খেলাটা মূলত চার স্তরে সাজানো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল বলেছেন যে, খালেদা নাটক শুরু করেছেন। অভিনয়ে উনার জুড়ি নাই... কথাটা একেবারে অমূলক বলেননি। তবে তিনি যেই মেজাজে এবং অর্থে বলেছেন, আমার সন্দেহ হয়, তা আদৌ ঠিক কিনা।
প্রথম স্তরটা কিছুটা হাল্কা ওয়ার্ম আপের মত গাজীপুরে শুরু করেছিলেন খালেদা। কিন্তু সেটা মোটেও মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি সেখান থেকে শুধু ৫ জানুয়ারিতে ঢাকায় যে নাটক চলছে, তার পক্ষে যৌক্তিকতা অর্জন করেছিলেন। গাজীপুরে তিনি সমাবেশ করার তেমন কোনও আগ্রহই দেখাননি।
গাজীপুর থেকে আহরিত যৌক্তিকতায় তিনি ৫ জানুয়ারিকে সামনে রেখে বিভিন্ন স্তরের নেতাদের দ্বারা মাঠ সাজিয়েছেন। প্ল্যান মাফিক তিনি সেই নেতাদের দ্বারা বিভিষিকা সৃষ্টিকারী বক্তব্য প্রদান করিয়েছেন। টিভি টক শোগুলোতেও এই ধারাপাতে গরম রেখেছেন। সরকার তো দিশেহারা।
বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাদের মাধ্যমে অর্জিত তথ্যে পাওয়া গেল লোমহর্ষক সব ষড়যন্ত্রের আলামত। মারাত্মক ধরনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড, জামায়াত-শিবির-হেফাজতদের আতর্কিত আক্রমণে ঢাকার আইনশৃঙ্খলা ভেঙে ফেলা, বেশকিছু লাশ ফেলে দেওয়া, কিছু ভিভিআইপিকে টার্গেট করে আক্রমণ চালানো। মোট কথায়, সেই ২০১৩ সালের ৫ মের পুনর্মঞ্চায়ন করা। এসবই বিএনপি তাদের 'ফেইক' কর্মকাণ্ডের দ্বারা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। উপরন্তু কিছু জঙ্গি সংগঠন তো আছেই, যারা খালেদাকেও নাকি হত্যা করতে চায়। এটাও একটা এলিমেন্ট আগে থেকেই শাপে বরের মত কাজ করল খালেদার প্ল্যানের পক্ষে।
সরকার কী করল? গোয়েন্দাদের এতসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ন্যাশনাল সিকিউরিটির পরামর্শে সিদ্ধান্ত নিল, খালেদাকে যে করেই হোক বাইরে বের হতে দেওয়া হবে না। প্রথমত খালেদাকে যদি জঙ্গীরা হত্যা করে, তাহলে দেশ, বেনজির ভুট্টোকে হত্যার পরে পাকিস্তানের যে অবস্থা হয়েছিল, সেদিকে মোড় নেবে এবং সরকার সে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে না। সরকার এই সব পরিস্থিতিতে কী কী ভাবতে পারে, তা অবশ্যই বিএনপির নখদর্পণে ছিল। কারণ তারাও একাধিকবার সরকারে ছিল এবং তারা ভাল করেই জানে, এইসব পরিস্থিতিতে সরকারের মেশিনারিজ কিভাবে কাজ করে এবং সরকারের মাথা কিভাবে ঘোরাতে হয়।
রিজভী সাহেবকে অসুস্থ্ বানিয়ে হাসপাতালে পাঠানো হলো যাতে সরকার ইচ্ছে হলে পল্টনের বিএনপির অফিসটা তালাবদ্ধ করে দিলেও কোনও অসুবিধা না হয়। কারণ খালেদা তো জানিয়েই দিয়েছেন গুলশান অফিসে আসার পরেই যে, তিনি পল্টন অফিসের সামনে জনসভা করবেন। যাই হোক, তার প্ল্যান সব ঠিকভাবে চলছে কিনা, তা পরীক্ষার জন্য তিনি রিজভী সাহেবকে হাসপাতালে দেখতে যেতে চাইতেই পুলিশ এবং নিরাপত্তারক্ষীরা তাকে গুলশানে আটকে দেয়। খালেদা তো মহাখুশি।
