আর্কাইভ  শুক্রবার ● ২৯ মার্চ ২০২৪ ● ১৫ চৈত্র ১৪৩০
আর্কাইভ   শুক্রবার ● ২৯ মার্চ ২০২৪
 width=
 

 

কুড়িগ্রামের খাবারে বেজায় খুশি ভুটানের রাজা

কুড়িগ্রামের খাবারে বেজায় খুশি ভুটানের রাজা

কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করলেন ভুটানের রাজা

কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করলেন ভুটানের রাজা

রানিকে নিয়ে কুড়িগ্রামে পৌঁছেছেন ভুটানের রাজা

রানিকে নিয়ে কুড়িগ্রামে পৌঁছেছেন ভুটানের রাজা

কুড়িগ্রামে সমৃদ্ধির হাতছানি

কুড়িগ্রামে সমৃদ্ধির হাতছানি

 width=
 
শিরোনাম: রংপুরবাসীর জন্য সরকারি চাকরি, পদ ১৫৯       স্বাস্থ্যের রংপুর বিভাগীয় পরিচালক ফজলুল হক কারাগারে       কুড়িগ্রামের খাবারে বেজায় খুশি ভুটানের রাজা       লালমনিরহাটে পুকুরে জাল ফেলতেই জালে উঠে এলো যুবকের মরদেহ       কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করলেন ভুটানের রাজা      

