আর্কাইভ  শুক্রবার ● ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ● ৬ বৈশাখ ১৪৩১
আর্কাইভ   শুক্রবার ● ১৯ এপ্রিল ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: পলাশবাড়ীতে আসামির ছুরিকাঘাতে বাদীর মৃত্যু, গ্রেফতার ১       মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সন্তান-স্বজনের ভোটে না দাঁড়ানোর নির্দেশ       ভোজ্যতেলের দাম বাড়ল, খোলা তেলে সুখবর       বিএনপি নেতা সোহেলের নিঃশর্ত মুক্তি দাবিতে রংপুরে  মানববন্ধন ও সমাবেশ        খরার ঝুঁকিতে রংপুর অঞ্চল      

 width=
 

কর্নেল তাহের হত্যাকাণ্ড ও ৭ নভেম্বরের ‘সিপাহী-জনতার গণঅভ্যুত্থান’ (শেষ পর্ব)

মঙ্গলবার, ২২ জুলাই ২০১৪, রাত ১০:২১

শাহ্‌ রিয়াদ আনোয়ার শুভ :

উপমহাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় এই সিপাই অভ্যুত্থান ঘটবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেটিকে বানচাল করে দেবার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে দুটি শক্তি, একদিকে জেনারেল জিয়া, আরেক দিকে খন্দকার মোশতাক। তাহেরকে না জানিয়ে গোপনে ক্যান্টনমেন্টে মিটিং করেন মেজর জেনারেল জিয়া, মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান, এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াব, রিয়ার এডমিরাল এক এইচ খান, জেনারেল ওসমানী, মাহবুবুল আলম চাষী। হঠাৎ মিটিং এ তাহের উপস্থিত হলে মাহবুবুল আলম চাষী বলেন, “উই হ্যাভ ডিসাইডেড টু কন্টিনিউ দি গভর্নমেন্ট উইথ মোশতাক এজ দি প্রেসিডেন্ট।” তাহের বলেন, “উই ক্যান নট এলাউ দিস নুইসেন্স টু গো অন ফর এভার।” জেনারেল ওসমানী তাহেরের চিন্তাভাবনা জানতে চাইলে তাহের বলেন, “প্রথমত আমাদের একটা বিপ্লবী পরিষদ করতে হবে, গঠন করতে হবে সর্বদলীয় জাতীয় সরকার। সে সরকারের কাজ হবে যত দ্রুত সম্ভব একটা ফ্রি এন্ড ফেয়ার ইলেকশন দেওয়া।” এরপর তাহের তাদের সমর্থন করে বলেন, “জাস্টিস সায়েম আপাতত হেড অফ দি স্টেট থাকতে পারেন। জেনারেল জিয়া আর্মি চিফ থাকবেন।” সিপাইদের মুখোমুখি হলে তাহের জিয়াকে বলেন, “আপনি জোয়ানদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।” জিয়া খুব সংক্ষেপে বলেন, “আমি রাজনীতি বুঝি না। ধৈর্য ধরেন। নিজের ইউনিটের শৃঙ্খলা বজাই রাখেন। আপনাদের দাবিগুলো লিখিত দেন।” এলিফ্যন্ট রোদে উপস্থিত সৈনিকরা খানিকটা উদভ্রান্ত , ক্ষুব্ধ, বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন তখন। তাহের তাদের বলেন, “যেহেতু তোমাদেরই দাবি এগুলো, দাবীনামটা তোমরাই তৈরি কর।”

রাত পোহায়। সৈনিকরা খোঁজ পেয়েছেন তাদের যে বারো দফা পত্রিকা রেডিওতে প্রচারিত হবার কথা ছিল তা বন্ধ করে দিয়েছেন জেনারেল জিয়া। এ ঘটনায় আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠে ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানকারী বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্য, গণবাহিনীর সদস্যরা আওয়াজ তোলেন যে জেনারেল জিয়া ১২ দফা মানবার কথা দিয়ে কথা রাখেন নি, ওয়াদা খেলাপ করেছেন, প্রতারণা করেছেন তাদের সঙ্গে। অবশেষে তাহের সব বুঝতে পেরে বলেন, “এটা স্পষ্ট যে মূলত দুটো কারণে হাতের মুঠোয় সাফল্য পেয়েও আমরা তা ধরে রাখতে পারি নি। প্রথমত জিয়াউর রহমানের বিশ্বাসঘাতকতা, দ্বিতীয়ত আমাদের গনজামায়েত করার ব্যর্থতা। আমাদের বিপ্লবের মিলিটারি ডাইমেনশনটা সাকসেসফুল হলেও সিভিল ডাইমেনশনে আমরা ফেইল করে গেছি।”