যাইহোক, আটঘাট বেঁধেই খালেদা চলে এলেন তার গুলশানের অফিসে। তিনি জানতেন, তার জন্য কী অপেক্ষা করছিল এবং তিনি যে টোপ ফেলেছিলেন, তা যে সরকার গিলছে, সার্বক্ষণিকভাবে কেউ বা কারা নিয়মিতভাবে তাকে সেই তথ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন সরকারের ভেতর থেকে। এদিক দিয়ে রিজভী সাহেবকে অসুস্থ্ বানিয়ে হাসপাতালে পাঠানো হলো যাতে সরকার ইচ্ছে হলে পল্টনের বিএনপির অফিসটা তালাবদ্ধ করে দিলেও কোনও অসুবিধা না হয়। কারণ খালেদা তো জানিয়েই দিয়েছেন গুলশান অফিসে আসার পরেই যে, তিনি পল্টন অফিসের সামনে জনসভা করবেন। যাই হোক, তার প্ল্যান সব ঠিকভাবে চলছে কিনা, তা পরীক্ষার জন্য তিনি রিজভী সাহেবকে হাসপাতালে দেখতে যেতে চাইতেই পুলিশ এবং নিরাপত্তারক্ষীরা তাকে গুলশানে আটকে দেয়। খালেদা তো মহাখুশি। প্রথম টেস্ট সফল হতেই তিনি আরও মহা উৎসাহে হম্বিতম্বির আওয়াজ বাড়িয়ে দিলেন। আর এদিকে সরকার সেই হম্বিতম্বিতে পল্টনের অফিসটি তালাবদ্ধ করে দিলেন। খেলা ঠিক ভাবেই যত এগোতে লাগলো, খালেদার হম্বিতম্বি ততই যেন বেড়ে চললো।
চট্টগ্রাম নগরীর মেহেদিবাগে নিজ বাসভবনে বসে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ রেখে আন্দোলন দমন করা যাবে না। অথচ মি. উপদেষ্টার এই চরম মুহূর্তে ঢাকায় খালেদার পাশে থাকার কথা ছিল, নয় কি?
ট্রাক আনা হলো বালি আর ইট ভর্তি করে। সরকার ভেবেছে, হয়ত খালেদা এসব দেখে আগেরবারের মতো তার টেম্পারমেন্ট হারাবে এবং জাতির সামনে আবারো হাস্যকর হয়ে যাবে। অন্যদিকে সরকারের প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন বলে ঘোষণা এলো, সেই সাথে সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রীও সাংবাদিক সম্মেলনের ডাক দিলেন। উদ্দেশ্য একটাই যে, খালেদা ৫ তারিখে সারাদিন যে যে ভুলগুলো করবেন, তার জবাব জাতির সামনে তুলে ধরবেন। খালেদার জনসভা করা যদি সত্যিই সিরিয়াস হতো তাহলে রিজভী সাহেব অসুস্থ হতেন না। মীর্জা ফখরুল আগেভাগেই গা ঢাকা দিতেন না। গুলশানের অফিসে খালেদাকে হেল্প করার জন্য শুধু সাথে রইলেন তার ব্যক্তিগত প্রেস সচিব, এইসব পরিস্থিতিতে আসলেই যাকে খালেদার হাতের কাছে দরকার। একটু খেয়াল করে দেখুন, অন্যান্য যেসব আইনজীবী নেতা বা অন্য নেতারা বিএনপিতে আছেন, তারা কিন্তু একেবারেই পর্দার আড়ালে চুপ মেরে রইলেন। চট্টগ্রাম নগরীর মেহেদিবাগে নিজ বাসভবনে বসে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ রেখে আন্দোলন দমন করা যাবে না। অথচ মি. উপদেষ্টার এই চরম মুহূর্তে ঢাকায় খালেদার পাশে থাকার কথা ছিল, নয় কি? জামায়াত বা অন্যান্য যে সব মৌলবাদী বিএনপি বান্ধব দলগুলো আছে, তারা কোথায়? তাহলে প্রশ্ন জাগতেই পারে, ঘটনা কী তাহলে?
