আর্কাইভ  মঙ্গলবার ● ১৯ মার্চ ২০২৪ ● ৫ চৈত্র ১৪৩০
আর্কাইভ   মঙ্গলবার ● ১৯ মার্চ ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: রংপুরের আলু যাচ্ছে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে       গ্রাহকের ৫০ লাখ টাকা নিয়ে উধাও পোস্টমাস্টার!       চার ঘণ্টা পর উত্তরবঙ্গের সাথে ঢাকার ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক       ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন       রংপুরে মিস্টি ও সেমাই কারখানায় ৫০ হাজার টাকা জরিমানা      

 width=
 

রংপুর টাউন হল: স্বীকৃতির জন্য কাঁদছে একাত্তরের টর্চার ক্যাম্প

শনিবার, ২ মার্চ ২০১৩, দুপুর ০১:৪৬

সেটি হচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধের বছর ১৯৭১ সাল।১৯৭১ সালের পুরো নয় মাস জুড়ে এখানে চলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নারকীয় তাণ্ডব। যা এই প্রজন্মের অনেকের নিকটই অজানা। ৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদারেরা টাউন হলকে বানিয়েছিল কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প অর্থাৎ টর্চার ক্যাম্প। মুক্তিকামী নিরপরাধ বাঙালীদের ধরে এনে এখানে চালানো হত নির্মম নির্যাতন। বাঙালী রমনীদের ধরে এনে আটকে রেখে দিনের পর দিন তাদের ধর্ষণ করা হত। পরে একসময় তাদের হত্যা করা হত। অসহায় নারী-পুরুষের আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে উঠতো টাউন হল চত্বর।

টাউন হল সংলগ্ন উত্তর পাশে ছিল একটি বড় পাকা ইন্দারা। ঠিক ইন্দারার পাশেই ছিল বিশাল এক বড়াই গাছ। প্রতিদিন সেই গাছের ডালে ঝুলিয়ে নিরপরাধ মানুষগুলোকে উলঙ্গ অবস্থায় নির্যাতন করা হত। নির্মম নির্যাতনের পর একসময় তাদের হত্যা করে বড়াই গাছের নিচে ইন্দারা অথবা পাশের তৎকালীন উদ্ভিদ উদ্যান কেন্দ্রের আমবাগানে মাটি চাঁপা দিয়ে রেখে দিত। এখনও প্রবীন কেউ যদি সাবেক উদ্ভিদ উদ্যান কেন্দ্র বর্তমান চিড়িয়াখানার অভ্যন্তরে আমবাগানে যান তবে একাত্তরের সেই দিনগুলোর কথা মনে করে তার মনের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে। আমবাগানের মাঝামাঝি অবস্থায় একটি কালভার্ট ছিল। সেখানেও অসংখ্য মানুষের লাশের গন্ধ আজও চিড়িয়াখানার আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়ায়। সেই গন্ধ কেউ পায় আবার কেউ পায়না। আবার কেউ শুনেও না শোনার ভান করেন। কেউ কেউ জেনেও না জানার ভান করেন।

কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য রংপুর টাউন হল এবং তৎকালীণ হর্টিকালচার সেন্টার (উদ্ভিদ উদ্যান কেন্দ্র) এর ভিতরের একাত্তরের সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতনের কোন নিদর্শন নেই। স্বাধীনতার ৪২ বছর পেরিয়ে গেলেও কোন সরকার এমনকি কোন সামাজিক অথবা সাংস্কৃতিক সংগঠন এখানে একটি সাইনবোর্ড লাগানোরও উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। সম্প্রতি একটি সংগঠন টাউন হলকে শহীদ স্মৃতি হল হিসেবে ঘোষনা দিলেও তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। হত্যাযজ্ঞের স্থানটিকে একটি বধ্যভূমি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া উচিৎ।