 width=
 

গল্প || দেবদূত

বৃহস্পতিবার, ১৮ জুন ২০১৫, দুপুর ১২:০৮

রীতা রায় মিঠু রুমা ক্লান্ত পায়ে টি-রুমের দিকে যাচ্ছিল। পেছন থেকে কেউ ডাকল, ‘হাই রুমা, যাচ্ছ কোথায়?’ ইদানীং রুমাকে কেউ ডাকলে অকারণে তার পিলে চমকে ওঠে! মা মারা যাবার পর থেকে এটা শুরু হয়েছে। ডাক শুনে পেছন ফিরতেই কোরিয়েটাকে দেখতে পেল, সঙ্গে সঙ্গে পিলে চমকানো রেশ কেটে গেল তার। ম্যানেজার কোরিয়েটা ভীষণ মিষ্টি স্বভাবের, সারাক্ষণ মুখে হাসি ধরে রাখে। আফ্রিকান-আমেরিকানরা এমনিতেই হাসিখুশি স্বভাবের হয়ে থাকে, অবশ্য আফ্রিকান মেয়েগুলো ভীষণ ঝগড়াটে আর মুখরাও হয়। কোরিয়েটা অবশ্য ঝগড়াটে প্রকৃতির নয়, তার চেহারায় দারুণ এক কোমলতার ছাপ আছে। রুমা বলল, ‘হাই কোরিয়েটা! আমি এখন টি-রুমের দিকে যাচ্ছি, আমাকে কিছু বলবে?’ -তোমাকে আরেকটি ‘অ্যাপ্রিসিয়েশন’ পিন দেব। -মানে? -এক কাস্টমার তোমার নামে হাইলি প্রশংসা করেছে, অবশ্য অনেক কাস্টমারই তোমার সম্পর্কে প্রশংসা করে। এখন তুমি টি-ব্রেকে যাচ্ছ, আমিও বাড়ি ফিরছি। আগামীকাল তুমি আসছো তো? -হ্যাঁ, দুপুর ১টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত শিফট। -তাহলে কালকেই তোমাকে পিন পরিয়ে দেব, সঙ্গে ডিনার মানি। -ওহ্ মাই গড! আমি এত খুশি হলাম তোমার মুখ থেকে সুসংবাদ শুনে। -আমি নিজেও খুশি তোমাকে সুসংবাদ দিতে পেরে। দেখা হবে কাল। টি-রুমে যাও, তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। কোরিয়েটার সঙ্গে কথা বলে রুমার মনটা ভালো হয়ে গেল। দুই দিন ধরে রুমার মন খারাপ। পরশুদিন ফেসবুকে বাংলাদেশের অনন্ত বিজয় নামের এক তরুণের রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত ছবি দেখেই রুমার মনটা বিবশ হয়ে যায়। কয়েক মাস আগে দেখেছে ওয়াশিকুর রহমান বাবুর রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত মুখ, তারও আগে অভিজিতের রক্তে ভেসে যাওয়া দেহ। বাংলাদেশে এসব কী হচ্ছে, লিওনার্দো সেদিন রুমাকে জিজ্ঞেস করেছে, ‘তোমাদের দেশের মানুষরা কি খুব বেশি নিষ্ঠুর?’ রুমা বলেছিল, ‘না তো, নিষ্ঠুর হবে কেন? আমি কি নিষ্ঠুর?’ -না এমনিতেই জানতে চাইলাম। ফেসবুকে প্রায়ই রক্তাক্ত মানুষের ছবি দেখছি। ইয়াহুতে পড়েছিলাম, একজন ব্লগারকে কুপিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলেছে। -সে তো সব দেশেই হত্যাকাণ্ড হয়, আমেরিকাতে হয় না? -একদম ঠিক বলেছ, সব দেশেই এখন অশান্তি বেড়ে গেছে। সরি রুমা, তোমাকে হার্ট করার জন্য বলিনি। মাঝে মাঝেই নিউজ ফিডে এমন সব বীভৎস ছবি আর নিউজ দেখি, আচ্ছা তোমাদের দেশে কি কাউকে মারতে হলে চাপাতি দিয়েই মারার নিয়ম? -আরে নাহ্! লিওনার্দো, মানুষ পশুর পর্যায়ে নেমে এসেছে। আমিও দুঃখিত, তোমার সঙ্গে তর্ক করছি। তোমার কথাই ঠিক, আমাদের দেশে মানুষগুলো আগে এমন ছিল না। এখন দিনে দিনে নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছে। কোনো কারণ লাগে না, কাউকে পছন্দ হলো