আমার অবোধ্য হলেও বাস্তবতায় এ নির্মম ঘটনাবলী অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। যদি এ দানবীয় ঘটনাবলী থেকে আমরা মুক্ত থাকতে পারতাম তাহলে কতই না ভালো হতো! কিন্তু তা আর আমাদের কপালে জুটবে কি? অতীত হিসাবের খাতা খুলে বর্তমানের বাস্তবতায় আমাদের যে ভবিতব্য দেখতে পাই সেখানে হতাশার চোরাবালিতে হারিয়ে যাওয়ার শত শত ঘটনা আকিবুকি দেয়। কিন্তু এ অবস্থা চলতে থাকলে তা অপরাপর রাষ্ট্রসমূহের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি ও মানবিক মূল্যবোধের অবস্থান কোথায় নিয়ে গিয়ে ঠেকাবে- সে প্রশ্ন আজ তাই বারবার আসছে।
আমরা যাদের জলদস্যু বলি তারা সোমালিয়াতে নাকি বীরের মর্যাদা পায়! কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এত অসংখ্য বীরভোগ্য হয়েও সোমালিয়ার অবস্থা আজ এমন কেন? সমস্ত সূচকে তারা আজ তলানিতে কেন? এর কারন হচ্ছে, আইনের শাসন বলে সেখানে আজ আর কিছু অবশিষ্ট নেই। প্রতিটি মানুষ অর্থ জোগানের সহজপথ হিসেবে জলদস্যুতাকে বেছে নিয়েছে। এতে দুটি লাভ। (এক)এবাবে সস্তা উপায়ে অর্থ আয় সম্ভব (দুই) এতে জাতির কাছে বীরের সম্মানও পাওয়া যায়। দস্যুতা তাই সেখানে বীরের কর্ম।
আমাদের দেশেও একসময় এমন বীরের ব্যাপক আনাগোনা পরিলক্ষিত হতো। বিশেষ করে ঢাকা শহরকে এমন জবরদস্ত পালোয়ানরা ভাগাভাগি করে নিয়েছিলো। ফুটপাত থেকে শুরু করে আলিশান বাড়ীর অন্দর-সবখানেই ভায়েরা ছিলো অপতিরোধ্য, দুর্বার।ইচ্ছেমতো চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে, অপহরণ, গুম এবং খুন তাদের কাছে ছিলো পানি-ভাত খাওয়ার মতো ব্যাপার। তাদের গতিরোধ করার মতো সাহস তখনকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছিলো কিনা তা আজ বিস্তর গবেষনার ব্যাপার। আর সাহস যদি তখন থেকেও থাকে তাহলে সদিচ্ছার অভাব যে ছিলো তা তো তাহলে বলাই বাহুল্য।
পুলিশ, প্রশাসন, রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী আর ষড়যন্ত্রী অনেকেই ছিলো এ সন্ত্রাসীদের সাগরেদ।তাদের এ কর্ম তৎপরতা তাই একবিংশ শতাব্দীর প্রথম তিন বছর পর্যন্ত চলতে পেরেছে প্রায় বাঁধাহীন গতিতে। তারপর তারা প্রথম বুঝতে পারলো তাদের সেই চেনাজানা পরিবেশ এখন আর আগের মতো নেই। এই প্রথম তারা অনুভব করতে পারলো ঘুড্ডির নাটাই এখন তাদের হাত ফস্কে কালো কাপড়ে মোড়া কেতাদুরস্ত এক বাহিনীর হাতে চলে গিয়েছে যারা র্যাব নামে পরিচিত।
পোশাকে-আশাকে, চলনে-বলনে সত্যিই র্যাব কে মনে হলো যেন সন্ত্রাসীদের মৃত্যুদূত। কিন্তু কেন এ বিশেষ বাহিনী গঠনের প্রয়োজন পড়লো?পুলিশ থাকতে আবার র্যাবের দরকার কি? এর উত্তর হচ্ছে অভ্যন্তরীন সন্ত্রাসের লাগাম টেনে ধরা। অবৈধ অস্ত্রের উদ্ধার ও ব্যবহার হ্রাস । আইন শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে অন্যান্য বাহিনীকে সহযোগিতা প্রদান এবং সন্ত্রাস দমনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক চাকাকে গতিশীল রাখা। এ বাস্তবতাকে সামনে রেখেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত এই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ গঠিত হয় এবং একই বছরের ১৪ এপ্রিল (পহেলা বৈশাখ) তাদের কার্যক্রম শুরু করে। র্যাবের মনোগ্রামে স্মৃতি উৎকীর্ণ স্মৃতিসৌধ এর নিচে অবস্থিত ধাতব চাকা সময়ের সাথে দ্রুত উন্নয়নশীল বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রতীক । যে কোন মূল্যে সন্ত্রাস নির্মূল করে হৃদয়ের দেশ বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রগতির চাকা অব্যাহত রাখতে র্যাব প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। (সূত্র: বাংলাপিডিয়া ও র্যাবের ওয়েবসাইট) বিগত েেচৗদ্দ বছরে র্যাবের