তবে বিষয়টি স্বাধীনতার ৪২ বছর পরেও রয়েছে উপেক্ষিত। অথচ এই টাউন হলকে ঘিরে এখানে গড়ে উঠেছে অনেকগুলো সাংস্কৃতিক সংগঠন। পাকা ইন্দারা এবং বড়ই গাছটি কেটে ফেলা হয়েছে। স্থাপন করা হয়েছে জেলা শিল্পকলা একাডেমী ভবন। মহান স্বাধীনতা দিবস এবং বিজয় দিবস পালিত হয় টাউন হলে ও শিল্পকলা একাডেমীতে। কিন্তু কারো মুখ দিয়ে এ কথা উচ্চারিত হয়না মহান স্বাধীনতা অর্জনে এই মাটিতেও অনেক রক্ত ঝরেছে। প্রবীন অথবা প্রত্যক্ষ দু’চারজন হয়ত কখনো এই প্রজন্মের কাছে স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন ৭১ এর ভয়াল দিনগুলোর নির্মমতা ও বর্বরতার কথা। তা শুনে হয়তোবা কেউ শিউরে ওঠেন আবার কেউ হয়তো দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। শুধু এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে রক্তক্ষয়ী সেদিনের ইতিহাস। তবে এ প্রজন্মের অনেকের কাছেই প্রশ্ন উঠেছে টাউন হলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এত বড় নির্মমতার রাষ্ট্রিয়ভাবে কোন স্বীকৃতি নেই কেন।

