফারাক্কা বাঁধের ভয়ানক ক্ষতি সম্পর্কে আমার নিজের রয়েছে বাস্তব অভিজ্ঞতা। আমার বাড়ী ফরিদপুর জেলার সদরপুর থানায়। পদ্মা-আড়িয়াল খাঁ, মধুমতি, ভূবনেশ্বর, চন্দনা, গড়াই, কুমার প্রভৃতি নদী ছাড়াও বেশ বড় বড় কয়েকটি বিল রয়েছে- এগুলোর নাম দোল সমুদ্র, রাম কেলীর বিল, শকুনের বিল, ঘরাধর বিল প্রভৃতি। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত আমার গ্রামের প্রতিটি বর্ষাকাল আমার সারা জীবনের স্বপ্ন হয়ে থাকবে। সাধারন ভূমি থেকে আমাদের বাড়ি সহ গ্রামের অন্যান্য বাড়ী গড়ে দশফুট উঁচু ভূমির ওপর তৈরী করা ছিলো। জৈষ্ঠ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই আমরা বর্ষার গন্ধ পেতাম এবং প্রস্তুতি নিতে থাকতাম। আষাঢ়ে তো সব কিছু টইটুম্বর। পুরো গ্রাম তলিয়ে যেতো। যে বছর বন্যা হতো সে বছর আমাদের বাড়ীতেও ২/৩ ফুট পানি উঠে যেতো। আমাদের মা চাচীরা ছোট ছোট বাঁশের সাঁকো তৈরী করে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যেতেন।

আমাদের গ্রামীন অর্থনীতির পুরোটাই যেনো ছিলো বর্ষা কেন্দ্রীক। শত শত বড় বড় মহাজনী নৌকা বাজার গুলিতে ভর করতো। বাজার ভর্তি পন্য সামগ্রী। আর মাছ-ওকথা বলতে গেলে বুক ফেটে যায়। আমি নিজে ৪০/৪৫ প্রজাতির দেশী মাছ দেখেছি যা এখন প্রায় বিলুপ্ত। আমাদের গ্রাম বাংলার খুব অল্প পরিবারই বর্ষা কালে মাছ কিনতো। গোটা ২ বরশি নিয়ে কেউ যদি উঠানে বসে যেতো তাহলে ঘন্টা খানেকের মধ্যেই ৪/৫ জন লোকের খাওয়ার মতো মাছের সংস্থান হয়ে যেতো। বর্ষাকালের ধানগাছ আর পাটগাছের অপরুপ দৃশ্য আজও ভুলতে পারছিনা। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওগুলোও পাল্লা দিয়ে বাড়তো। একেকটা পাট গাছ প্রায় ১৫/১৬ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতো এবং মোটা হতো প্রায় ছোটখাটো একটি তল্লা বাঁশের মতো।

আজ সময়ের বিবর্তনে আমাদের গ্রামে বর্ষাকালে একফুট পানিও হয়না। আমাদের নদীগুলো সব মরে গেছে- একটি বিলও অবশিষ্ট নেই। আর মাছের কথা নাই বা বললাম। কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতি এবং মাছ ধরার পেশায় শূন্যতা নেমে এসেছে। লোকজন সব বিদেশে থাকে- বউরা থাকে বাড়ীতে। নীতি নৈতিকতা যে কোথায় গিয়ে নেমেছে তা ভাষায় বোঝানো যাবে না। কর্তারা বিদেশ থেকে টাকা পাঠায় আর তাদের আত্মীয় স্বজন সেই টাকা দিয়ে প্রথমে ঋন শোধ করে। তারপর একটি ঘর বানায় এবং সেই ঘরে বসে দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আমদানী করা ফার্মের মুরগী, মাছ ও তরকারী খায়। কর্তা যখন ৪/৫ বছর পর দেশে ফেরেন তখন দেখেন সব কিছু কেমন যেনো-আউলা ঝাউলা হয়ে গেছে। মনের দুঃখে তিনি আবার চলে যান মরুভূমির দেশে। তার কাছে মরুভূমির দিকে অগ্রসরমান পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের তুলনায় সাহারার তপ্ত বালুর উত্তাপই বোধ হয় ভালো লাগে।