না, ব্যস চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলো। লিওনার্দো আবারও সরি বলে চলে যাচ্ছিল। এমনিতেই রুমা ভীষণ নরম মনের মানুষ, খুবই বিনয়ী, ভদ্র। রক্তারক্তি, মারামারি, ঝগড়া ভয় পায়। তার মধ্যে দেশে কী যে শুরু হয়েছে! চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে মানুষকে মেরে ফেলছে, সেইসব রক্তাক্ত ছবি দেখে রুমার মনটাই অবশ হয়ে গেছে। রুমা প্রায় পাঁচ বছর যাবৎ কে-মার্টে চাকরি করছে। ওর কাজ জুয়েলারি ডিপার্টমেন্টে। ওর কথাবার্তা, আচার-আচরণে সকলেই খুশি। কাস্টমাররা তো সব সময় রুমা সম্পর্কে হাইলি অ্যাপ্রিসিয়েট করে। প্রতিবছর রুমা একটি-দুটি ‘অ্যাপ্রিসিয়েশন পিন’ পায়। তবুও রুমার মনে শান্তি নেই। শান্তি থাকবে কোথা থেকে, ঘরের মানুষ শান্তি না দিলে বাইরের মানুষের কী ঠ্যাকা পড়েছে রুমাকে শান্তি দেয়ার? টি-ব্রেকরুমে ঢুকেই রুমা সোজা চলে গেল বেসিনের দিকে, দুই হাত ভালো করে ধুতে হবে আগে। কত যে ময়লা জমে দুই হাতের তালুতে। আমেরিকাতেও হাতে-পায়ে ধুলো-ময়লা লাগে। আমেরিকা না এলে এমন অসম্ভব কথা রুমার জানাই হতো না। রুমা বাড়ি থেকেই বিস্কুট নিয়ে আসে। টি-রুমে কফি মেকারে দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা কফি তৈরি হচ্ছে। টি-ব্রেকে রুমা এক কাপ কফি আর দুখানা বিস্কুট খেল, পকেট থেকে স্যামসাং গ্যালাক্সি ফোন বের করে দশ মিনিট ফেসবুক করল। অনন্ত বিজয়কে নিয়ে অনেকেই স্ট্যাটাস দিয়েছে, অল বোগাস! হত্যাকারীদের কারো কিচ্ছু হবে না, একজনও ধরা পড়বে না। আচ্ছা, যারা হত্যাকারী তারা সকলেই কোনো-না-কোনো বাবা-মায়ের সন্তান। বাবা-মা যখন জানতে পারে, তাদের ছেলে একজন খুনি, তাদের ছেলে একজন ধর্ষক, তাদের মেয়ে একজন ড্রাগ ডিলারের গার্লফ্রেন্ড- কেমন লাগে সেইসব বাবা মায়ের? কত লজ্জার, কত দুঃখের, কত অপমানের, তা কি সন্তানরা বোঝে? বিস্কুটের টুকরো হঠাৎ করে যেন রুমার গলায় আটকে গেছে, এমনই অনুভব হচ্ছিল। ঝট করে মনে পড়ে গেল, আগামীকাল রুবাবার স্কুলের প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করতে হবে। দুই দিন আগে রুবাবার স্কুল থেকে ফোন এসেছিল, প্রিন্সিপাল রুবাবা সম্পর্কে ওর পেরেন্টসের সঙ্গে কথা বলতে চায়। রুবাবার পেরেন্টস বলতে একমাত্র রুমা। রুমার স্বামী নাসিম কন্যার জন্ম দিয়েই খালাস, মেয়ের ভালোমন্দ কোনো কিছুতেই উৎসাহ দেখায় না। নাসিমের একটাই কথা, ‘আমি এত তাড়াতাড়ি সন্তান চাই নাই, তোমার শখ হইছে মা হওয়ার, তা হইছো। এখন মাতৃত্ব দেখাও। মেয়ের ভালোমন্দ নিয়া আমার কোনো চিন্তা নাই। তোমার মেয়ে তুমি বুঝবা।’ রুমা অবাক হয়ে ভাবে, কোনো বাবা এভাবে কথা বলতে পারে? রুমা কি নিজের ইচ্ছেতেই মা হয়েছে? বিয়ের পরে বেহুঁশের মতো আচরণ কে করেছিল? রুমা, নাকি নাসিম? বাচ্চা কনসিভ করার পর যদি বলা হয়, বাচ্চা নষ্ট করতে হবে, কোনো মেয়ে পারে হাতে ধরে পেটে আসা সন্তানকে মেরে ফেলতে? নাসিম বলেছিল, অনেকবার বলেছিল অ্যাবরশন করিয়ে ফেলতে, রুমা রাজি হয়নি। সেই থেকে নাসিমের রুমার ওপর গোসা। রুমার পর গোসার ঝাল মেয়েটার ওপর ফলায়। রুবাবাকে নাসিম কোনোদিন কোলে তোলেনি, আদর করেনি, একটা খেলনা পর্যন্ত কিনে দেয়নি। ছোট্ট রুবাবা তার বাবার কোলে যাওয়ার জন্য কত কান্নাকাটি করত, নাসিম বাচ্চার হাতটাও ছুঁয়ে দেখত না। বাবার কাছ থেকে এমন ব্যবহার পেয়েই রুবাবা বড় হয়েছে, ওর বয়স এখন ১৬ বছর। দেখতে ফুটফুটে সুন্দর হলে কী হবে, স্বভাবে কিছু পাগলামি আছে। নাইনথ গ্রেডে পড়ে, স্কুল থেকে প্রায়-প্রায়ই কমপ্লেইন আসে। বাবা-মাকে ডাকা হয়। বাবা যায় না, মা যায়। কাউন্সেলর রুমাকে বলে দেয় রুবাবার প্রতি আরেকটু বেশি মনোযোগী হতে। রুবাবা নাকি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। রুমা বুঝে উঠতে পারে না, রুবাবা কেন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে? রুমা ওকে যথাসাধ্য যত্নে বড় করছে। আগামীকালের অ্যাপয়েন্টমেন্টের কথা মনে পড়তেই রুমার অস্বস্তি লাগা শুরু হলো। এবারই প্রথম প্রিন্সিপাল ডেকে পাঠিয়েছেন। নাসিমকে গতরাতে রুমা বলেছিল, ‘রুবাবার স্কুল থেকে ফোন এসেছিল পরশুদিন, প্রিন্সিপাল ওর পেরেন্টসের সঙ্গে কথা বলতে চান।’ -কথা বলতে চান, তো যাও, কথা বলে আসো। -তুমিও চলো না, প্রিন্সিপাল ডেকেছেন যখন, দুজনেই যাই। -আমি যাব না, তুমি যাও। -আচ্ছা, ও তো তোমারই সন্তান, কাগজে-কলমে বাবা হিসেবে তোমার পরিচয় দেয়া থাকে। -রুমা শোনো, এই এক কথা আমার সামনে ঘ্যানঘ্যান করতে না করছি না? প্রিন্সিপালের রুম থেকে যখন রুমা বের হয়ে এল ওই মুহূর্তে যদি কাছ থেকে কেউ ওর একটা ছবি তুলতে পারত, তাহলে দেখা যেত, রুমার মুখ থেকে সমস্ত রক্ত সরে গিয়ে মুখটা সাদা কাগজের মতো হয়ে গেছে। রুমার মাথাটাও ঘুরছিল, বুকটায় বিশাল শূন্যতা, কণ্ঠ শুকিয়ে কাঠ। রুবাবা কেন এমন কাজ করতে গেল? কেন রুবাবা নিজে নিজে হাত কেটে ফালা ফালা করে! রুমা কেন এত দিন কিছুই টের পায়নি? আজ কেন প্রিন্সিপালের মুখ থেকে শুনতে হলো রুবাবার এমন পৈশাচিক কর্মকাণ্ডের কথা? রুমা চাইছিল কোথাও শরীর এলিয়ে দিতে, কোনোমতে হেঁটে পার্কিং লটে এসে গাড়িতে স্টার্ট দিল। তার দুচোখ ঝাপসা, ও এখনো বুঝে উঠতে পারছে না, রুবাবা কেন এমন কাণ্ড করল। পাঁচ দিন আগের ঘটনা, রুবাবার সঙ্গে ওর এক চায়নিজ বন্ধুর কী নিয়ে বিতর্ক হয়। তর্কবিতর্কের এক পর্যায়ে রুবাবা সেই বন্ধুকে ‘এফ’ ওয়ার্ডে গালি দেয়। স্কুলে ‘এফ’ ওয়ার্ড, ‘বি’ ওয়ার্ড বলা নিষিদ্ধ। চায়নিজ মেয়েটি সরাসরি প্রিন্সিপালের রুমে চলে যায়, রুবাবার বিরুদ্ধে গালি দেয়ার অভিযোগের পাশাপাশি এটিও বলে দেয়, রুবাবার ফ্যামিলিতে অশান্তি, রুবাবার পেরেন্টস খুবই নিষ্ঠুর, ওরা রুবাবার টেক কেয়ার করে না। তাই তার মন-মেজাজ খারাপ থাকে, সব সময় তার ইচ্ছে করে সুইসাইড করতে। সঙ্গে করে রুবাবা ব্লেড নিয়ে আসে। মাঝে মাঝেই ব্লেড দিয়ে টেনে টেনে হাতের বিভিন্ন জায়গা কেটে ফেলে। রক্ত