আর্কাইভ  শুক্রবার ● ২৯ মার্চ ২০২৪ ● ১৫ চৈত্র ১৪৩০
আর্কাইভ   শুক্রবার ● ২৯ মার্চ ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: দিনাজপুরে ছিনতাইকৃত মালামাল উদ্ধারসহ ছিনতাইকারী চক্রের দুই সদস্য গ্রেপ্তার        জমি রেজিস্ট্রি করে না দেয়ায় বাবাকে কবর দিতে ছেলের বাঁধা ॥ পুলিশের হস্তক্ষেপে দাফন       নীলফামারীতে স্বামীর প্রথম বিয়ের খবরে নববধূ দ্বিতীয় স্ত্রীর আত্মহত্যা ॥ স্বামী গ্রেপ্তার       রংপুরবাসীর জন্য সরকারি চাকরি, পদ ১৫৯       স্বাস্থ্যের রংপুর বিভাগীয় পরিচালক ফজলুল হক কারাগারে      

 width=
 

ভয় দেখান নয়তো লোভ, মানুষ এ দুইয়ের ছায়ায় আসবেই

বৃহস্পতিবার, ১৮ জুন ২০১৫, দুপুর ০৪:৪৫

তামান্না সেতু

বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ভালো খেলার সুবাদে রুবেলও ঠিক সেরকমই হয়ে উঠেছিলেন বলেই রুবেলকে দিয়ে রবির এই আহ্লাদ।

রবি যে বিজ্ঞাপনটি রুবেলকে দিয়ে করিয়ে নিলো তা আমি দেখার আগে আমার ছেলে দেখেছে বলেই মনে হয়। কারণ আমি ওই বিজ্ঞাপন দেখার আগেই তার মুখে দু-চারবার যে বাক্যটি শুনে ফেললাম তা হলো-‘ডাইরেক্ট ভাইঙ্গা দিমু’!

শুধু আমার ঘরে না, গ্রামের অনেক ছোট শিশু কিশোরদের মুখ থেকেও শুনেছি-‘ডাইরেক্ট ভাইঙ্গা দিমু’।

অস্বীকার করার কোন কারণ নেই যে, একাত্তরের পর সমগ্র বিশ্বে আমাদের দেশ নিয়ে গর্বের এত বড় কারণ বোধহয় আর ঘটেনি যা ক্রিকেট ঘটিয়ে দিলো। যারা এই খেলাটির সাথে জড়িত তারা নিজেরাও হয়ত জানেন না যে তাদের সমস্ত কর্মকাণ্ড আমরা কতখানি ভালোবাসার সাথে পর্যবেক্ষণ করি। কিছুদিন আগে মাশরাফি রিক্সা এক্সিডেন্ট করেছে এই খবর শোনার পর আমার ছেলে রাতে না খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেলো। আবার এই মাশরাফি রুবেলদের মতো ভালো খেলুড়ে ক্রিকেটারদের দেখে উৎসাহিত হয়েই আমার নাইনে পড়া ছেলেটি বলতে শিখল ‘মা, আমি বড় হয়ে ক্রিকেটার হবো’।

ক্রিকেটীয় সংস্কৃতি পারস্পারিক বন্ধুত্ব, সম্প্রীতি তৈরিতে বিশ্বাসী বলেই জানি। আর তাই বিশ্বকাপ শুরুর আগে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশগুলোকে উদ্দেশ্য করে যখন পেপসি ও ভারত ‘মওকা মওকা’ নামের একটি ব্যাঙ্গাত্মক বিজ্ঞাপন তৈরি করলো তখন আমার আশপাশের মানুষগুলোকে কষ্ট পেতে ও এর নিন্দা জানাতে দেখেছি।

কিন্তু, দু সপ্তাহ ধরে মোজো নামক কোমল পানীয়’র বিজ্ঞাপন দেখলাম। যেখানে বাংলাদেশে খেলতে আসা ভারতীয় দলকে ‘বাঁশ’ দেওয়ার প্রস্তুতি দেখানো হচ্ছে!

