মুরাদ মাহমুদ, সিইও, উত্তরবাংলা ডটকম
“আমাকে তোমরা মাফ করে দিও। আমার জন্য তোমরা কত অপমানিত হয়েছ। আমার জন্য তোমরা হয়তো কারও সামনে উঁচু নজরে কথা বলতে পারবে না। তাই আমার পাপের শাস্তি আমি নিজেই নিজের হাতে দিলাম। তোমরা সবাই আমাকে মাপ করে দিও।”
রাজধানীর দক্ষিণ মান্দার সিটি কলোনির রিকশাচালক মোঃ আলমগীর মেয়ের লিখে যাওয়া চিঠি টা পড়তে পড়তে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। আলমগীরের সপ্তম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়ে প্রেমিক মালেকের হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছিল। অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় তারা বিয়ে করতে না পেরে ফিরে এসেছিল। কিন্তু এই সমাজ তা মানতে পারেনি। তথাকথিত সমাজপতিরা সালিশে প্রেমিক মালেকের ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করে। কিন্তু এই লজ্জা মেয়েটি মানতে পারেনি। গলায় ওড়না জরিয়ে লজ্জা নিবারণের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে আত্মহত্যাকে।
২৫ সেপ্টেম্বর দিবাগত গভীর রাতে নিজ বেডরুমের ফ্যানে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে দশম শ্রেণীর মেধাবী ছাত্রী ইশরাত জাহান ইভা। স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে এলাকার চিহ্নিত বখাটেরা তার ওড়না ধরে টান মারে। এ অপমান সইতে না পেরে সবার অগোচরে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। বখাটেদের উৎপাতে একই পথ বেছে নিয়েছে নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী জেসমিন নাহার সুমি।
সর্বশেষ ঢাকার মাদারটেকের বাগানবাড়ির বাসা থেকে ধলপুর সিটি করপোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ে যাচ্ছিল সাদিয়া আক্তার পিংকি। পথিমধ্যে মানিকনগর পুকুরপাড় এলাকা থেকে রনি তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে অপহরণ করে পিংকিকে। অপহরণ করে পিংকিকে নিয়ে ৫ দিন রাখলেও রনি তাকে বিয়ে করেনি। সম্ভ্রম হারানোর এই গ্লানি মেনে নিতে পারেনি সবে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা দেয়া পিংকি। এ কারণেই ২৩ ডিসেম্বর সেলিং ফ্যানের সাথে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় পিংকি। ২৭ ডিসেম্বর পিংকির জেএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছে। জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়া পিংকি জিপিএ ৫ পেয়েছে। কিন্তু সে নিজেই জানতে পারলো না তার এই সাফল্যের কথা। পিংকির এই সাফল্যে পরিবারে আনন্দের বন্যা বয়ে যাবার কথা থাকলেও এখন বইছে বিষাদের মূর্ছনা।
আত্মহত্যার ঘটনা আমাদের দেশে কোন বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়। বলা যায় আত্মহত্যা এখন সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিনিয়তই আমাদের সমাজে ঘটে চলেছে এই রকম অজস্র ঘটনা। আজকাল সংবাদপত্রে চোখ বুলালে প্রায়ই দেখা যায় কোনো অভিমানী নারীর আত্মহননের খবর। লজ্জা নিবারণের পথ হিসেবে নারীরা বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ। আর প্রতিটি আত্মহত্যার পিছনেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে প্রায় একই ধরণের ঘটনা। কেও যৌন হয়রানীর শিকার হয়ে, কেও প্রেমে ব্যর্থ হয়ে, কেও বখাটেদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে, কেও দাম্পত্য অশান্তির কারণে, কেও বা পারিবারিক কলহের জের ধরে আত্মহত্যার পথে পা বাড়াচ্ছে। নারীদের আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে আমাদের চলমান সমাজ ব্যবস্থা। জন্মের পর থেকে নারীকে “লজ্জা নারীর ভূষণ” কথাটা শিখানো হয়েছে কিন্তু তাদের প্রতিবাদের ভাষা শিখানো হয়নি। যার ফলে শত অপমান বঞ্চনা স্বত্বেও তারা প্রতিবাদ করতে সাহস পায়না। নারীকে মানসিক ভাবে দুর্বল করে রেখেছে আমাদের পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থা। তাইতো নারী লজ্জা নিবারণের জন্য বেছে নিচ্ছে আত্মহননের পথ।
একজন নারী যখন কোন বিকৃত লালসার স্বীকার হয়ে মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পরে তখন তার পাশে সহানুভূতি নিয়ে দাঁড়ানো প্রয়োজন। সব থেকে বড় প্রয়োজন তাকে সাহস যোগানো। কিন্তু আমাদের সমাজ তার উল্টো পথে হাঁটছে। সহানুভূতির পরিবর্তে ধিক্কার আর ঘৃণার চোখে দেখা হয় তাকে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা তাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে রাখে। যার ফলে বাধ্য হয় নারী আত্মহননের পথ বেছে নিতে।
ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর যে নারীর অতীত, যে নারী কে অর্ধাঙ্গী বলা হয়ে থাকে সে নারী আজ পরিবেশের সামান্য প্রতিকূলতায় আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। আমাদের নষ্ট সমাজ ও বিকৃত পরিবেশটাকে এজন্য ধিক্কার জানাই। নারীদের প্রতিবাদী করে গড়ে তুলতে না পারলে এই পথ থেকে তাদের ফিরানো সম্ভব নয়। আমরা যদি আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকে পাল্টে দিতে না পারি তবে ইভা, সুমি, সেঁজুতি, পিংকি দের কোন দিনই ফিরানো যাবে না।
দৈনিক গণআলো, উপ-সম্পাদকীয়: ০৩.০১.২০১৩ইং