আর্কাইভ  শুক্রবার ● ২৯ মার্চ ২০২৪ ● ১৫ চৈত্র ১৪৩০
আর্কাইভ   শুক্রবার ● ২৯ মার্চ ২০২৪
 width=
 

 

কুড়িগ্রামের খাবারে বেজায় খুশি ভুটানের রাজা

কুড়িগ্রামের খাবারে বেজায় খুশি ভুটানের রাজা

কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করলেন ভুটানের রাজা

কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করলেন ভুটানের রাজা

রানিকে নিয়ে কুড়িগ্রামে পৌঁছেছেন ভুটানের রাজা

রানিকে নিয়ে কুড়িগ্রামে পৌঁছেছেন ভুটানের রাজা

কুড়িগ্রামে সমৃদ্ধির হাতছানি

কুড়িগ্রামে সমৃদ্ধির হাতছানি

 width=
 
শিরোনাম: রংপুরবাসীর জন্য সরকারি চাকরি, পদ ১৫৯       স্বাস্থ্যের রংপুর বিভাগীয় পরিচালক ফজলুল হক কারাগারে       কুড়িগ্রামের খাবারে বেজায় খুশি ভুটানের রাজা       লালমনিরহাটে পুকুরে জাল ফেলতেই জালে উঠে এলো যুবকের মরদেহ       কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করলেন ভুটানের রাজা      

 width=
 

কর্নেল তাহের হত্যাকাণ্ড ও ৭ নভেম্বরের ‘সিপাহী-জনতার গণঅভ্যুত্থান’ (১ম পর্ব)

সোমবার, ২১ জুলাই ২০১৪, দুপুর ১০:৫০

শাহ্‌ রিয়াদ আনোয়ার শুভ :

সেই বিচার যে আসলেই বিচারের নামে প্রহসন ছিল তা বোঝা যায় মামলার ট্রায়াল শুরু হবার পর থেকেই। সামরিক আইনের আওতায় জেলের ভিতরে গোপনে অনুষ্ঠিত একটি বিচার জাতিসংঘ ঘোষিত সার্বজনীন মানবাধিকারের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানের পর্যায়ে পড়ে না। আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগ দেয়া হয়নি সেই ক্যাঙ্গারু ট্রায়ালে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষিত হলো। ফাঁসীর দণ্ডাদেশ দেয়া হলেও সবাই ধারণা করেছিল যে, কর্নেল তাহেরের দণ্ডাদেশ কার্যকর হওয়ার নয়। একজন ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার, যার দেহের একটি অংশ উড়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধে, তাঁকে কি ফাঁসি দেওয়া সম্ভব? কিন্তু জিয়ার পক্ষে তখন কোন ভাবেই তাহেরকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না। আর এই কারণেই যেখানে তাহেরের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ প্রমাণিত হলে যার সর্বাধিক শাস্তি হতে পারত ১০ বছরের কারাদণ্ড, সেখানে রায় ঘোষিত হয় মৃত্যু দণ্ডাদেশ। তাহেরের ফাঁসী কার্যকর করার ১০ দিন পর এই জিয়াউর রহমান, সামরিক আইন সংশোধন করে সর্বাধিক শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড যোগ করেন। তাঁর ডেথ ওয়ারেন্ট ইস্যু করার মাত্র ৩ দিনের মাথায় ফাঁসি কার্যকর করা হয়। অথচ জেল কোড অনুযায়ী ডেথ ওয়ারেন্ট ইস্যুর ২১ দিন আগে বা ২৮ দিন পরে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিধান নাই। তবুও তড়িঘড়ি করে ফাঁসীর রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে জীবন দাতা তাহেরের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার এমন নজির স্থাপন করলেন জিয়া, তার তুলনা হতে পারে একমাত্র পলাশীর আম্রকাননে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার সাথে! তাহেরকে ফাঁসীতে ঝুলিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করার মধ্য দিয়ে বাংলার ইতিহাসের দ্বিতীয় মীরজাফর হিসেবে লেখা হয় যায় জেনারেল জিয়ার নাম।