কর্নেল তাহেরের ফাঁসি : তাহের জাসদ নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করে আরেকটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। সিদ্ধান্ত নেন এবার জিয়াকে উৎখাত করবেন। জিয়ার বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ নেবেন তারা। জিয়া তার বিপদ আঁচ করতে থাকেন, জানেন তাহের সহজে হাল ছাড়বেন না। তিনি জাসদ এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাকে দমন করতে কঠোর ব্যবস্থা নিতে শুরু করেন। শুরু হয় ব্যাপক গ্রেফতার। গ্রেফতার করা হয় হাজার হাজার জাসদের গণবাহিনী কর্মী। সিদ্ধান্ত হয় ২৪ নভেম্বর সৈনিক সংস্থার বিভিন্ন ইউনিট সংগঠকদের প্রতিনিধিত্বমূলক সভা হবে। কিন্তু তার আগেই জাসদ নেতা মেজর (অব.) এমএ জলিল, আসম আব্দুর রব, হাসানুল হক ইনু, আবু ইউসুফ খান বীর বিক্রম, কেবিএম মাহমুদসহ বেশ কয়েকজন নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে জাসদের সঙ্গে আলোচনার দরজা বন্ধ করে দেন জিয়া। পরদিন ২৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সলিমুল্লাহ হলের হাউস টিউটরের বাসা থেকে গ্রেফতার করে কর্নেল আবু তাহেরকে সরাসরি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করা হয়। একে একে তাঁর অন্যান্য ভাইরাও গ্রেফতার হয়ে নিক্ষিপ্ত হন কারাগারে। কিছুদিন পর বন্দি জাসদ নেতাদের একেকজনকে একেক জেলে স্থানান্তর করা হয়। হেলিকপ্টারে করে তাহেরকে পাঠানো হয় রাজশাহী জেলে। একটার পর একটা লক্ষ্য ডিঙ্গিয়ে তাহের ছুটে চলেছিলেন তার চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে। কিন্তু এই জেল জীবন যেন হঠাৎ স্তব্ধ করে দেয় তাকে।

১৯৭৬-এর জুনে দেশের নানা জেলে ছড়িয়ে থাকা জাসদ এবং সৈনিক সংস্থার বন্দিদের একে একে আবার আনা হয় ঢাকার সেন্ট্রাল জেলে। এসময় পত্রিকায় খবর বেরোয়, বিশেষ সামরিক আইন ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে এবং এই ট্রাইব্যুনালকে সাধারণ আইনের বিরুদ্ধে অপরাধ, সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে অপরাধ, সামরিক আইনের বিরুদ্ধ অপরাধ সব ক্ষেত্রেরই বিচারের এক্তিয়ার দেওয়া হয়েছে। বিশেষ সামরিক আইন ট্রাইব্যুনালের প্রধান নিয়োগে জটিলতা দেখা দেয় কারণ কোনো মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসার এই ট্রাইব্যুনালের প্রধান হতে অস্বীকৃতি জানান। শেষে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান করা হয় কর্নেল ইউসুফ হায়দারকে। যিনি বাঙালী হলেও মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হয়ে চাকরী করেছেন। জারি করা অধ্যাদেশে বলা হয়, এই ট্রাইব্যুনাল যে রায় দেবে তার বিরুদ্ধে কোনো রকম আপিল করা চলবে না। বলা হয়, বিচার চলবে রুদ্ধদ্বার কক্ষে এবং বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