ফরিদপুর সহ সমগ্র উত্তর বঙ্গেও পদ্মা বিধৌত জনপদের আজ একই দৃশ্য- একই হাহাকার পদ্মায় পানি নেই-চলনবিলে কিছু নেই- চারিদিকে কেবল ধু ধু বালুরাশি আর সেই বালু তটের বিবর্ন জনপদেও হাহাকার ছাড়া আপনার চোখে কিছুই পড়বেনা যদি আপনি ঐসব অঞ্চল দেখে থাকেন ১৯৭০-১৯৭৫ সালের মধ্যে। এসব কিছুই হয়েছে কেবল মাত্র একটি বাঁধের জন্য-আর তা হলো ফারাক্কা বাঁধ। আমাদের পরম বন্ধু ভারত এই বাঁধ নির্মান শুরু করেছিলো ১৯৬১ সালে। ১৯৬৯ সালেই এটি শেষ হয়ে যায় কিন্তু আর্ন্তজাতিক চাপের কারনে তারা সেটি চালু করতে পারেনি। পরবর্তীতে স্বাধীনতা লাভের পর ভারত সরকার নানামুখী চাপ প্রয়োগ করার পরও বঙ্গবন্ধু বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রেরনায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে ১৯৭৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ফারাক্কা প্রকল্প ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু এপ্রিল মাসে মাত্র ১৫ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার কথা বলে উত্তরের দাদা বাবুরা সেই যে সর্বনেশে খেলা শুরু করলেন তা কোথায় গিয়ে শেষ হবে তা আল্লাহই ভালো জানেন!

একটি নদীর ওপর অপরিকল্পিত অত্যাচার করার কারনে ভারতে হারাপ্পান সভ্যতা বিলীন হয়ে গিয়েছিলো। বিস্তীর্ন নদীর বিশাল অববাহিকা পরিনত হয়েছিলো মরুভূমিতে। এটা তো বেশী দিন আগের ঘটনাও না। মাত্র ৪০০০ বছর পুর্বেকার ঘটনা। ভারতে তখন তাম্র যুগ চলছে। পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং ইরাকের মেসোপটেমীয় সভ্যতার সমসাময়িক হারাপ্পান সভ্যতা গড়ে উঠেছিল যমুনার মাথা ঘাগর নদীর তীরে। অপরিকল্পিত ভাবে উজানে খাল কেটে পানি প্রত্যাহার করার কারনে নদীটি শুকিয়ে যায় এবং তীরবর্তী বিস্তির্ন অঞ্চল মরুভূমিতে রুপ নেয়। ভারতের বিখ্যাত থর মরুভূমিই হলো প্রকৃতির সেই অভিশাপের ফসল। আপনারা কি জানেন থর মরুভূমি কোথায় এবং কেমন? এটি ভারতের সবচেয়ে বড় মরুভূমি- রাজস্তানে অবস্থিত। যার আয়তন ২ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের চেয়েও বেশি- অর্থাৎ বাংলাদেশের চেয়েও বড়। যে জাতি নিজ দেশে এত্তোবড় একটি মরুভূমি সৃষ্টি করেছিলো নিজেদের কুকর্ম দ্বারা তাদের পক্ষে অন্য একটি দেশকে মরুভূমি বানানো যে কোন ব্যাপারই নয়- এই কথাটি বোধ শক্তিতে আসার পর থেকেই আমার খুবই খারাপ লাগছে।

আজকের লেখার শিরোনাম-”তিস্তাবাঁধ এবং মরন ফাঁদ” এই অংশটুকু নিয়ে কিছু বলার পূর্বে বলে নেই ইমাম বুখারী সম্পর্কে। এই ভদ্রলোক হলেন দিল্লী শাহী মসজিদের প্রধান ইমাম। তামাম দুনিয়ার অত্যাচারিত মুজাহিদগন তাঁকে জানেন একজন সাহসী মানুষ হিসেবে। ছোট খাটো একজন মানুষ- অথচ ঈমান ও একিনের মধ্যদিয়ে যিনি ইদানিং কালে হিমালয়ের উচ্চতাকেও ছাড়িয়ে গেছেন। ভালো নাম সৈয়দ আহমদ বুখারী। তিস্তা বাঁধের মরন ফাঁদ বর্ননা করতে গিয়ে তার নাম কেনো আসলো সেই প্রসঙ্গে বলবো এই লেখার শেষ অংশে। এখন বলছি-তিস্তা বাঁধের ইতিবৃত্ত।