ফ্লাস ব্যাক ০৭ নভেম্বর ১৯৭৫ : বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মহা গুরুত্বপূর্ণ দিন ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর। সেদিন সংঘটিত হয়েছিল সিপাহী-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত গণ অভ্যুত্থানের। আর এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের এগারো নম্বর সেক্টর কম্যান্ডার, শহীদ কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম। দেশের এক ক্রান্তিলগ্নে তিনিই এ অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং তিনিই বন্দিদশা থেকে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেছিলেন, সেই সঙ্গে জিয়াকে ক্ষমতায়ও বসিয়েছিলেন সিপাহী-জনতার স্বার্থরক্ষার শর্তে। কিন্তু তারপরের ইতিহাস এক নজিরবিহীন বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এবং ক্ষমতার কেন্দ্রে খন্দকার মোশতাক আর খালেদ মোশাররফ তখন নাগর দোলায়। একজন উঠছেন, একজন নামছেন। কিন্তু তারা কেউ জানেন না ঠিক সেই সময়টিতেই তাদের ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে, শহরের অন্য এক প্রান্তে। আবু ইউসুফের এলিফ্যন্ট রোডের ৩৩৬ নম্বর বাসাটি তখন সরগরম। জাসদের তরুনকর্মীরা ছাড়াও ইউসুফ এবং মাহমুদের বাসা জুড়ে সেনাবাহিনী থেকে চলে আসা অসংখ্য হাবিলদার, সুবেদার, কর্পোরাল, সার্জেন্ট ওয়ারেন্ট। এরা সবাই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্য। দফায় দফায় মিটিং হচ্ছে। তারা বিদ্রোহ করতে চান। কেউ খালেদ মোশাররফকে উৎখাত করতে চান। কেউ চান খালেদ, জিয়াসহ সব অফিসারদের হত্যা করতে। তাহের তাদের লাগামহীন উত্তেজনার রাশ টেনে ধরেন। তাদের বোঝান হত্যা বিপ্লব নয়। তাহের শুধু সৈনিক সংস্থা নয়, জাসদের সামগ্রিক অবস্থাটিও বিবেচনা করেন। ৪ নভেম্বর থেকে আবু ইউসুফ এবং এ বি এম মহমুদের বাসায় শুরু হয় জসদের নেতৃবৃন্দের লাগাতার মিটিং। আসেন সিরাজুল আলম খান, ড. আখলাকুর রহমান, হাসানুল হক ইনু, আ ফ ম মাহবুবুল হক, খায়ের এজাজ মাসউদ, কাজী আরেফ প্রমুখেরা। আসেন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতা হাবিলদার হাই, কর্পোরাল আলতাফ, নায়েব সুবেদার মাহবুব, জালাল, সিদ্দিক প্রমুখেরা। দেশের অন্যতম প্রধান এই দল যারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার তুমুল দাবি নিয়ে তোলপাড় তুলেছে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে, তারা একবার দিকভ্রান্ত হয়েছেন শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের কারণে, বাধাগ্রস্ত হয়েছে তাদের যাত্রা। দ্বিতীয়বারের মতো রাজনীতির গতিপথ বদলে দেবার জন্য আবির্ভূত হয়েছেন খালেদ মোশাররফ । এবার জাসদ তার সম্পূর্ণ শক্তি নিয়ে মোকাবেলা করতে চায় এ পরিস্থিতি। আর জাসদের প্রধান শক্তি তখন গণবাহিনী এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। দুটি অঙ্গসংগঠনেরই কমান্ডার ইন চিফ তাহের। তাঁরা বলেন, চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠার নামে খালেদ মোশাররফ তার সেনাপ্রধান হওয়ার ইচ্ছাই চরিতার্থ করেছেন শুধু। তাছাড়া বিনা বিচারে শেখ মুজিবের খুনিদের দেশত্যাগের সুযোগ দিয়ে বিরাট অন্যায় করেছেন তিনি। ক্যান্টনমেন্টে সিপাইরা মারাত্মকভাবে এজিটেটেড হয়ে যাচ্ছে। তারা খুব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে যে, তাদের ইউজ করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই এই এক্সপ্লয়টেশন চলছে। সিপাইরা এর একটা শেষ দেখতে চায়। তাহের বুঝতে পারেন এ মুহূর্তে জাসদের পক্ষে এরকম একটা পরিস্থিতিতে নেতৃত্ব দেবার মতো অবস্থা নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে জাসদ নিষ্ক্রিয় থাকলেও অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে আর্মিতে একটা বিদ্রোহ ঘটবেই। এই বিদ্রোহকে যদি জাসদ নিজেদের পক্ষে আনতে না পারে তাহলে নিশ্চিত যে এর ফল ভোগ করবে শত্রুপক্ষের কেউ।

