ইনজামাম-উল-হক নির্ণয়, নীলফামারী ২৩ জুন॥ রেজিস্ট্রি অফিসগুলোতে বালাম বই সংকট চলছে। কপি করতে না পারায় প্রত্যেক অফিসে দলিলের স্তুপ জমে উঠেছে। জমির মালিকরাও সঠিক সময়ে দলিল হাতে না পেয়ে পড়ছেন নানা সমস্যায়। জমি রেজিস্ট্রির পর দলিলের কপি সংরক্ষণ করা হয় সংশ্লি¬ষ্ট রেজিস্ট্রি অফিসে। আর দলিল কপি করার জন্য প্রয়োজন বালাম বই। অথচ বালাম বই সরবরাহ না থাকায় নীলফামারী সহ রংপুর বিভাগে আট জেলায় দলিল হস্তান্তর বন্ধ রাখা হয়েছে। এ কারণে এই বিভাগের জেলা ও উপজেলা গুলোর ২০ লাখেরও বেশি দলিল হস্তান্তর আটকা পড়ে আছে। ২০১১ সালের মার্চ মাস থেকেই বালাম বই নেই । এতে জমি ক্রেতারা মুল দলিল হাতে পাচ্ছেন না। পাশাপাশি বালাম বই সংকটের কারনে রেজিস্ট্রার অফিস গুলোর মোহরার ও নকল নবিশরা পরিবার পরিজন নিয়ে পড়েছে বিপাকে।
নীলফামারী জেলা রেজিস্ট্রার খলিলুর রহমান বলেছেন, অনেক বার বলেছি। কিন্তু, বালাম বই পাচ্ছি না। কোনো সুরাহা হয়নি। তিনি বলেন, আগে কিছু কিছু করে সরবরাহ ছিল। কিন্তু প্রায় ৩ বছর থেকে সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। বিষয়টি তিনি মহাপরিদর্শককেও (নিবন্ধন/আইজিআর) জানিয়েছেন। কিন্তু, তারপরও বালাম বই সরবরাহ পাননি বলে জানান।খোঁজ নিয়ে জানা যায় শুধু নীলফামারী নয়, রংপুর বিভাগের রংপুর,পঞ্চগড়.ঠাকুরগাঁও,দিনাজপুর,কুড়িগ্রাম,লালমনিরহাট ও গাইবান্ধা জেলার সকল উপজেলার রেজিস্ট্রার অফিসের অবস্থা একই।
একটি নিভর্রযোগ্য সুত্র জানায়, বালাম বই ছাপানোর অনুমতি দেয়া হলেও বিজি প্রেস থেকে সরবরাহ করতে পারছে না। গত সংসদ,উপজেলা ও বিভিন্ন স্থানের উপ নির্বাচনের কারণে বিজি প্রেস বালাম বই ছাপাতে না পারায় এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
সুত্র মতে নিবন্ধন/আইজিআর এর পক্ষে অন্য প্রেস থেকে বালাম বই ছাপানোর চেষ্টা করা হলেও অর্থ সংকটের কারণে সম্ভব হয়নি। কারন অর্থ মন্ত্রণালয় বরাদ্দ দেয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয় যদি বরাদ্দ দেয়, তারপর ছাপা হতে পারে বালাম বই।
সুত্রটি মতে ভোট শেষ হয়েছে, তাই বিজি প্রেস কর্তৃপক্ষ নাকী বলেছে চলতি জুন থেকে মাসে ১০ হাজার বালাম বই সরবরাহ করবে। কিন্তু এখনও বালাম বই পাওয়া যায়নি। তাই নীলফামারী সহ রংপুর বিভাগের আট জেলায় ২০১১ সালের মার্চ মাস থেকে বালাম সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।
নীলফামারী সাব-রেজিষ্ট্রার অফিসের দলিল লেখক সমিতির সাধারন সম্পাদক মহম্মদ আব্দুল্লাহ জানিয়েছেন, বালাম বই সংকটের কারণে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন নকলনবিশরা। তিনি জানান, কাজের ওপর ভিত্তি করে মজুরি পান নকলনবিশরা। কাজ বন্ধ। তাই, মজুরি পাচ্ছেন না। সে কারণে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতন জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। দ্বিতীয়ত, দুর্ভোগ শিকার হচ্ছেন, জমির ক্রেতারাও। তারা দলিল পাচ্ছেন না। বালাম বইয়ে তুলতে না পারার কারণে দলিল সরবরাহ বন্ধ হয়ে আছে। এ কারণে জমি কেনার পরও দলিলের অভাবে নামজারি করতে পারছেন না।