প্রত্যক্ষদর্শী টাউন হলের পূর্ব পাশে অবস্থিত রংপুর হাই স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক মরহুম শাহ তৈয়বুর রহমান তার জীবদ্দসায় স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, টাউন হলটি স্কুল সংলগ্ন হওয়ায় ছাত্ররা প্রায়ই খান সেনাদের এই নির্যাতন দেখে অজ্ঞান হয়ে যেত। একদিন অষ্টম শ্রেণীর এক ছাত্র শিক্ষকদের চোখ ফাঁকি দিয়ে স্কুলের ছাঁদে ওঠে হানাদার বাহিনীর নির্যাতন দেখছিল। হঠাৎ করে ছেলেটি অজ্ঞান হয়ে নিচে পড়ে যায়। এই নিয়ে পুরো স্কুলের ছাত্ররা আতংকিত হয়ে পড়ে। পরদিন পাকিস্তানি সেনারা প্রধান শিক্ষককে তাদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়। নির্দেশ দেয় টাউন হলের দিকে মুখ করা স্কুলের সবগুলো জানালা বন্ধ করে দিতে হবে। জানালা খোলা থাকলে সরাসরি গুলি চালানো হবে। এছাড়া কেউ ছাদে উঠলে তাকেও গুলি করে হত্যা করা হবে। যদি কেউ এই আদেশ অমান্য করে তাহলে প্রধান শিক্ষককেও হত্যা করা হবে। এ ঘটনার কদিন পর পরেই উক্ত প্রধান শিক্ষক স্বপরিবারে রংপুর ছেড়ে চলে যান। ঐ স্কুলের তৎকালীন ছাত্র বর্তমান ব্যবসায়ীদের নেতা আব্দুল জলিল, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরীজীবী তারেক জানান, মুরাদ, রন্টু, কবির, আফছার, আশরাফ, মকবুলসহ আমরা অনেকেই সেই নির্মমতার দৃশ্য দেখেছি। টাউন হলের পূর্ব পাশে প্রতিদিন বাঙালীদের ধরে এনে বিভিন্ন কায়দায় নির্যাতন করা হত। কখনো স¤পূর্ণ উলঙ্গ করে দুজন খান সেনা ধরে আনা ব্যাক্তিকে চেংদোলা করে ধরতো, আরেকজন রাইস মিলের বেল্ট দিয়ে পিটাত। আবার কখনো বড়াই গাছের ডালে ঝুলিয়ে তাদের নির্যাতন করা হতো। তাদের আত্মচিৎকার শোনা যেত স্কুল থেকে। যে সব মেয়েদের ধরে আনা হতো, তাদেরকে টাউন হল সংলগ্ন পাবলিক লাইব্রেরীর একটি কক্ষে নিয়ে ধর্ষন করতো খাঁন সেনারা। এক পর্যায়ে ধরে আনা নারী পুরুষগুলোকে হত্যা করে ইন্দারা অথবা পাশের উদ্ভিদ উদ্যানের আমবাগানে মাটি চাঁপা দিয়ে রাখতো। এভাবে প্রতিদিন গড়ে ৮ থেকে ১০জন বাঙালী নারী পুরুষকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয় টাউন হলে। এসব নারকীয় হত্যাযজ্ঞের কোন নিদর্শন, এমনকি একটি স্মৃতিস্তম্ভও নির্মিত হয়নি স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও। বীর মুক্তিযোদ্ধা সদরুল আলম দুলু বলেন, এ প্রজন্মের নিকট মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হলে একাত্তরের টর্চার ক্যা¤প রংপুর টাউন হলে পাক হানাদারদের হাতে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের আÍার শান্তির জন্য এবং তাদের স্মৃতি ধরে রাখতে হলে সরকারীভাবে এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান করতে হবে। তানা হলে আগামী প্রজন্ম মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা করবে না। তিনি জানান, যে স্থানে ইন্দারা ও বড়াই গাছ ছিল সে স্থানটিকে চিহ্নিত করে এখনও স্মৃতিফলক নির্মাণ করে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণ করা যায়। তৎকালীন রংপুর হাই স্কুলের ছাত্র রুবেল জানান, ১৮ ডিসেম্বর বিজয়ের দুদিন পরে টাউন হলের পাকা ইন্দারা এবং উদ্ভিদ উদ্যান কেন্দ্র, বর্তমান চিড়িয়াখানায় বেশ কজনের গলিত লাশ দেখেছেন। গলিত লাশের মধ্যে বেশ কজন মেয়েও ছিল। চিড়িয়াখানার অভ্যন্তরে গলিত লাশের মধ্যে মহিলাদের চুল, হাতের চুড়ি, কাপড় ও মাথার খুলি তিনি স্বচোখে দেখেছেন। বর্তমান চিড়িয়াখানায় অভ্যন্তরে যেখানে অসংখ্য গলিত লাশ পাওয়া গেছে। তিনি জানান, ৩০লাখ শহীদের মধ্যে নাম না জানা এসব হতভাগা মানুষগুলোর স্মৃতি রক্ষার্থে কিছু একটা করা উচিত। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার। একমাত্র এই সরকারের একটি সিদ্ধান্তে এই স্থানটি পেতে পারে বদ্ধভূমির মর্যাদা। সেই স্থানটিকে চিহ্নিত করে বধ্যভূমির মর্যাদা দিয়ে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা সময়ের দাবি। এ দাবী শুধু তার নয়। এ প্রজন্মের অনেকের। টাউন হলের পশ্চিম পাশে প্রধান সড়ক থেকে অনেকেই পাক হানাদারদের এই নৃশংসতা প্রত্যক্ষ করেছেন। সে ঘটনা তারা তাদের ছেলে মেয়েদের বলেন।

এ প্রজন্মের তরুণ শিল্পী শহীদুল হক বিপ্লব, কবি নাসরিন জাহান কেয়া, সফটওয়্যার ইঞ্জি: নূরে আলম সিদ্দিকী, অনার্স পড়ুয়া ছাত্রী মাহাফুজা শারমীন রিতু, তরুণ কবি জোবায়ের আলম জাহাজী, সঙ্গীত শিল্পী স্নিগ্ধা সিং, মোমেনা আক্তার, এসএসসি পরীক্ষার্থী মাহমুদুল করিম জিতু, সুমাইয়া ইয়াসমিন গিনি। এদের জন্ম ঊনিশ একাত্তর সালের পরে। তারা জানান তাদের বাবার কাছে এই নির্মম বর্বরতার কথা শুনেছেন। তারাও দাবী জানান, টাউন হল ও তার পাশে পাকিস্তানী বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের বর্বরতার সঠিক ইতিহাস এ প্রজন্মকে জানাতে হবে।

মন্তব্য করুন


 

Link copied