মাথায় যুক্ত হয়েছে সাফল্যের বিরামহীন মুকুট। তাদের কর্মতৎপরতায় ঢাকা শহরের কর্মরত আন্ডাওয়াল্ডের ডন ও তার চ্যালাচামুন্ডেরা দেশ ছেড়ে ভিন দেশে পালিয়ে যায়। জঙ্গীবাদের ভয়াবহ উত্থানকে রুখে দেয় তাদের সুদক্ষ কর্মপ্রচেষ্টা দিয়ে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও মাদকদ্রব্য ব্যবসায়ীদেরকে ধরে ধরে আইনের হাতে সোপর্দ করে। অনেক উঠতি সন্ত্রাসী এ সকল আইন বিবর্জিত কাজ ফেলে শান্তির জীবনে ফিরে আসে। পরিসংখ্যান বলছে, র্যাব তার জন্মের পর থেকে এ পর্যন্ত ৩১৪৯ টি অবেধ অস্ত্র এবং ৩৬০০০ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে। সেই সাথে ৫০০ জনের অধিক লোককে গ্রেফতার করেছে।
কিন্তু, ক্রসফায়ারের নামে বিচার বহিভুত হত্যাকান্ডের কারনে তাদের এ সাফল্যের ঢেউ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে দেশ এবং বিদেশের কিছু মানবাধিকার সংগঠন এবং কথিত মোড়ল সম্প্রদায়ভুক্ত দেশ কর্তৃক। পরিসংখ্যানের দিকে চোখ বুলালে দেখা যায়, এ পযর্ন্ত র্যাব কর্তৃক ৭৬০ টি ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে। এর ফলে আমেরিকা র্যাব আর প্রশিক্ষন না দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়ে দেয়। (সূত্র: দি ঢাকা ট্রিবিউন, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪)।
সম্প্রতি নারায়নগঞ্জে অপহৃত ব্যক্তিবর্গের হত্যার সাথে র্যাব এর কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজশ তাদের কর্মকান্ডকে ব্যাপক প্রশ্নের সম্মুখীন দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। যদিও এ হত্যাকান্ডে জড়িত সন্দেহে র্যাবের এ তিন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর সর্বাত্মক আয়োজন চলছে যা র্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া শাখার পরিচালক এটিএম হাবিবুর রহমানের বক্তব্যে পরিষ্কার। তিনি বলছেন, মামলায় জড়িত থাকার সন্দেহে বহিষ্কৃত র্যাব কর্মকর্তাদের বিষয়ে তদন্ত চলছে। র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা, আত্মীয়-স্বজনদের ব্যাংক হিসাব যাচাই বাছাই চলছে।
তবে দু:খের বিষয় হচ্ছে, মানবাধিকারের কথিত ধ্বজাধারীরা এ ঘটনায় ব্যাপক উচ্চকিত হয়ে উঠেছেন। তারা চান র্যাবের বিলুপ্তি। হিউম্যান রাইট ওয়াচ এবং ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন ইতোমধ্যে তাদের সে ধরনের দুরভিসন্ধিমূলক মনোভাব প্রকাশ করেছেন। মানবাধিকারের এ কথিত পুজারীরা আমেরিকার এফবিআই কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে নীরব থাকেন। ড্রোন হামলা করে যখন মানুষ মারা হয় তখন কি মানুষগুলোর মানবাধিকার থাকে না? লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফী এবং আল কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেন যখন বিনাবিচারে মারা যান তখন তারা নিশ্চুপ থাকেন। গুয়ানতানামো কারাগারে ধরে নিয়ে গিয়ে অনেক নিরীহ মানুষের উপর তারা ব্যাপক নির্যাতন চালিয়েছে। এসব জেনেশুনেও মানবাধিকার সংগঠনগুলো কিছু বলেনি কেন? বিশ্বের অনেক প্রভাবশালী দেশ আন্তর্জাতিক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মানবাধিকার লঙ্গনের চরমতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও সেখানে তারা নীরব থাকে। টু শব্দটিও করেনা। এফবিআই, সিআইএ এদের কার্যক্রম তো বন্ধের কথা বলে না। কিন্তু আমাদেরকে মাখা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার মতো উপদেশ দিতে তাদের বিন্দুমাত্র লজ্জা হয় না।তাই নির্লজ্জের মতো ব্যক্তি বিশেষের ভুলের দায় তারা পুরো বাহিনীর উপর চাপিয়ে দিয়ে এ বাহিনীটিকেই বিলুপ্ত করার দাবি তুলছে। কি আজব প্রেসক্রিপশন!