হিমালয়ের সিকিম অংশের পাহুনরি পর্বত শৃঙ্গ থেকে তিস্তার উৎপত্তি। এটিই পৃথিবীর একমাত্র নদী যা কিনা সবচেয়ে উচুঁ স্থান থেকে নেমে এসে সমভূমিতে পড়েছে। হিমালয়ের ২৩,১৮৯ ফুট উঁচু থেকে সিকিম পার হয়ে পশ্চিম বঙ্গের দর্জিলিং, জলপাইগুড়ি হয়ে বাংলাদেশের রংপুর জেলা হয়ে ব্রম্মপুত্র নদে পড়েছে। নদীটির দৈর্ঘ্য মাত্র ১৯২ মাইল যার বেশির ভাগই পাহাড়ের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ফলে এর অববাহিকায় সমভূমি খুব কম- মাত্র ১২,৫৪০ বর্গ কিলোমিটার। ২৩,১৮৯ ফুট উঁচু থেকে কোন নদী মাত্র ১৭৮ মাইল পথ অতিক্রম করে যদি সমভূমিতে পতিত হয় তাহলে সমতলের নরম মাটি নদীটির তীব্র স্রোত ধারন করতে পারে না। তিস্তার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। শিলিগুড়ির ১৪ মাইল উত্তরের শিভোকিতে এসে তিস্তা যখন সমভূমির স্বাদ পেলো তখন তার প্রচন্ড গতিময় স্রোতের তাড়নায় নদীর জলধারা তিনভাগে বিভক্ত হয়ে গেলো। করোতোয়া চলে গেলো পূর্ব দিকে, পশ্চিম দিকে গেলো পূনর্ভবা এবং মাঝখান দিয়ে বয়ে চললো আত্রাই।

মহানন্দা পঞ্চগড় জেলার তেতুলিয়া দিয়ে একবার বাংলাদেশে ঢুকলো এবং দুই মাইল প্রবাহিত হবার পর দিনাজপুরের উত্তরাংশ দিয়ে পুনরায় ভারতে প্রবেশ করলো। এরপর পশ্চিম বঙ্গের কিষানগঞ্জ এবং বিহারের কাথিহার জেলা হয়ে বাংলাদেশের চাঁপাই নবাবগঞ্জের গোদাগিরিতে এসে পদ্মা নদীতে মিশে গেলো। অন্যদিকে করোতোয়া গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা হয়ে যমুনেশ্বরীতে গিয়ে মিশলো। আর আত্রাই নদীও মহানন্দার মতো দিনাজপুর জেলা দিয়ে একবার ঢুকে পুনরায় ভারত চলে গেলো। আবার ভারত থেকে ফিরে এসে দিনাজপুর জেলার দক্ষিন অংশের কুমারগঞ্জ ও বালুরঘাট এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে ফিরে এলো। বাংলাদেশে এসে এটি দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গাবুরা ও কানকারা নদী নামে চলন বিলে পতিত হলো।

তিস্তা নদীর জল ধারার ওপরই উত্তর বঙ্গের সকল নদী, খাল, বিলের জীবন ধারা নির্ভর করে। পদ্মা, ব্রম্মপুত্র, যমুনা এই তিনটি নদীর জীবনও তিস্তার স্রোতধারার ওপর নির্ভর করে আছে। বাংলাদেশের নদ নদীগুলোর সকল পানির উৎস মুখের প্রধান দুটি ঝর্না ধারার একটি হলো ফারাক্কা পয়েন্ট যা ইতিমধ্যে ভারত শতভাগ দখল করে বাংলাদেশের সর্বনাশ করে ফেলেছে। অন্যদিকে তিস্তার পানি পাঁচটি বাঁধ এবং ২টি ব্যারেজের মাধ্যমে প্রত্যাহার করে এদেশের পানি প্রবাহের প্রধান ধারাটি চিরতরে বন্ধ করতে যাচ্ছে। ফারাক্কার মাধ্যমে আমাদের দেশের যে ক্ষতি হয়েছে তিস্তার মাধ্যমে সেই ক্ষতি হবে আরো কমপক্ষে ১০ গুন বেশি। কারন গঙ্গা থেকে ফারাক্কা পয়েন্ট হয়ে পদ্মায় যতটুকু পানি পড়তো তার চেয়ে অনেক বেশি পানি পড়তো তিস্তার তিনটি শাখা নদী দিয়ে। সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হলো-তিস্তার দুইটি পানি প্রবাহ রয়েছে। একটি হলো ভূ-পৃষ্ঠের উপরের জলধারা এবং দ্বিতীয়টি হলো একই সমান্তরালে প্রবাহিত হওয়া ভূ-গর্ভস্থ জলধারা।