জেলের ভিতরে সেনাবাহিনীর সশস্ত্র সদস্য থাকবার কোনো নিয়ম না থাকলেও জেলখানার গেটে, আশপাশের বাড়ির ছাদে এমনকি জেলের ভিতরেও ভারী মেশিনগান নিয়ে পাহারায় বসে সিপাইরা। সামরিক, বেসামরিক মিলেয়ে মোট বত্রিশ জন অভিযুক্ত। অভিযুক্তরা তখনও স্পষ্টভাবে জানেন না কি অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে। প্রথম দিন অভিযোগ উত্থাপনের পর মামলা মুলতবী রাখা হয় আট দিন। যদিও সরকার কয়েক মাস ধরে এ মামলা সাজিয়েছে, কিন্তু আসামিদের মামলার কাগজপত্র সাজানো এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সময় দেওয়া হয় এই আট দিনই। বিদেশী এক সাংবাদিক লিফশুলৎজ কারাগারে এই গোপন বিচারের কিছু ছবি তুলতে গেলে তাঁকে প্রথমে কিছুদিন নজরবন্দি করে রাখার পর দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়।

মামলা শুরু হলে আইনজীবীরা ট্রাইব্যুনালের অভিযোগ গুলো খণ্ডন করতে শুরু করেন। আসামিদের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ বৈধ সরকারকে উৎখাতের অপচেষ্টা। আসামিরা প্রশ্ন তোলেন, ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর থেকে ৭ই নভেম্বর পর্যন্ত দেশে কি কার্যত কোন সরকার ছিল? যদি থাকে তাহলে কে ছিলেন সেই সরকার প্রধান? দেশের প্রেসিডেন্ট তখন বিচারপতি সায়েম, যাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন খালেদ মোশাররফ । জেনারেল জিয়া এবং কর্নেল তাহের উভয়েই সিপাই অভ্যুত্থানের পর বিচারপতি সায়েমকেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে বহাল রাখলেন। তাহলে উৎখাত হলো কে?

দ্বিতীয় অভিযোগ করা হয়েছে সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির। অভিযুক্তদের আইনজীবী আদালতকে স্মরণ করিয়ে দেন,  “ভুলে যাবেন না তাহেরের নেতৃত্বে ৭ই নভেম্বর অভ্যুত্থানের মাধ্যমেই বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়েছিলেন জেনারেল জিয়া এবং জিয়াই তাহেরকে এই রকম একটি উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করেছিলেন। এই অভ্যুত্থানের, তথাকথিত বিশৃঙ্খলার সম্পূর্ণ বেনিফিসিয়ারী জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল জিয়াই এই দিনটিকে ঘোষণা করেছেন সংহতি দিবস হিসেবে। বলেছেন এই দিনে সেনাবাহিনী এবং জনগণ দেশের সার্বভৌমত্ব সংহত করেছে।” তাহলে প্রশ্ন জাগে একই দিনে বিশৃঙ্খলা আর সংহতি হয় কি করে? এ বড় অদ্ভুত, অসাড় অভিযোগ। এটি যে নেহাত একটি প্রহসনের বিচার আসামীদের তা আর বুঝতে বাকি থাকে না। তাহের এক পর্যায়ে ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, “মামলা যদি করতেই চান, তাহলে আমি জেনারেল জিয়া আর জেনারেল ওসমানীকে এই আদালতে দেখতে চাই। তারাই সাক্ষী দিক ঘটনার। তারা এসে দাঁড়াক আমাদের মুখোমুখি।”

কিন্তু সেসব কিছুই করা হয় না। আসামী পক্ষকে কোন সুযোগই না দিয়ে ১৭ই জুলাই শনিবার তিনটার সময় মামলার রায় ঘোষণা করা হয়।সিরাজুল আলম খানকে ৭ বছর, আসম রব, হাসানুল হক ইনু, আনোয়ার হোসেনকে ১০ বছর এবং মেজর জিয়াউদ্দীনকে ১২ বছর সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। জলিল এবং ইউসুফের ব্যাপারে নির্ধারিত শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য মৃত্যুদণ্ড থেকে অব্যহতি দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। সালেহা, রবিউলের ৫ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড ও ৫ হাজার টাকা জরিমানা। অন্যান্যদের বিভিন্ন মেয়াদী কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ডঃ আখলাক, সাংবাদিক মাহমুদ ও মান্নাসহ তেরো জনকে বেকসুর খালাস।