তাহের জাসদ নেতাকর্মীদের বলেন, আমি সিপাইদের নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট দখল করে নিতে পারব এবং সেখান থেকে অস্ত্র বের করে আনতে পারব বাইরে। আর বাইরে যদি পিপল রেডি থাকে তাহলে এটি একটি জয়েন্ট আপরাইজিং হতে পারে। জাসদের নেতৃবৃন্দ খানিকটা দ্বিধান্বিত থাকলেও তাহেরের আত্মপ্রত্যয় প্রভাবিত করে তাদের। দীর্ঘ আলোচনার পর অবশেষে একটি অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয় এই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেবে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা, এরপর জাসদ তার গণবাহিনী এবং অন্যান্য সংগঠনসহ ছাত্র, শ্রমিক জনতাকে এই বিপ্লবে শামিল করবে। এটি হবে সিপাই জনতার বিপ্লব।এই অপারেশনের নেতৃত্ব দেবেন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সুপ্রিম কমান্ডার কর্নেল তাহের। সিদ্ধান্ত হয় পরদিন অর্থাৎ ৫ নভেম্বর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার পক্ষ থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে একটি লিফলেট বিলি করা হবে। এর মাধ্যমে অন্যান্য সিপাই এবং অফিসারদের আসন্ন বিপ্লবী উদ্যোগের ব্যাপারে অভিহিত করা হবে। গোপনে বিপ্লবের সিদ্ধান্ত যখন চূড়ান্ত হয়ে গেছে খালেদ মোশাররফ তখনও তার সেনাবাহিনী প্রধানের পদ নিয়ে দেন দরবার করছেন মোশতাকের সঙ্গে।

এদিকে একই সময়ে ০৩ নভেম্বর থেকে নিজ গৃহে বন্দি হয়ে আছেন জিয়া। ক্যান্টনমেন্ট জুড়ে চাপা উত্তেজনা। তাহের তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইনু এবং আনোয়ারকে বলেন, মনে রেখো বিপ্লবটা কিন্তু সিপাইদের, আমরা শুধু ফেসিলিটেইট করব। লিফলেটের ড্রাফট তারা করুক পরে আমরা দেখবো।সিপাই অফিসার সবাইকে প্রিপেয়ার করা দরকার। লিফলেটে সিপাইরা তাদের আক্রোশ আর ইচ্ছার কথা লেখেন, ‘‘সৈনিক ভাইয়েরা, আমরা আর ধনিক শ্রেণীর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে চাই না। নিগৃহীত, অধিকার বঞ্চিত সিপাইরা আর কামানের খোরাক হবে না। আসুন আমরা একটা অভ্যুত্থান ঘটাই। আমাদের এই অভ্যুত্থান শুধুমাত্র নেতৃত্বের পরিবর্তন করিবার জন্য হইবে না বরং এই অভ্যুত্থান হইবে সমাজের দরিদ্র শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার জন্য। এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা ঔপনিবেশিক আমলের রীতিনীতি বদলাইয়া ফেলিয়া সশস্ত্র বাহিনীকে জনগণের স্বার্থরাক্ষাকারী একটি বাহিনীতে পরিণত করিব।”