বের হলে নাকি ওর মাথা ঠান্ডা হয়। প্রিন্সিপাল রুবাবাকে ডেকেছিলেন, রুবাবার সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন, রুবাবা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ও জানিয়েছে, ওদের বাবা-মায়ের মধ্যে একটুও মিল নেই। বাবা কখনো রুবাবাকে নিজের সন্তান বলে স্বীকার করে না। বাবা চায়নি, রুবাবা পৃথিবীতে আসুক। মা জোর করে রুবাবাকে এই বাজে পৃথিবীতে এনেছে। এখন তাকে নিয়েই বাবা-মা ঝগড়া করে। রুবাবার কারণেই ওর মাকে ওর বাবা প্রায়ই পেটায়। তার বাবা যখন ওর মাকে পেটায়, পাশের ঘরে বসে বসে রুবাবা তখন ব্লেড দিয়ে ওর হাতের চামড়া কেটে ফালা ফালা করে। রুবাবা এও জানিয়েছে, ওর বাবার গার্ল ফ্রেন্ড আছে, সেই গার্ল ফ্রেন্ডের ঘরে ওর বাবার একটা ছেলে আছে, ছেলেটাকে রুবাবা দেখেছে। দশ-বারো বছর বয়স ছেলেটার। রুবাবা নিজের চোখে দেখেছে, ছেলের হাত ধরে ওর বাবা আইসক্রিম পার্লারে ঢুকেছে। প্রিন্সিপাল যখন এসব কথা বলছিল, রুমা বিশ্বাস করতে পারছিল না। যদিও অভিযোগের প্রায় সবটুকুই সত্য। রুমাকে ওর স্বামী প্রায়ই মারধর করে। এক বিছানায় ওরা ঘুমায় না অনেক কাল হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে রুমা চায়, নাসিমের পাশে শুতে, নাসিম তা পছন্দ করে না। একদিন নাসিম এমন কথাও বলেছে, ‘তুই যে আমার সঙ্গে শুইতে চাস, কেন চাস? আদর-সোহাগ পাওয়ার জন্য? কিন্তু যার বুনির চেয়ে পেট বড়, তারে দেখলে কোন বেটার শরীর জাগবো?’ সেই থেকে রুমা আর কখনো নাসিমের বিছানার ধারেকাছেও যায়নি। কিন্তু রুমা জানতেও পারেনি ওর প্রাণের ধন, মায়ের অপমানের শোধ নিজের ওপর দিয়ে তুলছে। প্রিন্সিপাল রুবাবাকে ডেকেছিল, প্রিন্সিপালের উপস্থিতিতেই রুমা দেখল, ফরসা হাত দুটোর সর্বত্র কাটা দাগ। এত দিন দাগগুলো খেয়াল করেনি কেন? আজ রুবাবার মুখের দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারেনি রুমা। নিজের কালো মুখ মেয়েকে দেখাতে চায়নি। গাড়িতে স্টার্ট দেয়া আছে, স্টিয়ারিং হুইলে মাথা রেখে রুমা কাঁদছিল। আজ ওর আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, ওর সমস্ত লজ্জার কথা সারা পৃথিবী জেনে গেছে। কেমন মা ও, মেয়েটাকে পারল না বুকে আগলে রাখতে! প্রিন্সিপাল আজ বলে দিয়েছে, রুবাবার মানসিক নিরাপত্তা এবং চিকিৎসা প্রয়োজন, যেহেতু রুবাবার পেরেন্টস রুবাবার খেয়াল-যত্ন করে না, প্রিন্সিপাল হিসেবে তার দায়িত্ব তার স্টুডেন্টের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। প্রিন্সিপাল অবশ্য বলেছে, যদি রুবাবার পেরেন্টস মনে করে যে তারা রুবাবার চিকিৎসা এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে, তাহলে আপাতত সোশ্যাল ওয়ার্কার এবং ল’ইয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করবে না। রুমা গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলে মাথা রেখে হাউমাউ করে কাঁদছিল, পাশের পার্কিং স্পেসে আরেকটি