এখন একটু দেখুন আমাদের দেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ড. আকবর আলী খানের মন্তব্যের দিকে। তারা মানবাধিকারের পক্ষে লড়াই করেন। অথচ তিনি হলমার্ক কেলেংকারীতে জড়িত ব্যক্তিদের কে র্যাবের রিমান্ডে দেওয়ার দাবি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, দুদককে দিয়ে হলমার্কের টাকা আদায় হবে না; সেজন্য অভিযুক্তদের র্যাবের রিমান্ডে পাঠাতে হবে০।( সূত্র: ক্লিনহার্ট এবং ক্লিন হার্ট, জাহিদ নেওয়াজ খান, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১২) এই হলো আমাদের সুশীল সমাজের দ্বিচারিতা। র্যাবের সমালোচনা করে সবসময় কিন্তু বিশেষ প্রয়োজনে তার গুরুত্ব কিন্তু তারা অস্বীকার করতে পারে না।
আজ সমাজের সর্বত্র ঘুন ধরেছে। যারা আমরা এই সমাজে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত তারা তো এ সমাজেরই লোক। ভিন দেশ বা গ্রহের বাসিন্দা নয়। তাহলে, যে সমাজে আমরা খেয়েপরে বেড়ে উঠছি সে সমাজের কাছ থেকে তো আমরা শিখছিও। কি শিখছি আমরা সেখান থেকে? আসুন নিচের ঘটনাগুলোর দিকে একটু চোখ বুলাই তাহলেই সব খোলাসা হয়ে যাবে।
আমাদের দেশে পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। যারা পরীক্ষার্থীদের জীবন নিয়ে এমন ছিনিমিনি খেলে তারা তো সমাজের সবচেয়ে বড় শত্রু। এদের কোন বিচার আজ পর্যন্ত আমরা দেখেছি কি? প্রতিটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে।অনেকবার পিএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। তাতে কি পিএসসি বন্ধ করার মতো হঠকারী চিন্তা কারো মাথায় এসেছে?
প্রাইমারী, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি ইত্যাদি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও নিয়মিতই ফাঁস হচ্ছে। কই কখনো তো শুনিনি এর থেকে পরিত্রানের উপায় হিসেবে আমাদের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড বন্ধ করার কথা বলতে! কারন, শিক্ষাবোর্ড বন্ধ করা এর সমাধান নয়।
অথচ, পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়াও মানবাধিকার লঙ্ঘনের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। প্রশ্নপত্র ফাসেঁর কথা শুনলে পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষার আগে পড়া বাদ দিয়ে সে এবং অনেক সময় তার পরিবার এ ফাঁস হওয়া প্রশ্ন সংগ্রহে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পরিবার এবং রাষ্ট্রের কাছ তেকে এ শিক্ষার্থী কি শিখলো? শিখলো অনৈতিক কাজ করা দোষের নয়। জীবনের নানা পরীক্ষায় তাই তারা এ রকম্ দুর্নীতি করতে আর পিছপা হবে না। প্রশ্নপত্র ফাঁসের এ ঘটনার পরিনাম যে কত ভয়াবহ তা উঠে এসেছে ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবালোর লেখায়। তিনি লিখছেন, ......তখন তাদের মনে বিস্ময়, আতঙ্ক কিংবা লোভ জন্মেছে কি না জানি না, কিন্তু আমি নিশ্চিতভাবে জানি এটি ছিল শিশুদের রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্নীতি শেখানোর প্রথম পদক্ষেপ। একটি দুটি শিশু তাদের আশেপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে অন্যায় করতে শিখে যেতে পারে, কিন্তু একটি রাষ্ট্র দেশের পুরো শিশুসমাজকে দুর্নীতি করতে শিখাতে পারে, এটি সম্ভবত পৃথিবীর আর কোথাও ঘটেনি। ( সূত্র: প্রশ্নপত্র ফাঁস কি অপরাধ নয়, ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল,বিডিনিউজ২৪.কম ৮ মে,২০১৪)
এমন শিশুই তো বড় হয়ে সিভিল প্রশাসন ও সশস্ত্র বাহিনীতে যোগ দেবে। নৈতিকভাবে যে দুর্নীতিগ্রস্থ সে প্রশাসনে গিয়ে কি সুনীতির পরিচয় দিবে? এখন এর সমাধান কি পরীক্ষা পদ্ধতিই বাদ দিয়ে দেওয়া? নাকি যারা এ ধরনের কাজের সাথে জড়িত তাদের সর্ব্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করে অপরাধের লাগাম টেনে ধরা?
১০ মে, ২০১৪ তে দেশের সকল পত্রিকায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি রিপোর্ট বের হয়েছে। ৯১ টি দেশের ১৬০০টি শহরের উপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে বাংলাদেশ দুষিত বায়ুর দেশের মধ্যে ৪র্থ স্থান দখল করেছে। আর প্রথম ২৫ টি দুষিত শহরের মধ্যে রয়েছে নারায়নগঞ্জ, গাজীপুর ও ঢাকা। এটা আমাদের জন্য ভয়াবহ তথ্য।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, এনাম মেডিকেল কলেজ।