লিফলেটের কারণে সিপাইদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে সে খবর খালেদ মোশাররফ পান। এই উত্তেজনা প্রশমনের ব্যবস্থা হিসেবে খালেদ মোশাররফ বিভিন্ন রেজিমেন্টের সিপাইদের ঢাকা থেকে অন্যান্য ক্যান্টনমেন্টে বদলি করতে শুরু করেন। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতাদের খুঁজে বন্দি করবার নির্দেশ দেন তিনি। সিপাইরা তাহেরকে জানান, প্রতিটি মুহূর্ত এখন গুরুত্বপূর্ণ, আগামীকালের মধ্যে কিছু ঘটাতে না পারলে খালেদ মোশাররফ বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতাদের বন্দি করবেন, বাকিদের বদলি করে দেবেন ঢাকার বাইরে। তখন আর করার থাকবে না কিছুই। সিপাইরা বলেন অভ্যুত্থান ঘটাতে হলে, ঘটাতে হবে আজই। আশ্চর্য কাকতালীয় ব্যাপারই ঘটে। লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার চূড়ান্ত বিপ্লবটি ঘটেছিল ৭ নভেম্বরেই। লেনিনও এমন এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষণে পৌঁছেছিলেন। স্রোতের তোড়ের মধ্যে তারা তখন সবাই। তাহের বলেন – ‘‘এমন একটা ব্যবস্থা করতে হবে যাতে আমরা ক্ষমতার কেন্দ্রে না থেকেও পরিস্থিতিকে কন্ট্রোল করতে পারব। সেজন্য এই মধ্যবর্তী সময়ে সিপাই এবং জনগণ সমর্থন করবে এমন একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে ক্ষমতায় বসিয়ে জাতীয় সংহতি রক্ষা করা দরকার, তাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের নিজেদের অবস্থা অনুকূলে এনে তারপর আমরা পাওয়ার নিতে পারি।” পার্টি সদস্যরা জানতে চান, তাহের কার কথা ভাবছেন? তাহের বলেন , আমি জেনারেল জিয়ার কথা ভাবছি। আপনাদের আগেই জানিয়েছি যিনি আমাকে ইতোমধ্যে তাকে মুক্ত করার জন্য রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছেন। দুই তারিখ রাতে ফোন ছাড়া পরেও এক সুবেদারের মাধ্যমে আমাকে এস ও এস মেসেজ পাঠিয়েছেন। এ মুহূর্তে উনিই সবচেয়ে এক্সেপ্টেবল হবেন। ন্যাশনালিস্ট, সৎ অফিসার হিসেবে আর্মিতে তার একটা ইমেজ আছে। জাসদের একটিভিটিজের ব্যাপারে উনি বেশ ভালোমতোই জানেন এবং এ ব্যাপারে সবসময় একটা নীরব সমর্থন তার আছে। জাসদকর্মী কাজী আরেফ বলেন, কিন্তু জিয়া আমাদের পক্ষে থাকবেন সেটা আপনি কতটা নিশ্চিত? তাহের বলেন, এ মুহূর্তে জিয়ার অবস্থাটা চিন্তা করে দেখেন। তার তো ভবিষ্যৎ বলতে কিছু নেই। তিনি ইতোমধ্যে আর্মি থেকে রিজাইন করেছেন। বসে আছেন বন্দি হয়ে। তাকে মেরেও ফেলতে পারে যে কোন সময়। আমরা তাকে মুক্ত করতে পারলে তাকে একরকম মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা করা হবে। এ পর্যায়ে আলাপ ওঠে অভ্যুত্থান যদি সফল হয়, বিজয়ী সিপাই জনতা কার নামে স্লোগান দেবে। অনেকেই বলেন, অবশ্যই তাহেরের নামে। কিন্তু তাহের আপত্তি করেন। বলেন, ক্যান্টনমেন্টে আমার নামে স্লোগান হলে একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে। আমি আর্মি থেকে রিটায়ার্ড একজন মানুষ তাছাড়া সাধারণ মানুষও জাসদের সঙ্গে আমার সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে জানে না। জাসদের কোন পাবলিক ফিগারের নামেই স্লোগান হওয়া উচিত। কিন্তু জনগণের কাছে পরিচিত জাসদ নেতা জলিল, রব, শাহজাহান সিরাজ তখন কারাগারে। সে ক্ষেত্রে জিয়ার নামে স্লোগান হলেই ভালো। উনি আর্মির লোক, তাকে আমরা মুক্ত করছি তাছাড়া সাধারণ মানুষের কাছেও তার একটা পরিচিতি আছে। ইতোমধ্যে তার জীবনরক্ষার বার্তা পাঠিয়ে তিনি ক্ষীণ আশা নিয়ে অপেক্ষা করছেন হয়তো তাহের তাকে উদ্ধার করবেন কখনো। খানিকটা বিহ্বল তাহের। আবার নিজেকেই প্রশ্ন করেন তিনি এমন একটি ঘটনার জন্যই কি নিজেকে প্রস্তুত করছেন না সারাটা জীবন? ঠাণ্ডা মাথায় পুরো অভ্যুত্থানের ছকটি তৈরি করতে বসেন তাহের। আর দশটি রাতের মতোই আরও একটি রাত নামে ঢাকা শহরে।

আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, ঘড়ির কাঁটা মধ্য রাত পেরোয়, সেদিন ৭ই নভেম্বর। জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করবার দায়িত্ব ছিল হাবিলদার হাইয়ের। তিনি ২০/৩০ জন সিপাই নিয়ে জিয়ার বাসভবনে যান। তারা স্লোগান দিতে দিতে আসেন ’কর্নেল তাহের লাল সালাম, জেনারেল জিয়া লাল সালাম’। গভীর রাতে টেলিফোনের মাধ্যমে নিজের জীবন রক্ষার অনুরোধের প্রেক্ষিতে তাহের যে বাস্তবিকই তাকে মুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছেন তা দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠেন জেনারেল জিয়া। হাই জিয়াকে বলেন, কর্নেল তাহের এলিফ্যন্ট রোডে তার ভাইয়ের বাড়ীতে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন। খানিকটা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন জিয়া।উঠে পড়েন সৈনিকদের আনা গাড়িতে। এসময় মাঝপথে ফারুক, রশিদের এক সহযোগী মেজর মহিউদ্দীন এসে জিয়াকে বহনকারী গাড়িটিকে থামান। জিয়াকে টু ফিল্ড আর্টিলারিতে নিয়ে যাবার ব্যাপারে মেজর মহিউদ্দীন খুব তৎপর হয়ে উঠেন। সিপাইরা খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। জিয়া টু ফিল্ড আর্টিলারিতে গিয়ে আত্মবিশ্বাস ফিরে পান। জিয়া ততক্ষণে ধাতস্থ হয়েছেন তার মুক্ত অবস্থার সাথে। তিনিও আর ক্যান্টনমেন্টের বাইরের কোন অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে নিজেকে নিয়ে যেতে চাইলেন না। জিয়া বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের বলেন, তোমরা বরং কর্নেল তাহেরকে এখানে নিয়ে আস। বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার লোকেরা। তাহের এই খবর পেয়ে ইনুকে বলেন, এরা একটা রিয়েল ব্লান্ডার করে ফেলল। আমি চেয়েছিলাম আমাদের বিপ্লবের কেন্দ্রটাকে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে নিয়ে আসতে।