গাড়ি এসে থেমেছিল কখন, রুমা খেয়াল করেনি। গাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল যে, সে দেখল পাশের স্টার্ট দেয়া গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলে এক সুন্দরী মাথা রেখে খুব সম্ভবত কাঁদছে। তার মনে হলো, সুন্দরী এই মহিলাটির হয়তো অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। কেউ নিশ্চয়ই হারিয়ে গেছে। হয়তো তাকে হেল্প করার কেউ নেই। বেচারা গাড়িতে স্টার্ট চালু রেখেই মাথা নিচু করে হয়তো কাঁদছে। পার্কিং লটে আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সে জানালায় নক করে জোরে জোরে জিজ্ঞেস করতে লাগল, ‘হাউ আর ইউ? এনি প্রবলেম? ডু ইউ নিড হেল্প? মে আই হেল্প ইউ, ম্যাম?’ রুমা যেন গভীর সমুদ্রের তলে ডুবে গিয়েছিল। হঠাৎ খেয়াল হলো, কেউ যেন হাজার মাইল দূর থেকে রুমাকে কিছু বলছে! স্টিয়ারিং হুইল থেকে মাথাটা তুলে বাইরে তাকাতেই দেখল, ইয়া লম্বা চওড়া এক আফ্রিকান-আমেরিকান ওর জানালায় নক করছে আর চেঁচিয়ে কিছু বলছে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল রুমা জানালার কাচ নামাতে ভুলে গেল। মাথা ঠিক কাজ করছিল না। হঠাৎ করেই ওর উলটো চিন্তা মাথায় এল, রুবাবার কিছু হয়নি তো? রুমা প্রিন্সিপালের রুম থেকে বেরিয়ে আসার পর কি রুবাবা কোনো কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল? এই লোক কী বলছে, গাড়ির দরজা খুলে রুমা বেরিয়ে এল। দিশেহারার মতো ফের স্কুলের দিকে রওনা হলো। কালো ভদ্রলোকও রুমার পিছু পিছু ডাকছে, ‘ম্যাম, আর ইউ ওকে? আর ইউ ওকে? ইজ এনিথিং রং?’ রুমা একটুক্ষণের জন্য থমকালো, ভদ্রলোক রুমার সামনে গিয়ে খুব আন্তরিকতার সঙ্গে নিজের পরিচয় দিলেন, ‘আমি এডওয়ার্ড, এই স্কুলের মিউজিক অ্যান্ড ড্রামা ইন্সট্রাকটর। তোমার কী হয়েছে, শরীর খারাপ? আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি?’ রুমা জিজ্ঞেস করল, ‘আমার মেয়ের কী হয়েছে? তুমি আমাকে ডাকছিলে কেন? আমার মেয়ে কি আবারও ওর হাত কেটেছে?’ -তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না, তুমি শান্ত হও। এভাবে দাঁড়িয়ে কথা না বলে এসো ওই বেঞ্চটাতে বসি, এবার বলো, মেয়ের হাত কাটার কথা কী বলছিলে? তোমার মেয়ে হাত কাটবে কেন? তোমার মেয়ে কোথায়? ধীরে সুস্থে বলো তোমার কথা। -আমার মেয়ে এই স্কুলে পড়ে ক্লাস নাইনে, তুমি হয়তো তাকে চিনতে পারবে না। ও মিউজিক ক্লাস করে না। -তা ঠিক আছে, মিউজিক ক্লাস না করলেও স্টুডেন্টের নাম বললে, ক্লাস টিচারের নাম বললে চিনে নিতে সমস্যা হয় না। তোমার মেয়ের নাম কী? ওর কী হয়েছে? -আমার মেয়ের নাম রুবাবা বিনতে নাসিম। আমার মেয়ের খুব বিপদ, আমার নিজেরও খুব বিপদ। মেয়েটা ক্লাসে কাদের সঙ্গে মেশে আমি ঠিক জানি না, আজ প্রিন্সিপাল আমাকে ডেকেছিলেন, প্রিন্সিপাল জানালেন, রুবাবা নাকি মানসিকভাবে খুবই ডিস্টার্বড, বেশ কিছু পাগলামি আচরণ ধরা পড়েছে ওর মধ্যে। প্রায় প্রায়ই