ভারত তিস্তা নদীর সুতীব্র স্রোতকে ব্যবহার করে আগামী ১০ বছরের মধ্যে ৫০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা গ্রহন করছে। চীন তার নিজ দেশে ইয়াংসি নদীর ওপর তিনটি ব্যারেজ নির্মান করেও এতো বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারেনি। অন্যদিকে শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনই নয়-তিস্তার পানি বিকল্প খালের মাধ্যমে প্রত্যাহার করে পশ্চিম বঙ্গ সহ আশে পাশের এলাকায় সবুজ বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে। আর অন্যদিকে পুরো হুমকীর মুখে পড়েছে বাংলাদেশের ভূ-তাত্ত্বিক অস্তিত্ব। এখন প্রশ্ন হলো ভারত এসব করতে পারে কি না? আমি বলবো- অবশ্যই নয়-কোন আইন বলেই তারা এসব করতে পারে না। তবে কিভাবে করলো- তারা করলো-এদেশে তাদের নিয়োজিত এজেন্ট, দালাল এবং খয়েরখাদের মাধ্যমে। এখানে কুটনীতি এবং খামখেয়ালীপনা ছাড়া তাদেরকে আর কিছুই করতে হয়নি।

ইতিহাসের কোন কালেই আমাদের এই ভূ-খন্ড ধনে, জ্ঞানে-শক্তিতে ভারতের চেয়ে কম ছিলো না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব ভারতকে অতীতের মতো ছাড়িয়ে গেছে বহুলাংশে। আমি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি- সীমান্ত রক্ষা এবং স্থল যুদ্ধে ভারত এখনো বাংলাদেশের সমপর্যায়ের সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। একথা আমাদের চেয়ে ভারত জানে অনেক বেশি-তাইতো সব কাজ করিয়ে নেয় মীর জাফরী কিংবা জগৎশেঠী কুটকৌশলের মাধ্যমে। আমাদের দেশের বিশ্বাসঘাতকেরা সব কিছু থাকা সত্বেও এ জাতীকে কাঙালের সাজে ফকির বাঙাল বানিয়ে সীমান্ত ঈগলের নিকট সমর্পন করার জন্য দিবানীশি যে কসরৎ করে যাচ্ছে তারই ভয়াল থাবার হিংস্র প্রতিচ্ছবি গুলো ফুটে উঠেছে তিস্তা নদীর বাঁধের মরন ফাঁদের মাধ্যমে। ফারাক্কা ও তিস্তা প্রসংগে এদেশীয় মীর জাফরদের কথাবার্তা শুনে আমার বার বার মনে পড়ছে ইমাম সৈয়দ আহমদ বোখারীর কথা।

ভারতের উগ্রবাদী হিন্দুরা পবিত্র কোরান শরীফ আইনগত ভাবে নিষিদ্ধ করার জন্য পায়তারা আরম্ভ করলো। ইমাম বুখারী গর্জে উঠলেন সিংহের মতো। বললেন- ” আমি শুধু দিল্লী শাহী মসজিদের ইমাম নই- ভারতের ২৫ কোটি মুসলমানের ইমাম। এই ভারতের সকল সাহিত্য, সভ্যতা আর ঐতিহাসিক ইমারতের বেশীরভাগ মুসলমানদের তৈরী। এই লাল কেল্লা, কুতুব মিনার, তাজমহল এবং দিল্লী আমরা তৈরী করেছি। এই ভারতের একীভূত ভূখন্ডকে ৮০০ বছর ধরে একত্র করে রেখেছি আমরা! সেই ভারতে দাঁড়িয়ে কেউ যদি কোরানের বিরুদ্ধে আইন করার জন্য একটি অক্ষরও লিখে-তাহলে আমি আহমদ বুখারী ঐ রাষ্ট্রীয় কর্মচারীর গলায় পা রেখে তার জিহবা টেনে ছিড়ে ফেলবো।” ব্যক্তিগত জীবনে আমি কাপুরুষের হদ্দ। নিজে বীর না হলেও বীরদেরকে পছন্দ করি। ইমাম বুখারীর মতো ওমন করে বলার সাহস বা হিম্মত আমার নেই। তবে আল্লার কোন বীর বান্দা যদি এদেশীয় মীর জাফরদের বিরুদ্ধে ওমন একটি হুঙ্কার তুলতে পারতো তবে এই অধম সেই বীরকে এবং বীর প্রসু জননীকে পা ছুঁয়ে সালাম করে আসতাম!

লেখক: সাবেক সাংসদ

মন্তব্য করুন


 

Link copied