আর্কাইভ  শনিবার ● ২০ এপ্রিল ২০২৪ ● ৭ বৈশাখ ১৪৩১
আর্কাইভ   শনিবার ● ২০ এপ্রিল ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: নীলফামারীতে গোপন বৈঠক থেকে জামায়াতের ৩ নেতা গ্রেপ্তার       পলাশবাড়ীতে আসামির ছুরিকাঘাতে বাদীর মৃত্যু, গ্রেফতার ১       মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সন্তান-স্বজনের ভোটে না দাঁড়ানোর নির্দেশ       ভোজ্যতেলের দাম বাড়ল, খোলা তেলে সুখবর       বিএনপি নেতা সোহেলের নিঃশর্ত মুক্তি দাবিতে রংপুরে  মানববন্ধন ও সমাবেশ       

 width=
 

উত্তরবাংলা ডটকমের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যমের অবদান

শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর ২০১৪, রাত ১২:০৯

আনওয়ারুল ইসলাম রাজু

১২ ডিসেম্মর ২০১৪ উত্তরবাংলা ডটকম সাফল্যের সাথে অগ্রযাত্রার দুই বছর পাড়ি দিয়ে তৃতীয় বছরে পদার্পন করতে যাচ্ছে। ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ রংপুর সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও হিরন্ময় ঐতিহ্যম-িত। বর্তমান বাংলাদেশ ভূখ-ে প্রথম বাংলা সংবাদপত্র ‘রঙ্গপুর বার্তাবহ’ ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল এই রংপুরের মাটিতেই। সে বিবেচনায় রংপুরকে সংবাদপত্রের সূতিকাগার বলা যেতে পারে। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার এই হিরন্ময় ঐতিহ্যের পথবেয়ে আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে রংপুর তথা উত্তরবাংলার মাটি ও মানুষের সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না, সমস্যা ও সম্ভাবনা, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সর্বোপরি এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার চেতনাকে তুলে ধরার লক্ষ্যে ২০১২ খ্রিস্টাব্দের মহান বিজয়ের মাসের ১২ তারিখে (১২ ডিসেম্বর) যাত্রা শুরু করে উত্তরবাংলা ডটকম অন লাইন নিউজ পোর্টাল। ‘দেশ মাটি ও মানুষের পক্ষে’ সময়োচিত এবং বস্তু ও তথ্যনিষ্ঠ সংবাদ, ফিচার ও অন্যান্য বিষয় পরিবেশনের মধ্যদিয়ে উত্তরবাংলা ডটকম মাত্র ২ বছরে দেশে ওবিদেশে ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা অর্জণ করেছে। সংবাদপত্র-তথা-সংবাদমাধ্যম হচ্ছে সমাজের দর্পণ। দেশ, জাতি ও সমাজের যে কোনো প্রয়োজনে সংবাদপত্র-তথা-সংবাদমাধ্যম সঠিক দিক-নির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে সমাজ ও জাতির পথ-প্রদর্শকের দায়িত্ব পালন করে। আমাদের জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে সংবাদপত্র ও সংবাদ মাধ্যমগুলো ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৫২এর মহান ভাষা আন্দোলনসহ বাঙালির অধিকার-স্বাধিকার আদায়ের সকল আন্দোলন সংগ্রাম এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশী বিদেশী বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ও সংবাদপত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলার মাটি থেকে পাকিস্তানী শাসন-শোষণের অবসান ঘটানোর জন্য ১৯৭১-এর উত্তাল মার্চে বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি প্রত্যয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। অপরদিকে, পাকিস্তানী সামরিক জান্তা বাঙালি জাতিকে চিরতরে ধ্বংস করে দেয়া হীন উদ্দেশ্যে ২৫ শে মার্চের কালরাতে বর্বরোচিত গণহত্যা ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠে। তারা ঐ রাতে বঙ্গবন্ধুকেও গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পূর্বে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণা দিয়ে যান। যার প্রেক্ষিতে শুরু হয় স্বাধীনতার জন্য বাঙালির সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। ২৫শে মার্চের রাতসহ নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিরিহ বেসামরিক বাঙালির উপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত হামালা, গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি স্বাধীনতার জন্য বাঙালির ন্যাসঙ্গত মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দেশী-বিদেশী গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বস্তুত মুক্তিযুদ্ধে অন্যতম সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে দেশী-বিদেশী গণমাধ্যম। ২৫শে মার্চের গণহত্যার চিত্র যাতে বিশ্ববাসী জানতে না পারে, সেজন্য পাকিস্তানী সামরিক শাসক ঐদিন মধ্যরাতে ঢাকায় অবস্থানরত সব বিদেশী সাংবাদিককে কৌশলে হোটেল শেরাটনে আটকে রেখে পরদিন উড়োজাহাজে করে তাদের নিজ নিজ দেশে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিংয়ের জন্য তাদের পরিকল্পনা সফল হয়নি। তিনিই কৌশলে হোটেলে লুকিয়ে ছিলেন এবং পরে ঢাকা শহর ঘুরে ধংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করে সর্বপ্রথম বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেন পাকিস্তানে গণহত্যা হয়েছে। পরবর্তীতে আরও অনেক বিদেশী সাংবাদিক পাকিস্তানী সেনাদের অত্যাচার ও ধ্বংসযজ্ঞের সংবাদ সংগ্রহ করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে দেন। ২৫ মার্চের গণহত্যার চিত্র যাতে বিশ্ববাসী জানতে না পারে, সেজন্য পাকবাহিনী বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিংয়ের জন্য তাদের পরিকল্পনা সফল হয়নি। তিনিই সর্বপ্রথম বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেন— পাকিস্তানে গণহত্যা হয়েছে। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান সরকার সব বিদেশী সাংবাদিককে কৌশলে হোটেল শেরাটনে (বর্তমান রূপসী বাংলা হোটেল) আটক করে ফেলে। পরদিন উড়োজাহাজে করে তাদের নিজ নিজ দেশে পাঠিয়ে দেয়। ফলে বিদেশী সাংবাদিকশূন্য হয়ে পড়ে ঢাকা। এরই মধ্যে একজন পালিয়ে থাকতে সক্ষম হন। তার নাম সাইমন ড্রিং। সামরিক শাসকের নির্দেশ অমান্য করে তিনি লুকিয়েছিলেন হোটেলে। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ উঠে গেলে হোটেলের কর্মচারীদের সহযোগিতায় একে একে ঘুরে দেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা। এসব স্থানে শুধু লাশ আর লাশ পড়ে থাকতে দেখেন। এসব দেখে তিনি লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় লিখেন, ‘ট্যাংকস ক্রাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’। এ সংবাদ ৩০ মার্চ ছাপা হওয়ার পর বিশ্ববাসী জানতে পারে,পাকিস্তানে কী হচ্ছে। এর আগে পাকিস্তান সরকার রেডিও-টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রচার চালাচ্ছিল যে ভারতীয় কিছু অনুচর পূর্ব পাকিস্তানে অনুপ্রবেশ করে নাশকতামূলক তত্পরতা চালাচ্ছে। সাইমন ড্রিংয়ের সংবাদের মাধ্যমে বিশ্ববাসী জানতে পারল, বাঙালিদের ওপর নির্যাতন চলছে। ১৯৭১ সালের প্রথম দিকে পাকিস্তানের বিভিন্ন সংবাদপত্রে আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর, শেখ মুজিবকে ইয়াহিয়া কর্তৃক পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী সম্বোধন এবং ভুট্টোর অগণতান্ত্রিক দাবি নিয়ে সংবাদ ও সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। এতে শাসকগোষ্ঠী ও পিপিপির আসল চেহারা উন্মোচন হলে সরকার প্রেস সেন্সরশিপ ও প্রেস অ্যাডভাইজ আরোপ করে। দেশীয় সংবাদপত্রগুলো পাকবাহিনীর রোষানলে পতিত হলেও হাতে লিখে পত্রিকা বের করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যচিত্র তুলে ধরে দেশবাসীকে উজ্জীবিত করে। এছাড়া, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র এবং মুক্তাঞ্চল থেকে প্রকাশিত বেশ কিছু সংবাদপত্রের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের খবরা-খবর তুলে ধরা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় উলে¬খযোগ্য পত্রিকা ছিল- দৈনিক জয় বাংলা ও দৈনিক বাংলাদেশ। সাপ্তাহিক পত্রপত্রিকার মধ্যে ছিল— দেশ বাংলা, দুর্জয় বাংলা, শাশ্বত বাংলা, সংগ্রামী বাংলা, মুক্ত বাংলা, নতুন বাংলা, স্বাধীন বাংলা, জাগ্রত বাংলা, সোনার বাংলা, সাপ্তাহিক বাংলা, বিপ¬বী বাংলাদেশ। এছাড়া আরো ছিল প্রতিনিধি, স্বদেশ, বঙ্গবাণী, বাংলার মুখ, স্বরাজ, হাতিয়ার, অভিযান, একতা, দাবানল, অগ্রদূত, রণাঙ্গণ, আমার