একে একে সবারই রায় ঘোষণা করা হলে বাকি থাকে শুধু একজনের রায়। তিনিই কর্নেল তাহের। আদালতে তখন পিনপতন নিস্তব্ধতা। স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের জন্য সর্বোচ্চ বীর উত্তম খেতাবধারী, পঙ্গু এই মানুষটির জন্য কি শাস্তি নির্দিষ্ট করা আছে? বিচারক ঘোষণা করলেন, অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আবু তাহেরকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো এবং তা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কার্যকর করা হবে। বিচারকের গলা খানিকটা কাঁপল যেন। তাহেরের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে বেত্রাহত কুকুরের মত তাড়াহুড়া করে বিচার কক্ষ পরিত্যাগ করলেন বিচারক। স্তম্ভিত হয়ে পড়লেন সবাই। হঠাৎ সাংবাদিক মাহমুদ সাহেব কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। মেজর জিয়াউদ্দীন শুরু করেন সদ্য লেখা তার কবিতাটির আবৃত্তি –“জন্মেছি, সারা দেশটাকে কাঁপিয়ে তুলতে, কাঁপিয়ে গেলাম………”। তাহের বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠে বলেন, দারুণ হয়েছে তোমার কবিতা, কবিতাটা দাও আমাকে।

কনডেম সেলে বসে বসে ভাইদের সাথে আলাপচারিতায় তাহেরের সেই স্বপ্নের বাংলাদেশের কথা আসে। তাহের এমন একটা বাংলাদেশের কল্পনা করেছিলেন যার নদীর দুপাশে উঁচু বাঁধ, সে বাঁধের উপর দিয়ে চলে যাবে সোজা পাকা রাস্তা, চলে যাবে রেললাইন, ইলেক্ট্রিসিটি, গ্যাস, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ লাইন। বাঁধের দুপাশে ছড়ানো গ্রাম। সুন্দর নকশার প্রতিটি বাড়ির সামনে একটা সবুজ ঘাসে ঢাকা বাগান, সেখানে ফুল। একদিকে খোলা মাঠ। বিকেল বেলা বুড়োরা এই মাঠের চারপাশে বসে গল্প করবে। ছেলে মেয়েরা মেতে উঠবে নানা খেলায়। তাহেরের স্বপ্নের বাংলাদের প্রসঙ্গে মূল প্রবন্ধ সোনার বাংলা গড়তে হলে : কর্ণেল তাহের রচানবলী এখানে পড়তে পারেন।

রায় ঘোষণা করা হয় হয় ১৭ জুলাই। এর মাত্র চার দিনের মাথায় সকল নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে ২১ জুলাই ভোরে তাহের ফাঁসী কার্যকর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এদিকে পুরো জেলে খবর পৌঁছে গেছে যে আজ রাতে তাহেরের ফাঁসি। সেদিন কেউ আর রাতের খাবার স্পর্শ করেন নি। ফাঁসির মঞ্চে মহড়া হচ্ছে। শেষবারের মতো পরীক্ষা করা হচ্ছে নির্ধারিত দড়ি, যম টুপি। ঢাকা জেলের কোন জল্লাদ রাজি হননি তাহেরের ফাঁসিতে যোগ দিতে। জল্লাদ আনা হয়েছে অন্য এক জেল থেকে।

বিশ তারিখ সন্ধ্যায় তাহেরকে জানিয়ে দেয়া হয় যে পরদিন ভোর চারটায় তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে। তিনি শান্তভাবে এই খবর গ্রহন করেন ও যাদের উপর এই খবর দেয়ার দায়িত্ব পড়েছিল তাদের ধন্যবাদ জানান। এরপর সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থায় রাত্রির খাবার খেয়ে নেন। পরে একজন মেৌলভী এসে তাঁর কৃত অপরাধের জন্য তাহেরকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে অনুরোধ জানান। তিনি তখন বলে উঠেন, “আপনাদের সমাজের কালিমা আমাকে কখনও স্পর্শ করতে পারেনি। কখনো না। আমি সম্পূর্ণ শুদ্ধ। আপনি এখন যান, আমি এখন ঘুমাবো।” এরপর শান্তভাবে ঘুমাতে যান কর্নেল তাহের।

