আর্কাইভ  মঙ্গলবার ● ১৯ মার্চ ২০২৪ ● ৫ চৈত্র ১৪৩০
আর্কাইভ   মঙ্গলবার ● ১৯ মার্চ ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: রংপুরের আলু যাচ্ছে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে       গ্রাহকের ৫০ লাখ টাকা নিয়ে উধাও পোস্টমাস্টার!       চার ঘণ্টা পর উত্তরবঙ্গের সাথে ঢাকার ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক       ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন       রংপুরে মিস্টি ও সেমাই কারখানায় ৫০ হাজার টাকা জরিমানা      

 width=
 

মধুহীন ১৪১ বছর

রবিবার, ২৯ জুন ২০১৪, দুপুর ১০:২৪

‘দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধি স্থলে (জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি বিরাম)মহীর পদে মহা নিদ্রাবৃত দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন! যশোরে সাগরদাঁড়ি কবতক্ষ-তীরে জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী’ কখনও কখনও রাষ্ট্রনায়কেরা সে দেশের গণ-মানুষের আচার-আচরণে প্রভাব বিস্তার করে। ব্রিটিশ ভারতের শাসক যখন ইংরেজ; ইতিহাসের সেই ক্রান্তি লগ্নে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের আবির্ভাব। সঙ্গত কারণেই আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠা মধুসূদনের নজর ছিল ইংরেজদের জীবনাচারের দিকে। কোনো না কোনোভাবে তিনি এই আধুনিকতার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সুতরাং কোনো সমালোচক যদি বলার চেষ্টা করেন, তিনি ইউরোপে পাড়ি জমানোর জন্য ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন, কথাটি সত্য হবে না। এ জন্য তার শিক্ষাজীবনের দিকে ফিরে তাকাতে হবে। মেধাবী হওয়ায় কলেজের অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন ডিএল রিচার্ডসনের প্রিয় ছাত্র ছিলেন তিনি। তৎকালীন হিন্দু কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক ডিরোজিও’র স্বদেশানুরাগের স্মৃতিও তাকে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে। আর সে কারণেই বুঝি আঠারো বছর বয়সেই বিলেত যাওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার মনে বদ্ধমূল হয়ে যায়।

এর বাইরে তার কবিতাতেও বিষয়টি বহুবার উঠে এসেছে। তিনি একটি কবিতায় বলেছেন- ‘ছিলো যত প্রিয় মোর মায়ার বাঁধন। আসিলাম ছাড়ি সব খ্রিষ্টের কারণে গগনের নিচে ছিলো যত প্রিয় ধন ত্যাগিলাম তোমা লাগে, কষ্ট নাই মনে।’ সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, বিষয়টি নিয়ে তার কোনো আক্ষেপ, অনুশোচনা তো ছিলই না, ছিল না কোনো দুরভীসন্ধী। তিনি স্বদেশ এবং স্বধর্মের প্রতি কোনো অবস্থাতেই বিরূপ ছিলেন না, তবে উদাসীন ছিলেন। তার মনজুড়ে ছিল খাঁটি ইংরেজ হওয়ার ইচ্ছা। মূলত কৈশোর-উত্তীর্ণ বয়সকাল থেকেই মধুসূদন দত্তের কাব্যচর্চার সূচনা। সূচনালগ্নেই আমরা এই কবিকে ইংরেজিতে  কাব্যচর্চা করতে দেখেছি। এ বড় আশ্চর্যের কথা, মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও তিনি কাব্যচর্চার জন্য ইংরেজি ভাষার দারস্থ হয়েছিলেন। এ জন্য আবারও আমাদের কবির শিক্ষাজীবনে ফিরে যেতে হবে। ততদিনে তিনি ধর্মান্তরিত হয়েছেন। বাবা তাকে ত্যাজ্যপুত্র করেছে। ফলে বন্ধুদের সহায়তায় ভাগ্যান্বেষণে তাকে কলকাতা ছেড়ে মাদ্রাজ চলে যেতে হয়। সেখানে গিয়েও তিনি বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি। এ সময় তিনি বাধ্য হয়েই ইংরেজি পত্রপত্রিকায় লিখতে শুরু করেন। ফলে সেই পরিস্থিতিতে তিনি যে কাব্যচর্চার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষা বেছে নেবেন এটা অনুমান করে নেয়া যায়।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত পঁচিশ বছর বয়সে নিদারুণ দারিদ্র্যের মধ্যেই ‘দ্য ক্যাপটিভ লেডি’ লিখে শেষ করেন। কিন্তু ইংরেজিতে লিখে প্রত্যাশিত প্রশংসা না পেয়ে তিনি ভীষণভাবে দমে যান। অবশেষে ঘরের ছেলে মধুসূদনকে ঘরেই ফিরে আসতে হয়। বাংলা সাহিত্যে মধুসূদন দত্ত ‘মহাকবি’ উপাধিতে ভূষিত হলেও মূলত নাট্যকার হিসেবেই তিনি বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে প্রবেশ করেছিলেন।

রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘রত্নাবলী’ অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি বাংলা নাট্যসাহিত্যে উপযুক্ত নাটকের অভাব বোধ করেন। এই অভাব পূরণেই তিনি মূলত নাটক লিখতে আগ্রহী হন। আমরা তার রচনায় পাই ‘শর্মিষ্ঠা’ শিরোণামের নাটক। এটিই প্রকৃত অর্থে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক নাটক।

পাঠক লক্ষ্য করুন, যে কবি কাব্য লিখতে ইংরেজি ভাষা বেছে নিয়েছিলেন সেই তিনিই আবার বাংলায় প্রথম মৌলিক নাটক রচনা করলেন। শুধু কী তাই, ১৮৬০ সালে তিনি দুটি প্রহসন লিখে শেষ করেন। এর একটি ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ অন্যটি ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’।

এমন অনেক কিছুরই প্রথম স্রষ্টা তিনি; অন্তত বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে। তার লেখা পূর্ণাঙ্গ নাটক ‘পদ্মাবতী’। এই নাটকেই তিনি প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন। এটি পৌরাণিক নাটক। তবে এই নাটকের ভিত্তি পুরোপুরি ভারতীয় পুরাণ নয়। গ্রিক পুরাণের ‘অ্যাপেল অফ ডিসকর্ড’ গল্পটি ভারতীয় পুরাণের মোড়কে পরিবেশন করেছেন মধুসূদন। গ্রিক পুরাণের জুনো, প্যালাস ও ভেনাস এই নাটকে হয়েছেন শচী, মুরজা ও রতি। হেলেন ও প্যারিস হয়েছেন পদ্মাবতী ও ইন্দ্রনীল। তিন দেবীর মধ্যে রতিকে শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নির্বাচিত করলে অন্য দুই দেবী ইন্দ্রনীলের প্রতি রুষ্ট হন এবং ইন্দ্রনীলের জীবনে বিপর্যয় ঘনিয়ে আসে। শেষে রতি ও ভগবতীর চেষ্টায় ইন্দ্রনীল উদ্ধার পান এবং বিচ্ছিন্ন স্ত্রী পদ্মাবতীর সঙ্গে তার মিলন ঘটে। মূল গ্রিক উপাখ্যানটি বিয়োগান্তক হলেও, মাইকেল এই নাটকটিকে ইংরেজি ট্র্যাজিক-কমেডি ধাঁচে করেছেন মিলনাত্বক। এই নাটকে সংস্কৃত নাট্যরীতির প্রভাব অল্পই।

প্লট-নির্মাণ, নাটকীয় দ্বন্দ্ব উপস্থাপনা ও চরিত্র চিত্রণে মাইকেল এখানে আগের থেকে পরিণত হয়েছেন। সেই একই বছর ১৮৬০ সালে তিনি অমিত্রাক্ষরে লেখেন `তিলোত্তমাসম্ভব` কাব্য। এরপর একে একে রচিত হয় ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’, ‘ব্রজাঙ্গনা’, ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটক, ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্য, ‘চতুর্দশপদী কবিতা’ ইত্যাদি।

আজ ২৯শে জুন। মহাকবির ১৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী। মৃত্যুদিনে মহাকবিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।

মন্তব্য করুন


 

Link copied