৫ জানুয়ারি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপের মধ্যে বৈঠক করেছেন ড. কামাল হোসেন, আ স ম আবদুর রব ও মাহমুদুর রহমান মান্না, যারা আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে তৃতীয় একটি রাজনৈতিক জোট গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছেন। বিএনপি থেকে বহিস্কৃত হওয়া সাবেক প্রেসিডেন্ট বদরুদ্দোজা চৌধুরী কোনও এক অজ্ঞাত কারণে হঠাৎ করেই খালেদাকে দেখতে তার গুলশান কার্যালয়ে গেলেন।
এবার দেখা যাক তৃতীয় মঞ্চে কী ঘটছে? ৫ জানুয়ারি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপের মধ্যে বৈঠক করেছেন ড. কামাল হোসেন, আ স ম আবদুর রব ও মাহমুদুর রহমান মান্না, যারা আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে তৃতীয় একটি রাজনৈতিক জোট গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছেন। বিএনপি থেকে বহিস্কৃত হওয়া সাবেক প্রেসিডেন্ট বদরুদ্দোজা চৌধুরী কোনও এক অজ্ঞাত কারণে হঠাৎ করেই খালেদাকে দেখতে তার গুলশান কার্যালয়ে গেলেন। এইসব ঘটনার পাশাপাশি, প্রথম আলো "ফিরে দেখা ৫ জানুয়ারি সুশীল সমাজের ফয়সালার তালাশ" শিরোনামে একটা উপসম্পাদকীয় ছাপলো। নাটকীয়ভাবে হঠাৎ করে দেশের পটপরিবর্তনের আগাম হিসাবনিকাশ আগে থেকে জানা না থাকলে তারেক রহমানও কিভাবে হুট করে ভিডিও ম্যাসেজ বাংলাদেশে পাঠাতে পারেন, যেখানে ঢাকার এক এলাকা থেকে অপর এলাকাগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার আদেশ দিলেন। এখানেই আসলে নাটকের মূল মাজেজা। লেখাটির এই পর্যায়ে জানা গেল, খালেদা জিয়া নাকি বিকেল ২-৩ টার দিকে বের হবেন পল্টনে জনসভার উদ্দেশ্যে যাওয়ার জন্যে। লজিকটা ঠিক মিললো না।
তিনি যখন সার্বিক পরিস্থিতি জানেন এবং পুলিশের সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তি-কুস্তাকুস্তির জন্য যাতে যথেষ্ঠ সময় পান, সেজন্য সকাল সকালই তিনি বেরিয়ে পড়বেন, যা যৌক্তিক এবং স্বাভাবিক। কিন্তু দুপুরের পরে বের হলে তিনি বড়জোর একবার একটু হাল্কা চেষ্টার পরে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে কিছু বক্তব্য রাখবেন এবং পরবর্তী একটা যুৎসই কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে পুলিশ প্রহরায় বাসায় চলে যাবেন।
তিনি যে ঘোষণা দেবেন তা হচ্ছে, যেহেতু বিএনপি নামক দলটির রাজনীতিতে এখন আর আগের মতো মূল্য নাই। যেহেতু তারা সংসদে নেই। অনেকটা হারাধনের ছেলেপুলের মতো ভবঘুরে। তাই মধ্যবর্তী নির্বাচনের জন্য যে করেই হোক সরকারকে বাধ্য করা আলোচনার টেবিলে বসানো। যেহেতু দল হিসেবে সরকার বিএনপিকে তেমন একটা পাত্তাই দিচ্ছেন না, তাই সরকার যাতে পাত্তা দেয়, সেজন্য কিছুটা ক্লাইমেক্স তৈরি করা। আর এই আলোচনার যৌক্তিকতার মেরুকরণ তৈরি করতে জড়ো হচ্ছেন বিভিন্ন কৌশলীরা ড. কামাল হোসেনের বাসায়। কাদের সিদ্দিকীরা সরাসরি উপস্থিত না থেকেও টেলিফোন গরম রেখেছেন। আর মধ্যপন্থি বামদলগুলো অপেক্ষা করছে মঞ্চের চতুর্থ সিনের জন্য। ওনারা তখন অনেকটা পুরহিতদের মত মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে পানিকে আরও ঘোলা করে তুলতে সহযোগিতা করবেন।
মোদ্দাকথায়, যা কিছু ঘটছে তা শুধুই সরকারকে মধ্যবর্তী নির্বাচনের ব্যাপারে আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য করানো এবং একবার যদি সরকার সেই ভুল করে ফেলে, তাহলে নড়েচড়ে বসবেন বিভিন্ন দেশের ডিপ্লোম্যাটরা। তারাও ইনিয়ে বিনিয়ে হাসিনা সরকারকে সৌহার্দ্যপূর্ণ আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য সকালে হাসিনার সাথে আর বিকেলে খালেদার সাথে মিটিং করবেন। অর্থাৎ মধ্যবর্তী নির্বাচন কবে হবে বা আদৌ হবে কিনা, সেটা মূখ্য নয়। মূল ব্যাপার হলো সরকারকে আলোচনার টেবিলে এনে বিভিন্ন শর্তের জালে একটু একটু করে আটকে ফেলা এবং সেই সাথে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের গতিকেও শ্লথ করে দেওয়া।
লেখকঃ রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কলামিস্ট ও সাংবাদিক
ইমেইলঃ sabbir.rahman@gmail.com