কথা হচ্ছে, প্রতিটি দেশের দেশীয় বিজ্ঞাপন যেহেতু সে দেশের সংস্কৃতিকে ধারণ করে তাই এটি একটি সুস্থ ও প্রয়োজনীয় চিন্তা হবে এটাই কাম্য। আর এই ধরনের বিজ্ঞাপন আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠতে পেরেছে কি পারেনি সে বিচার পাঠক নিজেই করতে পারেন।

আমাদের গণমাধ্যমে দেশীয় বিজ্ঞাপন ছাড়াও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছে। সরাসরি ভারতীয় বিজ্ঞাপন অনুবাদ করেও সেগুলো নানান দেশের নানান ভাষায় ডাবিং করে প্রচার করা হয়। এতে অন্যদেশের উপযুক্ত সংস্কৃতি আমাদের দেশে সরাসরি ঢুকে আমাদের সংস্কৃতির সাথে মিশে লেজে গোবরে অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। কিছুদিন আগে ‘এটম’ নামে এক চকলেটের বিজ্ঞাপন দেখলাম- যেখানে দেখানো হচ্ছে সেই চকলেট খেলে যে কোন আটকে যাওয়া পরিস্থিতি থেকে চাপাবাজি করে বের হয়ে আসা যায়। তাদের স্লোগান "এটম খাও চাপার জোর বাড়াও"!এই ধরনের বিজ্ঞাপন তৈরী ও প্রচারে কি কোন প্রতিবন্ধকতা নেই?

এক্ষেত্রে একটি বিষয়ই শুধু উল্লেখ করতে চাই। তা হলো, একজন শিশু বা একজন কিশোর যখন টেলিভিশন সেটের সামনে বসে ‘চাপাবাজি’ করার উৎসাহ পায় তখন সে এর বৈধতা পেয়ে যায়। তা পরিবার হোক বা পরিবারের বাইরে হোক সে এই ‘চাপার জোর’ বাড়াতে অতি উৎসাহী হয়ে উঠতে পারে। আর এর দায়মুক্ত হওয়ার সুযোগ পাবে কি বিজ্ঞাপনওয়ালা?

ফেয়ার এন্ড লাভলি তো প্রতিনিয়ত দেখিয়েই যাচ্ছে- পৃথিবীটা ফর্সা মেয়েদের হাতের মুঠোয়! কালো মেয়ের না আছে ঘর, না আছে বড়, না আছে ক্যারিয়ার। আর এ নিয়ে সমালোচনা বা লেখালেখি এখন আর নতুন কিছু নয়।

হরলিক্সের বিজ্ঞাপন দেখে মনে হয় বেঁচে থাকার জন্য আর কোন খাবারের প্রয়োজন নেই, হরলিক্সের ভেতরেই আছে পৃথিবীর সকল খাবারের গুণ! এমনকি সম্পূর্ণ সুষম খাবার বলে পরিচিত যে দুধ, তাকেও এখন পারফেকশনের জন্য হরলিক্সের দ্বারস্থ হতে হয়। এদের স্লোগান – ‘দুধে হরলিক্স মেশান, দুধের শক্তি বাড়ান’। দুটি পন্য একইসাথে বিক্রির এই ছলচাতুরীটা সহজেই অনুমেয় হলেও চাতুরী করে কেনাটা আর বন্ধ হয় না!

বিজ্ঞাপন আজ নতুন এক ধর্মযাজক হয়ে পৃথিবী চালাতে চাচ্ছে কারণ তাদের সাথে আছে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এই নতুন ধর্মের ভিত্তিও সেই আদিম নীতির উপর- ‘ভয় দেখাও নয় লোভ দেখাও, মানুষ এই দুইয়ের ছায়ায় আসবেই’।

প্রতিটি বিজ্ঞাপনের মেসেজ ঘুরে ফিরে একই রকম। হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, গাড়ির টায়ার, খাদ্যসামগ্রী, প্রসাধনী সবার একই কথা, এই হাসপাতাল, এই টায়ার, এই খাবার বা এই প্রসাধনী ছাড়া অন্য কিছু ব্যবহার করলে আপনি বিপদে পড়বেন বা আপনার মৃত্যু নিশ্চিত! একই সাথে এই সকল পণ্য ব্যবহারে আপনি পাবেন প্রাণ, উচ্চতা, ফর্সা রং, স্মার্টনেস!