নাকি ব্লেড দিয়ে হাতের চামড়া কেটে ফালা ফালা করে। আমার একটামাত্র সন্তান, রুবাবার কিছু হলে আমি বাঁচব কী করে? -রুবাবা, ওকে আমি চিনতে পেরেছি। ও তো বাচ্চা একটা মেয়ে, খুব কিউট। তুমি এত পাজলড হোয়ো না। তুমি গাড়ি স্টার্ট দিয়ে রেখে যেভাবে কাঁদছিলে, পথে একটা অ্যাক্সিডেন্ট ঘটিয়ে ফেললে কী হতো? টিনএজের ছেলেমেয়েরা একটু পাগলা আচরণ করে, কেউ বেশি কেউ কম। এই বয়সটাতে ওরা খুবই সেনসিটিভ থাকে, তাই ওদের সঙ্গে সব সময় খুব ভালো ব্যবহার করতে হয়। তোমার হাজব্যান্ড আছে? -আমি বিবাহিত। হাজব্যান্ড নিজের কাজকর্ম নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকে, মেয়েকে সময় দিতে পারে না। আমিও চাকরি করি, ঘরের কাজ করি, যতটুকু সম্ভব মেয়েকে সময় দিই। কিন্তু আমি এই দেশের রীতিনীতি খুব ভালো বুঝি না। ছেলেমেয়েকে কী করে বড় করতে হয়, আমি জানি না। এ দেশে আমার আপনার জন কেউ নেই। -কেন তোমার হাজব্যান্ড আছেন। -আমার হাজব্যান্ড খুব ব্যস্ত থাকেন, তা ছাড়া- -কী তা ছাড়া? -আমি জানি না তোমাকে বলা ঠিক হবে কি না, কিন্তু এই মুহূর্তে আমার নিজেকে নিঃস্ব মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে এত বড় পৃথিবীতে আমার কেউ নেই, আমার মেয়েটাকে বাঁচাবার কেউ নেই। বিশ্বাস করো, আমার হাজব্যান্ড থেকেও নেই, রুবাবা তার মেয়ে হলেও সে মেয়ের ভালো-মন্দ নিয়ে ভাবে না। বিয়ের আগে তার একজন গার্ল ফ্রেন্ড ছিল, সেই গার্ল ফ্রেন্ডের সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে, সেই মেয়ের সংসারে দশ বছরের একটি ছেলেও আছে। এত দিন আমি ভেবেছি, আমার হাজব্যান্ডের গার্ল ফ্রেন্ড আর তার বাচ্চার কথা রুবাবা কিছু জানে না। আজ প্রিন্সিপাল আমাকে জানালেন, রুবাবা নাকি সবই জানে। মা-বাবার জীবনে শান্তি নেই, মা সুখী নয়, বাবা রুবাবাকে একটুও ভালোবাসে না, তাই মনের দুঃখে রুবাবা ব্লেড দিয়ে হাতের চামড়া কেটে যায়, রক্ত বের হয় তাতে নাকি দুঃখ কমে। -হুম, বুঝতে পারছি। তুমি কি মেয়ের সঙ্গে খুব বন্ধুর মতো ব্যবহার করো? -স্যার, আমাদের দেশে সব বাবা-মা ছেলেমেয়েকে সব সময় শাসন করে, আমার বাবা-মাও আমাকে এই বয়সে শাসন করেছেন। আমাদের বিশ্বাস, শাসন না করলে ছেলেমেয়ে মানুষ হয় না। কিন্তু আমি আমার মেয়েকে একটু বকাও দিই না। আমার মেয়েটা অনেক দুঃখী, বাবার আদর পায় না যে মেয়ে, তাকে কী করে আমি বকা দিই? কিন্তু এখন অন্য কারণে শাসন করি না। ভয় লাগে, বকা দিলে যদি মেয়ে পুলিশ কল করে দেয়। -আমি তোমাকে হেল্প করব, তুমি ভয় পেয়ো না। এই বয়সটা ভীষণ মারাত্মক, মজার কথা শোনো। তোমার মেয়ে তো তবুও নিজের হাতের চামড়া কেটে ফালা ফালা করে, আমার ছেলে আরো অনেক ভয়ংকর কাজ করেছিল, একবার নয়, চারবার সুইসাইডাল অ্যাটেম্পট নিয়েছিল। চারবার হাসপাতাল ঘুরিয়ে আনতে হয়েছে। তিনবার পুলিশ কল করেছে, আমরা নাকি চাইল্ড এবিউজ করি। আমাদের স্বামী-স্ত্রীকে থানায় যেতে