রাত তিনটার সময় প্রহরীরা সেলের কাছে গিয়ে দেখেন ফাঁসির আসামি তাহের গভীর ঘুমে মগ্ন। ঘুম থেকে উঠে তাহের জানতে চান কতক্ষণ সময় আছে। প্রহরীরা বলেন, এক ঘণ্টা। এরপর তাহের দাঁত মাজেন, শেভ করেন, গোসল করে নেন। তাহের একা তার কৃত্রিম পা’টি পড়েন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন কারা রক্ষীরা। তাদের সবার চোখ ভেজা। এরপর একটা ভালো স্ত্রী করা শার্ট গায়ে দেন। হাত ঘড়িটা পড়ে নেন, চুলগুলো ভালোভাবে আঁচড়ান। যেন প্রস্তুত হচ্ছেন কোথাও বেড়াতে যাবার জন্য। উপস্থিত সবাই তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। “আমার নিষ্পাপ শরীরে তোমাদের স্পর্শ লাগুক আমি তা চাই না”, এই বলে তাহের তাদরে নিবৃত করে। এরপর স্ত্রী লুৎফার দিয়ে যাওয়া আম খেয়ে নেন এবং সবশেষে চা, সিগারেট টানতে থাকেন। একজন মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত লোকের এরকম সাহস দেখে সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তাহের তখন সবাইকে সান্ত্বনা জানিয়ে বলেন, “আপনারা হাসুন, সবাই এত বিষণ্ণ কেন? একটু হাসেন। আমি তো দুর্দশাগ্রস্তদের মুখে হাসিই দেখতে চেয়েছিলাম। মৃত্যু আমাকে পরাজিত করতে পারবে না।” কারা কর্তৃপক্ষের একজন প্রতিনিধি তাহেরের কাছে জানতে চান তাঁর কোন শেষ ইচ্ছা আছে কি না? তাহের একটু থামেন। মুখে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে তার। তিনি বলেন, “ইচ্ছা তো একটাই। আমার মৃত্যুর বিনিময়ে এ দেশের সাধারণ মানুষের জীবনে শান্তি আসুক।”

এরপর তাহের জানতে চান আর কোন সময় বাকি আছে কি-না? অল্পকিছু সময় বাকি আছে জানার পর তিনি সবার সামনে একটা কবিতা আবৃত্তি করতে চান। অনুমতি দেয়া হয়। শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত জল্লাদ, জেলার, ডাক্তার আর কয়েকজন কারারক্ষীর সামনে তাহের পড়েন-

“জন্মেছি সারা দেশটাকে কাঁপিয়ে তুলতে, কাঁপিয়ে গেলাম। জন্মেছি তাদের বুকে পদচিহ্ন আঁকব বলে,  এঁকেই গেলাম। জন্মেছি মৃত্যুকে পরাজিত করব বলে, করেই গেলাম। জন্ম আর মৃত্যুর দুটো বিশাল পাথর রেখে গেলাম। সেই পাথরের নিচে শোষক আর শাসকের কবর দিলাম। পৃথিবী অবশেষে এবারের মতো বিদায় নিলাম।”

এরপর তাহের বলেন, “অলরাইট গো এহেড, ডু ইওর ডিউটি। আই এম রেডি।” তিনি নিজে ফাঁসির দড়ি তুলে নেন। যপটুপি পড়ানোর আগে তাহের বলেন, “বিদায় বাংলাদেশ। লং লিভ মাই কান্ট্রিম্যান, লং লিভ রেভ্যুলিউশন।” কিন্তু বোতাম টিপতে কেউই সামনে এগিয়ে এলো না। তাহের তখন এদের বিদ্রূপ করে বলে ওঠেন, “তোমাদের কি এই সাহসটুকুও নেই?” তখনি কেউ বোতাম টিপে দেয়, সব শেষ। স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের জন্য সর্বোচ্চ বীর উত্তম খেতাবধারী, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অবঃ) তাহের বীর উত্তম চলে যান ফিরে না আসার দেশে। ঘড়িতে তখন ২১ জুলাই ভোর ০৪ টা ০১ মিনিট।

লেখক : গণমাধ্যম কর্মী ও সাবেক ছাত্রনেতা।

মন্তব্য করুন


 

Link copied