তাহের টু ফিল্ড আর্টিলারিতে পৌঁছালে জিয়া এগিয়ে এসে তাহেরের সঙ্গে কোলাকুলি করেন।জিয়া তাহেরকে বলেন, ‘‘তাহের ইউ সেভড মাই লাইফ,থ্যাঙ্ক ইউ। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।” তাহের বলেন, আমি কিছুই করিনি, করেছে এই সিপাইরা। অল ক্রেডিট গোজ টু দেম। জিয়া বলেন, ‘‘লেট মি নো হোয়াট নিডস টু বি ডান। তোমরা যেভাবে বলবে সেভাবেই সবকিছু হবে।”

এরপর তাহের বসেন জিয়ার সঙ্গে আলাপে। কিভাবে তারা এই বিপ্লবটি সংগঠিত করেছেন তা জিয়াকে বিস্তারিত জানান।তাহের বলেন, একটা ব্যাপার আমাদের ক্লিয়ার থাকতে হবে যে পুরো বিপ্লবটা করেছে সিপাইরা, এখানে কোন একক পাওয়ার টেক ওভারের ব্যাপার নাই। আমরা এই মুহূর্তে জাসদের সরকার গঠন করতে চাচ্ছি না, আমরা জাতীয় সরকার করতে চাই। খুব তাড়াতাড়ি একটা সাধারণ নির্বাচন দরকার, রাজবন্দীদের মুক্তি দেয়া দরকার, সৈনিকদের দাবিদাওয়া গুলো নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন। আপনি এখানে একটা ক্রুশিয়াল রোল প্লে করবেন। আগামীকাল আমাদের প্রথম কাজ হবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটা সমাবেশ করা। সমাবেশে আমি এবং আপনি বক্তৃতা দেব। বক্তৃতার মাধ্যমে জনগণকে অভ্যুত্থানের ব্যাপারে স্পষ্ট ধারনা দিতে হবে। এতক্ষণ চুপচাপ শুনলেও বক্তৃতার কথা শুনতেই জিয়া বেঁকে বসে। তাহের বলেন, দেশ একটা সংকট এবং বিভ্রান্তির মধ্যে আছে এ মুহূর্তে জনগণকে সুসংহত করা জরুরি। তাহলে কিন্তু আপনি আপনার কমিটমেন্ট ভঙ্গ করছেন। আপনি বলেছেন আমরা যেভাবে বলব আপনি সেভাবে কাজ করবেন। জিয়া সরাসরি বলেন, কিন্তু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আমি যাবো না। গাড়িতে ফিরতে ফিরতে ইনু বলেন, জিয়া তো কোন কথা রাখবেন বলে মনে হচ্ছে না। তাহের ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, আমি আগেই বলেছিলাম জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে আনতে না পারাটা একটা ব্লান্ডার হয়েছে। বিপ্লবের পুরো সেন্টারটা যাতে বাইরে থাকে সেজন্য আমি অভ্যুত্থানের সময় ক্যান্টনমেন্টে গেলাম না। আমি চাচ্ছিলাম অভ্যুত্থানটার একটা সিভিল ডাইমেনশান তৈরি করতে। রেডিওতেও যেতে অস্বীকৃতি জানালে পরে ক্যান্টনমেন্টেই রেকর্ড করা জিয়ার একটি বক্তৃতা প্রচার করা হয়েছে রেডিওতে। সেখানে জিয়া নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা করেছেন। সিপাইদের অভ্যুত্থানের কথা বললেও বক্তৃতায় জিয়া কোথাও অভ্যুত্থানের পেছনে জাসদ কিম্বা কর্নেল তাহেরের কথা উল্লেখ করেননি। মূলত সেই ভাষণ থেকেই শুরু হয় জিয়ার বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস। এমন বিশ্বাসঘাতকতার তুলনা হতে পারে শুধুমাত্র পলাশীর আম্রকাননে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদদৌলার সাথে মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার সাথে। মূলত তখন থেকেই ইতিহাসের পাতায় বাংলার দ্বিতীয় মীরজাফর হিসেবে জিয়ার নাম লেখার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেলো । (পরের পর্বে সমাপ্ত)

লেখক : গণমাধ্যম কর্মী ও সাবেক ছাত্রনেতা।

মন্তব্য করুন


 

Link copied