এসব বিজ্ঞাপন প্রচারে যে নীতিমালা রয়েছে তা কি বলে?(যদিও এদেশে নীতিমালা হোক বা আইন হোক তার কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় কখনোই অস্বীকার করার মতো নয়।)

২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার বিজ্ঞাপন সম্প্রচার সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। কিছু উল্লেখযোগ্য নীতি সেখান থেকে এই লেখায় যুক্ত করছি, তাতে পাঠকের চোখেও সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে বিজ্ঞাপনের বহু অসঙ্গতি ধরা পরবে বলে মনে করি।

বিজ্ঞাপন সম্প্রচার সংক্রান্ত নীতিমালা (২০১৩)

৪.২.১ বিএসটিআই এর তালিকাভুক্ত পণ্য সামগ্রীর বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে বিএসটিআই মান নিয়ন্ত্রণ সনদপত্র উপস্থাপন করতে হবে। এছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে (যেখানে প্রযোজ্য) সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মান নিয়ন্ত্রণ সনদপত্র উপস্থাপন করতে হবে।

৪.২.২ বিজ্ঞাপনে এমন কোন বর্ণনা বা দাবী প্রচার করা যাবে না যাতে জনগণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতারিত হতে পারে।

৪.২.৩ বিজ্ঞাপনে প্রতিযোগী পণ্যের তুলনা বা নিন্দা করে শ্রেষ্ঠত্ব দাবী করা যাবে না। অন্য পণ্য সম্পর্কে বিজ্ঞাপনে অমর্যাদাকর কোন উক্ত করা যাবে না।

৪.২.৪ সংবাদের আকারে বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না। অনুষ্ঠান হতে বিজ্ঞাপন ভিন্নতর হতে হবে। নাটক বা কোন অনুষ্ঠানের ভিতরে বিজ্ঞাপন বা বিজ্ঞাপনের বিষয়বস্তু প্রত্যক্ষ করা যাবে না।

৪.২.৭ কোন ধরনের নকল বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না।

৪.২.৮ ঔষধ জাতীয় পণ্য, হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনোষ্টিক সেন্টার, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ইত্যাদির বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অথবা তার অধীনস্থ অধিদপ্তরের অনুমোদন/ছাড়পত্র গ্রহণ করতে হবে।

৪.৩.২ কোন বিজ্ঞাপন শোভনীয়, সুন্দর, সুরুচিপূর্ণ ও পরিমার্জিত কিনা এ বিষয়ে কোনরুপ দ্বিধা/সন্দেহ দেখা দিলে সংশ্লিষ্ট টিভি চ্যানেলকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।

৪.৪.২ শিশুদের নৈতিক, মানসিক বা শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে এমন বিষয়কে বিজ্ঞাপনে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। শিশুদের স্বাভাবিক বিশ্বাস ও স্বভাব সুলভ সরলতার সুযোগকে প্রতারণাপূর্ণ ও চাতুর্য্যের সাথে কাজে লাগিয়ে কোন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য হাসিলের প্রয়াস গ্রহণযোগ্য হবে না।

-এসব বিষয় নিয়ে ব্যক্তিগত অনুভূতি হিসেবে আরো অনেক কিছু তুলে ধরা সম্ভব। তবে তার বদলে ‘বুদ্ধিজীবীর নোটবই’ নামক গ্রন্থতে অনিশ্চয় চক্রবর্তীর “বিজ্ঞাপন” নামক প্রবন্ধের কিছু অংশ দিয়ে লিখা শেষ করছি...

‘বিজ্ঞাপন আমাদের জীবনের বহিরঙ্গের নির্মাতা। চেতনার দিকে যার হাত বাড়ানো। ধর্মীয় বিশ্বাস আর বিদ্যালয়ের চেয়ে এমন ব্যাপ্ত প্রভাব আর কোন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের নেই। এক সকাল থেকে পরের সকাল, সমস্ত গণমাধ্যম জুড়ে বিজ্ঞাপনের শাসন। অভিমুখ একটাই, ব্যক্তির মন। ধনতন্ত্রের ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠার পর গত ৫০ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিজ্ঞাপনের জগতেও চূড়ান্ত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেছে। বিজ্ঞাপনের বিকাশেও রয়েছে সেদেশের উৎপাদক সংস্থাগুলির ভূমিকা, অবশ্যই নিয়ন্তার। মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতায়, বয়ানের সত্য মিথ্যায়, স্বাদুতায়-স্বাদহীনতায়, জীবন ও মূল্যবোধের ওপর সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তারে বিজ্ঞাপন আমাদের অস্তিত্বকে ঘিরে রেখেছে। তবে এত চর্চার মধ্যেও কিছু অবিবেচনা থাকে বিজ্ঞাপনদাতারও। খাওয়ার সময় কোষ্ঠবদ্ধতা থেকে রেহাই-এর বিজ্ঞাপন থেকে দর্শক বা শ্রোতাকে কে বাঁচাবে?’

লেখক: পরিচালক- বাতিঘর, শিশুদের সাংস্কৃতিক বিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন


 

Link copied