নীলফামারীর এক্সট্রা মোহরার ও নকলনবিশ সমিতির সাধারন সম্পাদক কামরুজ্জামান বলেন আমরা প্রতি ৩০০ শব্দ অর্থাৎ ১ পৃষ্ঠা বালামে তুললে ২৪ টাকা বিল পাই। এর বাইরে আমাদের কোনো বেতন-ভাতা নেই। ২০১১ সালের ২ মার্চ থেকে বালাম বই না থাকায় নকলনবিশরা বেকার বসে আছেন, যাদের অনেকেরই সংসার এই আয়ের ওপর নির্ভরশীল। তিনি বলেন রংপুর বিভাগেই প্রায় ৮শ নকলনবিশ রয়েছেন। এরমধ্যে নীলফামারী সদরে রয়েছে ৫৯ জন। নকলনবিশরা খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছেন। বার বার বলার পরও কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না বলে দাবি করেছেন তিনি।
অপর একটি সুত্র জানায় এক সময় জেলা অফিসের চাহিদাপত্র অনুযায়ী ঢাকা থেকে সরাসরি সংশ্লিষ্ট জেলায় বালাম বই পাঠিয়ে দেওয়া হতো। কিন্তু এখন বিভাগীয় শহরে অবস্থিত জোনাল অফিসের মাধ্যমে বালাম বই সংগ্রহ করতে হয়। কিন্তু সেখানেও এই বই নেই।
নীলফামারীর সাব-রেজিষ্ট্রার আনন্দ বর্মন খাতাপত্র ঘেটে জানান অফিসে যে বালাম বই ছিল তা ২০১১ সালের ১ মার্চ শেষ হয়ে যায়। তাতে ২৭শত দলিল বালাম ভুক্ত হয়েছে। এখন বালাম বই সরবরাহ না থাকায় শুধু মাত্র নীলফামারী সদর সাব- রেজিস্ট্রার অফিসে ২২ জুন পর্যন্ত ২৬ হাজার ৫০টি দলিল বালাম ভুক্ত হবার অপেক্ষায় পড়ে রয়েছে। এ ছাড়া সরকারি ছুটির দিন বাদে প্রতিদিন গড়ে এখানে ৪০/৫০টি নতুন দলিল সম্পাদক করা হচ্ছে। ফলে দিন দিন দলিলের সংখ্যা বাড়ছে। এতে দলিল হস্তান্তর করা যাচ্ছেনা বলে তিনি জানান।
নীলফামারী চেম্বারের সভাপতি আব্দুল ওয়াহেদ সরকার অভিযোগ করে বলেন লক্ষ-কোটি টাকার বিনিময়ে জমি কিনে দেশের প্রচলতি আইনে মানুষ মালিকানার স্বীকৃতির জন্য রেজিষ্ট্রি অফিসের দারস্থ্য হয় । নানা ঝক্কি ঝামেলা শেষে হাজার হাজার টাকা ব্যয় করে দলিল নিবন্ধনের মধ্যে দিয়ে জমির মালিকানা পরিবর্তন করা হয় । রেজিষ্ট্রি অফিসে সংরক্ষন করা হয় জমিজমা সংক্রান্ত সকল প্রকার নথি পত্র । কিন্তু বালাম বই সংকটের কারনে রেজিষ্ট্রি অফিস থেকে জমির মুল দলিল হস্তান্তর বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে অনেক ব্যবসায়ী, ব্যবসা বানিজ্যে ব্যাংক ঋন করতে পারছেনা। তিনি বলেন বিভিন্ন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দলিলের অবিকল নকল বা দলিলের স্লিপ গ্রহন করছেননা। তারা মুল দলিল ছাড়া ঋণ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তিনি আরো জানান তার একটি দলিল ২০১১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সম্পাদন করা হয় নীলফামারী সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসে। কিন্তু বালাম বইয়ের সংকটে তিনি প্রায় ৩ বছর হলো জমির মুল দলিল পাননি। ফলে তিনিও ব্যাংক ঋণ করতে না পারছেন না।