হয়েছে, আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তবে জানো তো, এ দেশের পুলিশও জানে, টিনএজ ছেলেমেয়েদের অনেকেই বয়সের এই ট্রাঞ্জিশনাল স্টেজে উলটাপালটা কাজ করে। -তোমার ছেলে এখন কেমন আছে? -আমার ছেলে মেডিক্যাল স্কুলে থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট এখন। তুমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করো? -আমি একজন ধর্মভীরু মুসলমান, ধর্মীয় সব নিয়মকানুন মেনে চলি। -তাহলে মনে বিশ্বাস রাখবে, তুমি যদি সৎ থাকো, গড উইল সেইভ ইউ। তোমার মেয়ের একটু সাইকোলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট দরকার। আমার ছেলেকে যে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখেছে, তোমাকে তার নাম-ঠিকানা সব দেব। তুমি যদি মনে করো, তোমার হাজব্যান্ডকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারো ড. রয়ের কাছে। ডক্টর একজন ইয়াং লেডি, খুবই ভালো ডক্টর, আমার ছেলের সমস্যা অনেক বেশি জটিল ছিল। এই ইয়াং লেডিই ভালো করে দিয়েছেন ওকে, তোমার মেয়েকেও ভালো করে দেবেন। -আমার হাজব্যান্ড আমার সঙ্গে যাবেন বলে মনে হয় না। আমি একা যাব, তুমি কি আমার সঙ্গে প্রথম দিন যাবে? আমার ভয় লাগছে। -আমি যাব, প্রথম দিন কেন, তুমি যখনই মনে হবে, আমাকে কল দিও। যেকোনো রকম সাহায্য আমি তোমাকে করব, আমার ওয়াইফের সঙ্গে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দেব। আমার ওয়াইফ মিডল স্কুলের টিচার, চমৎকার মানুষ। তার সঙ্গে কথা বললে তুমি মনে সাহস পাবে। এখন বাড়ি যাও, মন থেকে ভয় দূর করতে হবে। ঈশ্বর বিপদে ফেলে আমাদের পরীক্ষা করেন, মাথা ঠান্ডা রেখে পরীক্ষায় পাস করতে হবে। মেয়ে যখন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরবে, ওর সঙ্গে সহজ-স্বাভাবিক ব্যবহার করবে। এখন থেকে ওকে বুঝতে দিতে হবে যে তুমি ওর সবচেয়ে বড় বন্ধু। খুব বুদ্ধি করে ওর দিকে নজর রাখবে, যেন হাতের কাছে ধারালো কিছু না থাকে। ঠিক হয়ে যাবে, পনেরো বছর বয়স, আঠারোতেই পুরো বদলে যাবে। যদি সম্ভব হয়, হাজব্যান্ডের সঙ্গে কিছু কম্প্রোমাইজ করে নিও। জীবন একটা, কোনোভাবেই পরাজিত হওয়া যাবে না। রুমা গাড়িতে গিয়ে স্টার্ট দিল। মি. এডওয়ার্ডকে তখন আর অপরিচিত বা নতুন পরিচিত মনে হচ্ছিল না। রুমার কাছে মনে হচ্ছিল, কালো কুচকুচে মানুষটি তারই চাচা অথবা মামা। অনেক বছর আগে আমেরিকা চলে এসেছিল, এত বছর পর চাচা বা মামার সঙ্গে এখানে দেখা হলো। পরক্ষণেই মনে হলো, গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে হাত নাড়তে থাকা মানুষটি আসলে মানুষ নয়, কোনো ফেরেশতা, ইনি দেবদূত! একাকী, দুঃখী রুমার দুঃখ দূর করে দিতে স্বয়ং আল্লাহ তাকে এখানে পাঠিয়েছেন। নাহলে আজই কেন উনি এখানে এলেন! গাড়ি নড়ে উঠল, রুমা অন্তরের সবটুকু আবেগ আর ভালোবাসা হাতের পাতায় জড়ো করে, হাত নাড়িয়ে কালো মানুষটির দিকে ছড়িয়ে দিল।

মন্তব্য করুন


 

Link copied