দেশ, জন্মভূমি, বাংলার বাণী, বিপ¬বী, আন্দোলন, রাষ্ট্রদূত, সপ্তাহ, দ্য পিপল, দ্য নেশন, বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, কালান্তর, মায়ের ডাক প্রভৃতি। সে সময়ে প্রকাশিত একটি পত্রিকার সম্পাদক জানান, তখন পত্রিকা বের করা খুব কঠিন ছিল। বিশেষ করে পাক হানাদারদের নজরে এলে সর্বনাশ হতো। তাই লুকিয়ে লুকিয়ে পত্রিকা বের করতে হতো। তখন সাপ্তাহিকের পাশাপাশি কিছু পাক্ষিক পত্রিকাও বের হতো। এগুলোর মধ্যে চাবুক, স্বদেশ প্রভৃতি উলে-খযোগ্য। এছাড়া আমোদ (কুমিল¬া), রুদ্রবীণা ও দর্পণ বেশ জনপ্রিয় ছিল। যুদ্ধ চলাকালীন কুড়িগ্রাম থেকে প্রকাশিত হতো ‘অগ্রদূত’ নামে একটি পত্রিকা। এর সম্পাদক ছিলেন আজিজুল হক মাস্টার। জেনারেল এমএজি ওসমানী ২ নভেম্বর এ পত্রিকার সম্পাদককে একটি প্রশংসাপত্র পাঠিয়ে অভিনন্দন জানান। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর বাংলাদেশের মুজিবনগর থেকে সর্বপ্রথম দৈনিক জয়বাংলা নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এটি ছিল মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত প্রথম দৈনিক। ১৯৭১-এর ৩০ মার্চ এটি প্রকাশনা শুরু করে এবং ১১ এপ্রিল বন্ধ হয়ে যায়। ‘নতুন বাংলা’ নামে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির একটি সাপ্তাহিক মুখপত্র ছিল। এটি ন্যাপপ্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হতো। মুজিবনগর থেকে এটি ১৯ সংখ্যা পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। ১৯ জুলাই এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। যুদ্ধকালীন বন্ধ হয়ে গেলেও যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে এটি নিয়মিত প্রকাশিত হতো। এ পত্রিকায় স্বাধীনতা সংগ্রামের সাফল্যের অনুকূলে মুজিবনগর সরকারের পরামর্শদাতা কমিটির কার্যক্রমের ওপর গুরুত্ব দেয়া হতো। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুক্তাঞ্চল থেকে খন্দকার গোলাম মোস্তফা বাটুল-এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘সাপ্তাহিক রণাঙ্গন’। খুব গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হতো ‘সাপ্তাহিক রণাঙ্গন’। এ সময় মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের অনেক আগেই সেপ্টেম্বর মাসে সাপ্তাহিক রণাঙ্গনে ‘ডিসেম্বরে বাংলা মুক্ত’ শিরোণামে একটি লীড নিউজ প্রকাশিত হয়েছিল, যেটি সেই সময়ে ব্যাপক আরোচনা ও সমালোচনার মুখে পতিত হয়।পরবর্তীতে রণাঙ্গনের এই ভবিষ্যত বাণী সত্যে পরিনত হলে পত্রিকাটি এবং এর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সম্পাদক-প্রকাশক খন্দকার গোলাম মোস্তফা বাটুল প্রশংশিত হন। একই সময়ে সাপ্তাহিক ‘সোনার বাংলা’ প্রকাশিত হয় ফুলু সরকারের সম্পাদনায়। রংপুর অঞ্চলের মুক্তি সংগ্রামে এই দুই পত্রিকার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার পত্রিকাগুলোর বিশেষ অবদান রয়েছে। বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোর করুণ অবস্থা তাদের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। তাই তারা ত্রাণ শিবির, গভীর অরণ্য কিংবা অনিশ্চিত আশ্রয়স্থলে বসে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যের খবরাখবর প্রচারের পাশাপাশি জনমত গঠনসহ দেশবাসীর মনোবল বৃদ্ধির চেষ্টা করেন। যেসব দৈনিক পত্রিকা নিয়মিত যুদ্ধের খবর ছাপত সেগুলোর মধ্যে সংবাদ জাগরণ, গণরাজ, রুদ্রবীণা, নাগরিক জনপদ ছিল অন্যতম। এছাড়া সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলোর মধ্যে ছিল সমাচার, দেশের কথা, সীমান্ত প্রকাশ ও ত্রিপুরার কথা। প্রথম দিকে এসব পত্রিকা বাংলাদেশে থেকে পালিয়ে আসা লোকদের স্মৃতিনির্ভর রিপোর্ট করত। পরবর্তী সময়ে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় রিপোর্টার পাঠিয়ে যুদ্ধের চলমান সংবাদ পরিবেশন করত। ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত সমাচার পত্রিকাটির কথা এখনো মুক্তিযোদ্ধারা ভুলতে পারেন না। এর সম্পাদক ছিলেন শ্রী অনীল ভট্টাচার্য। তিনি দৈনিক যুগান্তরের ত্রিপুরা প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি শুধু সাংবাদিকই নন, বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিমা সাংবাদিকদের একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। বিশেষ করে বিবিসি বাংলা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বিদেশী সাংবাদিকরা আসতে শুরু করেন ’৭০-এর ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসকে কেন্দ্র করে। তারপর তারা ’৭০-এর নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নিরঙ্কুুশ বিজয় প্রত্যক্ষ করেন। পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে যাদের মদদ ছিল তারা বাঙালির স্বাধীনতার চেতনাকে মূল্যায়ন না করলেও অধিকাংশ মিডিয়া বাঙালির পক্ষে ছিল। তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা সাপোর্ট করেনি। যুগোশ-াভিয়ার সংবাদপত্র লিখেছে, ‘ইয়াহিয়া বেয়নেট দিয়ে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে চাইছেন।’ ঘানার পত্রিকা লিখেছে, ‘বিশ্ব বিবেক এখনো জাগেনি।’ আমেরিকার পত্রিকাগুলো লিখেছে, ‘মার্কিন অস্ত্রে পূর্ব পাকিস্তানি মারা যাচ্ছে। সুতরাং দায় যুক্তরাষ্ট্র সরকারেরও।’ এ সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো মুক্তিযুদ্ধের ওপর গুরুত্বারোপ করে। এগুলোর মধ্যে উলে-খযোগ্য হচ্ছে— ‘চীন চায় না ভারতীয় উপমহাদেশে যুদ্ধ বেঁধে যাক,’ এ এফপি, পিকিং, নভেম্বর ১৫; ‘মুজিবের রাষ্ট্রদ্রোহের প্রকৃতি’, দ্য সানডে টাইমস, জাম্বিয়া, ২২ আগস্ট, ১৯৭১; ‘ভারত-পাকিস্তান উপমহাদেশ পরিস্থিতি’, সানডে পোস্ট, নাইরোবি, ৩ অক্টোবর ১৯৭১; ‘শরণার্থী সমস্যার সমাধান’, মানিচি, ডেইলি নিউজ, টোকিও। যুদ্ধের সময় চলমান সংবাদের পাশাপাশি কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও সম্পাদকীয় প্রকাশিত হতো। এগুলো জনগণকে উদীপ্ত করত। ১৯৭১-এর ৩১ মার্চ দৈনিক জয় বাংলার সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘বাংলার মুক্তিবাহিনী, পুলিশ, আনসার ও স্বেচ্ছাসেবকদের সহিত সর্বপ্রকার সহযোগিতা করবেন। মনে রাখিবেন, হয় আমরা জয়ী হইব নতুবা ধ্বংস হইব। মাঝামাঝি আর কোন পথ নাই।’ জয় বাংলার ১৬ ডিসেম্বরের শিরোনাম ছিল-ভেঙ্গেছে দুয়ার, এসেছে জ্যোতির্ময়। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বাংলার বাণী পত্রিকায় ‘ঢাকা আমায় ঢাকে’ শিরোনামে লিখতেন। সাপ্তাহিক বাংলাদেশ ২১ নভেম্বর সংখ্যার শিরোনাম ছিল— রক্ত-মত্ত বাংলাদেশ, ঈদের চাঁদ রক্তের সমুদ্রে। এবারের ঈদ রক্ত তিলক শপথের দিন। রণাঙ্গনের সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘আমরা শান্তি চাই। কিন্তু কবরের শান্তি চাই না। এবার আমরা শান্তি প্রতিষ্ঠা করব। আঘাতের পর আঘাত হেনে দস্যু-হানাদারদের খতম করব, জয় বাংলা।’ মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকার পত্রিকাগুলো বন্ধ হয়ে গেলে মুক্তাঞ্চলসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নিয়মিত-অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা ও সংবাদ সাময়িকী মুক্তিযোদ্ধাদের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হতো। এগুলো মুক্তিকামী জনতার মুখপত্র হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পত্রপত্রিকার অবদান অপরিসীম।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমের সেই ঐতিহাসিক ভূমিকার উত্তরাধিকার কাঁধে তুলে নিয়ে উত্তরবাংলা ডটকম স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বুকে লালন করে ‘দেশ মাটি ও মানুষের পক্ষে’ কাজ করে যেতে দৃঢ় প্রত্যয়ী ।

মহান বিজয়ের মাসে উত্তরবাংলা ডটকমের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে মহান মক্তিযুদ্ধের সময় দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি, সেই সাথে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি লাখো শহীদের অমর আত্মদানের প্রতি।

লেখক : সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক. উপদেষ্টা সম্পাদক, ‘উত্তরবাংলা.কম’।

মন্তব্য করুন


 

Link copied